গত ৫ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে ১২ জন খ্রিস্টভক্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাণী-পাঠক ও বেদীসেবক পদে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ মণ্ডলিতে রাজশাহীর ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো বাণী-পাঠক ও বেদীসেবক পদে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জেভার্স রোজারিও, অত্যন্ত ভাবগাম্ভির্য ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিদের বাণী-ঘোষক ও বেদীসেবক পদে প্রতিষ্ঠা করেন। এই পবিত্র অনুষ্ঠানে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ও ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী, উপাসনা ও প্রার্থনা বিষয়ক কমিশন, রাজশাহী এর আহ্বায়ক ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের এম.সি ফাদার শ্যামল গমেজ সহ ১ জন ব্রাদার, ৬ জন সিস্টার ও প্রায় ১০০০ খ্রিস্টভক্ত উপস্থিত ছিলেন।
এই মহতী-পুণ্য অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিশপ মহোদয় বলেন, দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হলো খ্রিস্টমণ্ডলির অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংস্কার সাধন ও বর্তমান যুগের সাথে মণ্ডলির যুগোপযোগীকরণ। পুণ্য উপাসনা সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিতকরণের মধ্য দিয়েই এর যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। মণ্ডলির সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটি হলো পুণ্য উপাসনা। দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভার পরবর্তী সময়ে মহাসভার নির্দেশ অনুযায়ী উপাসনার সংস্কার সাধন ও যুগোপযোগীকরণের ক্ষেত্রে ও ভক্ত-মণ্ডলির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপাসনা ও প্রার্থনা বিষয়ক বিশপীয় কমিশন বিভিন্ন প্রচেষ্টা গ্রহণ করে চলেছে। তারই একটি বহিঃপ্রকাশ হল বাংলাদেশ মণ্ডলিতে কিছু খ্রিস্টভক্তকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে বাণী-পাঠক ও বেদীসেবক পদে প্রতিষ্ঠা। আজকে আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদের ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে ১২জন বাণী-ঘোষক ও বেদীসেবক পদে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই আমরা তাদের জন্য প্রাথর্না করি যেন তারা এই পবিত্র সেবাদায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতে পারে। উল্লেখ্য যে দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার উপাসনা বিষয়ক দলিলে ও রোমীয় খ্রিস্টযাগ-রীতির সাধারণ নীতিমালায় এই বিষয়ে সুন্দর দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ’
প্রথমত, বাণী-পাঠক পদটি পুণ্য উপাসনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দৃশ্যমান একটি সেবা-দায়িত্ব। রোমীয় খ্রিস্টযাগ-রীতির সাধারণ নীতিমালার ২৯নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উপাসনাগৃহে যখন পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর জনগণের কাছে কথা বলেন এবং খ্রিস্ট যিনি বাণীতে উপস্থিত, তিনি মঙ্গলসমাচার ঘোষণা করেন।” একই নীতিমালার ১০১ ধারাতে রয়েছে : যাঁরা খ্রিস্টযাগে শাস্ত্রপাঠ পড়েন তাদেরকে অবশ্যই বাণী ঘোষণার কাজটি চালানোর জন্যে যোগ্য ও উপযুক্ত হতে হবে এবং তাঁরা সযত্নে প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন যাতে পবিত্র শাস্ত্র থেকে যখন তাঁরা বাণী ঘোষণা করেন তা শ্রবণ করে বিশ্বাসী ভক্তগণ তাদের হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে পারেন পবিত্র শাস্ত্রের প্রতি এক মধুর ও প্রাণবন্ত অনুরাগ।” ঐশবাণী পঠনের কাজটি খ্রিস্টমণ্ডলির একটি আনুষ্ঠানিক সেবাপদ (মিনিস্ট্রি) যাকে বলা হয় ‘লেক্টরশীপ। পুণ্য উপাসনায় একজন বাণী-ঘোষক উপাসক-মণ্ডলির সেবার্থে নিবেদিত পুণ্য উপাসনায় সমবেত ভক্তমণ্ডলির সামনে বাণী-ঘোষক তাঁর প্রাবক্তিক ভূমিকা পালন করেন: তিনি মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের বাণী ঘোষণা করেন এবং মণ্ডলির প্রতিনিধিরূপে বিশ্বাসীবর্গের প্রার্থনা অর্থাৎ সার্বজনীন প্রার্থনার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন।
দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠিত বেদীসেবক ভক্তমণ্ডলির প্রতিনিধি ও সেবকরূপে একজন বেদীসেবক পুণ্যস্থানে যজ্ঞবেদী প্রস্তুতকরণে এবং পরে খ্রিস্টপ্রসাদ বিতরণে যাজককে সহায়তা করেন। অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ বলেই যথাযথ প্রশিক্ষণ ও আনুষ্ঠানিকভাবে সেবাপদে স্থাপন (Institution of Acolytes)- এর মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তিকে বেদীসেবক পদে বহাল করার মাণ্ডলিক ঐতিহ্য রয়েছে। বেদীসেবক ও পুণ্য উপাসনার একটি মাণ্ডলিক সেবাপদ। বেদীসেবক পদে একজন ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় যজ্ঞ বেদীকে ঘিরে নানামুখী সেবাদান করার জন্য। উপাসনা অনুষ্ঠানাদিতে, বিশেষত পবিত্র খ্রিস্টযাগে, তিনি ডিকনকে সাহায্য করেন এবং যজ্ঞ নিবেদনের কাজে যাজককে সেবাদান করেন। বিশেষতঃ বেদী প্রস্তুত করা (যেমন: পৌরহিত্যকারীর ব্যবহার্থে ‘খ্রিস্টযাগের প্রার্থনা সংকলন’ বই, প্রভুর-স্মরণোৎসব’ বই, বুক-স্ট্যান্ড, বুক-মার্ক, বেদীর মাইক ইত্যাদি বেদীর যথাস্থানে রাখা) এবং পুণ্য পাত্রগুলি বেদীতে বয়ে এনে যথাস্থানে রাখা বেদীসেবকেরই বিশেষ দায়িত্ব। প্রয়োজনবোধে তিনি এগিয়ে গিয়ে জনগণের বয়ে আনা উপহার/অর্ঘ্য-সামগ্রী গ্রহণ করতে যাজককে সহায়তা করেন; রুটি-দ্রাক্ষারস বহন করে বেদীতে নিয়ে আসেন ও তা যাজকের হাতে তুলে দেন। ধুপারতির ব্যবহার থাকলে বেদীসেবক তখন যাজকের কাছে ধুপাধার উপস্থাপন করেন এবং যাজক যখন নৈবেদ্য, বেদী ধুপায়ন করে প্রদক্ষিণ করেন, তাঁকে সাহায্য করেন।
খ্রিস্টযাগে বাণী পাঠক ও বেদী সেবক পদ প্রতিষ্ঠা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তাদেকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। বেদী সেবকদের নিদির্ষ্ট পোশাক দান করা হয় যেন তারা এই পোশাক পরিধান করে এই সেবাদায়িত্ব পালন করতে পারে। খ্রিস্টযাগের পর নব প্রতিষ্ঠিত বাণী পাঠক ও বেদীসেবকদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়।
বেদীসেবক পদ লাভকারী মি: এলিও কিস্কু বলেন, ‘ আমি আজ সত্যিই অনেক আনন্দিত ও ