রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় যুব কমিশনের আয়োজনে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানার অন্তর্গত রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের নব ঘোষিত ধর্মপল্লী ভূতাহারাতে ১৯ -২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলো রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় যুব দিবস ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। এ বছরে মুলসুর হিসেবে নেওয়া হয়েছে ‘মিলনযাত্রায় বাণী প্রচারে যুব সমাজ; আশায় আনন্দিত হও’- এ মুলসুরকে কেন্দ্র করে ছয় দিন ব্যাপী পালিত হলো এই যুব দিবস । রাজশাহীর ধর্মপ্রদেশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে মোট ২৩০ জন যুবক যুবতী এবং ফাদার সিষ্টার অংশগ্রহণ করেন।

যুব ক্রুশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে যুব দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ভূতাহারা ধর্মপল্লীর যুবক যুবতী, ফাদারগণ ও সিস্টারগণ যুব দিবসের ক্রুশ নিয়ে যুব কমিশনের হতে তুলে দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ মহোদয় যুব ক্রুশ গ্রহণ করেন এবং তিনি এই ক্রুশ নিয়ে তুলে যুব কমিশনের যুব সমন্বয়কারী ফাদার নবীন পিউস কস্তার হাতে অর্পণ করেন এবং তিনি এনিমেটর সহ সকলকে নিয়ে যুব ক্রুশ স্থাপন করেন। বিশপ মহোদয় উপস্থিত সকল যুবাদের সাথে সাক্ষাতে বসেন, বিশপ যুবাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন, তোমরা বাণী প্রচার কর কিভাবে? উত্তরে দ্বীপ পালমা বলেন, আমি নিজের জীবন দিয়ে বাণী প্রচার করার চেষ্টা করি, যিশু যে জীবনাদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন  সে অনুসারে চলার চেষ্টা করি। 
বিশপ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, খ্রিস্টান ধর্ম হচ্ছে ত্যাগ স্বীকারের ধর্ম, তিনি মিডিয়ার কিছু কুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, মিডিয়াকে যেনো আমরা ব্যাবহার করি , কিন্তু মিডিয়া যেনো আমাদেরকে ব্যবহার না করে।  
ফাদার ফাবিয়ান মারণ্ডি বলেন, যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের উচিত কিছু সময় নিরবে ধ্যান করা, ঈশ্বরের সাথে একান্ত ভাবে সময় কাটানো। তিনি আরো বলেন, ক্রুশ যেনো হয় আমাদের চলার পথের পাথেয় । 
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন, ভিকার জেনারেল ফাদার ফবিয়ান মারান্ডি, চেন্সেলোর ফাদার প্রেমু রোজারিও, যুব সমন্বয়কারী ফাদার নবীন পিউস কস্তা এবং তিন ভিকারিয়া থেকে তিন জন যুবক যুবতী। এরপরই শুরু হয় ক্রুশের আরাধনা, এটি পরিচালনা করেন কমিশনের এনিমেটরগণ।
রাতে স্বাগতিক ধর্মপল্লী আগত সকল যুবাদের স্থানীয় কৃষ্টিতে বরণ করেন নেন এবং ভূতাহারা ধর্মপল্লী ইতিহাস উপস্থাপন করেন। এরপর পরিচয় পর্বের মধ্য দিয়ে সকলে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়।
২০ তারিখ সকালে উদ্বোধনী খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন ফাদার ফাবিয়ন মারণ্ডী। তিনি তার উপদেশে বলেন, শুধু ব্রতধারি – ব্রতধারিনীরা নয় বরং আমরা সবাই এক এক জন খ্রিস্টের সৈনিক। আমরা দীক্ষাস্নানের মধ্য দিয়েই ইশ্বরের বাণী প্রচার করার দায়িত্ব পেয়েছি।
উদ্বোধনী খ্রিস্টযাগের পর শুরু হয় যুব র‌্যালী। এই র‌্যালীতে সকলে নিজ নিজ কৃষ্টির পোশাক পরে অংশগ্রহণ করে। র‌্যালী শেষ করে শুরু হয় পতাকা উত্তোলন, লোগো উন্মোচন এবং ফটোফ্রেম এর উদ্বোধন। এ সময় জাতীয় সঙ্গীত এবং যুব সঙ্গীত পরিবেশনা করা হয় । দ্বিতীয় পর্বে ছিল স্টল ও দেয়ালিকা কর্নার উদ্বোধন, বিভিন্ন ধর্মপল্লীর যুবারা তাদের ধর্মপল্লীর যুব কার্যক্রমের উপর একটি করে দেয়ালিকা তৈরি করে নিয়ে আসে প্রদর্শনীর জন্য এবং তিন ভিকারিয়ার তিনটি স্টলে বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পিঠা প্রদর্শনী হয় । স্টল ও দেয়ালিকা কর্নার উদ্বোধন করেন ফাদার নবীন পিউস কস্তা।
ফাদার উইলিয়াম মুর্মু মান্ডলিক আইন সম্পর্কে ক্লাশ দিতে গিয়ে বলেন, যে কেনো কিছু সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার জন্য আইন কানুনের প্রয়োজন, ঠিক সেরকমই মণ্ডলি পরিচালনার জন্যও কতগুলো আইনকানুন রয়েছে।
সন্ধ্যায় ক্রুশের অর্চনা এবং পাপস্বীকার হয়, এতে সকলে সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে। রাতে জ্যোতি মুর্মু ও এনিমেটরদের পরিচালনায় বন্ধুত্বের আনন্দ নামক একটি সময় পার করা হয়, এতে বন্ধু সম্পর্কে অনেকের কথা শুনা হয়। বনপাড়া ধর্মপল্লীর বনী রোজারিও বলেন, আমার একটা বন্ধু আছে যাকে বন্ধু বললে ভুল সে আমার সব থেকে কাছের একজন মানুষ আমার কিছু হলে সে ঠিকই টা বুঝে ফেলে আবার তার সাথে দেখা না করে কথা না হলে সব কিছুই কেমন জানি অসম্পূর্ণ মনে হয় । মারিয়া তপ্ন বলেন, বন্ধুত্ব হলো মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ যা বাদ দিয়ে দিলে মানুষের জীবন সম্পূর্ণ স্বাদহীন মনে হবে। 
পরদিন সকালে ফাদার সুনীল দানিয়েল রোজারিও সকলের জন্য পবিত্র খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করেন, তিনি বলেন, আমরা বড় সূর্য হয়ে উঠতে না পারলেও আমরা এক একটি প্রদীপ হতে পারি যা কিনা আমাদের সমাজকে আলোকিত করবে, এই মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে পারলে আমরা কখনোই অকৃতকার্য হবো না, আর যুব দিবস হচ্ছে এই সব বুঝে উঠার একটা উপযুক্ত সময় । 
বাণী প্রচার ও আমাদের দায়িত্ব , কৌশলগত দিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে ধর্মপ্রদেশীয় কাটেখ্রিস্ট সুশীল টুডু বলেন, আমরা যে গলায় ক্রুশ পরিধান করি এইটাই আমাদের একটা বাহ্যিক চিহ্ন যে আমি একজন খ্রিস্টান। এরপর গ্রাম পরিদর্শনের দিক নির্দেশনা দেন ভূতাহারা ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার লুইস সুশীল পেরেরা , তিনি সকলকে আহ্বান করেন, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। তিনি বলেন, যারা আমরা গ্রামে যাচ্ছি তাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে আমরা আমাদের সাথে যিশুকে নিয়ে যাচ্ছি , আর তার আদর্শ মানুষের কাছে প্রচার করতে যাচ্ছি । 
পরদিন গ্রাম পরিদর্শন শেষ করে মিশনে ফিরে জীবন্ত ক্রুশের পথের মাধ্যম ফুটিয়ে তোলা হয় যিশুর যন্ত্রণা ভোগের কাহিনী। ধর্মপল্লীতে ফিরে এসে অনেকেই তাদের নিজ নিজ গ্রাম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা সহভাগীতা করেন; বোর্নি ধর্মপল্লী থেকে মৃদুল পালমা বলেন, আমি কখনো আদিবাসী মানুষের সাথে থাকিনি, বন্ধু বান্ধব থাকলেও একটা পরিবারে তাদের সদস্যের মত থাকতে পারে অনেক কিছুই অভিজ্ঞতা করতে পেরেছি, আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কেও অনেক জ্ঞান অর্জন করে ফিরেছি। 
প্রান্তি সরেন বলে, আমার সব থেকে বেশি পছন্দ হয়েছে গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা, আমরা যে কয়জন একটা গ্রামে গেছিলাম আমাদেরকে ঘিরে গ্রামটিতে যেনো একটা উৎসবের আমেজ পেলাম।  
মিঠুন তির্কি বলে, একটাবারের জন্যও মনে হয়নি আমি তাদের পরিবারের বাইরের কেউ, তারা নিজের পরিবারের সন্তানদের মতোই আগলে রেখেছিল। 
ফায়ার ক্যাম্প প্রোগ্রামে নিজ নিজ সংস্কৃতি কে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফায়ার ক্যাম্প আগুন আশীর্বাদ করেন ফাদার লুইস সুশীল পেরেরা, তিনি বলেন আগের দিনের মানুষেরা আনন্দিত হলে কিনবা কোনো কিছু উদযাপন করার সময় আগুনকে ঘিরে অনেক নাচ গান করতো, ঠিক একই ভাবে আমরাও আমাদের আনন্দ প্রকাশের জন্য এইখানে এই ফায়ার ক্যাম্প এর ব্যাবহার করবো।
নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে ভিনসেন্ট চড়ে বলেন, আমরা অনেকেই অনেক ভালো পড়াশুনা করে শিক্ষিত হয়, কিন্তু যদি আমরা নৈতিক মূল্যবোধে বেড়ে না উঠতে পারি তবে এইসব শিক্ষা শুধু মাত্র কাগজ কলমের শিক্ষাই হয়ে থেকে যাবে জীবনে উন্নতি হবে না।
মিস্টার র‌্যাক্সি মার্ক রোজারিও যুবাদের অনুপ্রাণিত করেন নিজের কাজ নিজেই করার মধ্য দিয়ে । তিনি আরো বলেন, সুষ্ঠ জীবনযাপনের জন্য সঠিক ক্যারিয়ার বেছে নিতে হবে, প্রয়োজনে অভিজ্ঞ মানুষের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। ফাদার বাবলু কোড়াইয়া বলেন, প্রযুক্তিকে অনেকভাবেই ব্যাবহার করা যায় , সেটা খারাপ কাজেও হইতে পারে আবার ভালো কাজেও । তাই আমাদের উচিত প্রযুক্তির সঠিক ব্যাবহার করা এবং এর কুফল বর্জন করে এর সঠিক ব্যবহারের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে বলেন এবং এর মধ্য দিয়ে যেনো কারো কোন ক্ষতি না হয় সে লক্ষ্য রাখতে পরামর্শ  দেননি এবং মিডিয়া ব্যবহার করে মঙ্গলবাণী প্রচারের উৎসাহিত করেন।
বিকেলে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও এই যুব দিবশের সমাপনী খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করেন , তিনি বলেন, আমরা জীবনে অনেক অস্থিরতার মধ্যে বাস করি, এখন আমাদের নিজেদের খুজে বের করতে হবে আমাদের এর অস্থিরতার কারণ কি।
একটা দেওয়ালের ২ টা পাস থাকে সেরকম আমাদের জীবনেও ২ টা পার্ট আছে, একটা ভালো এবং একটা খারাপ, এখন আমাদেরকে বেছে নিতে হবে আমরা ভালোর দিকে যাবো নাকি খারাপের দিকে। আমরা কিন্তু সবাই সুখী হইতে চাই কিন্তু পরিশ্রম করতে পছন্দ করি না। একটা কথা মনে রাখো যুবক যুবতীরা সুখ লাভের কোনো সর্টকাট উপায় নেই ।
ফাদার সুজন গমেজ যুব কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যুব ক্রুশ আমাদের ধর্মপল্লীতে আসার কারণে সব থেকে বেশি আমরা উপকৃত হয়েছি, কারণ এই ক্রুশ কে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে একতা , যা আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া।
সমাপনী খ্রিস্টযাগের পর ক্রুশ হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রদেশীয় যুব দিবস ২০২৩ এর শুভ সমাপ্তি ঘটে। বিশপ মহোদয় যুব ক্রুশ তুলে দেন প্রভু নিবেদন ধর্মপল্লী সুরশুনিপড়ার হাতে তুলে দিলে সুরশুনিপড়া ধর্মপল্লীর যুব অতি আনন্দের সাথে ক্রুশটি গ্রহণ করে এবং নাচ,গান, উল্লাস করে তাদের আনন্দ অনুভুতি প্রকাশ করেন। বিশপ মহোদয় ঘোষণা দেন যে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সুরশুনিপড়া ধর্মপল্লীতে অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় যুব দিবস। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ধর্মপ্রদেশীয় যুব দিবস ২০২৩।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার: বেনেডিক্ট তুষার বিশ্বাস
Please follow and like us: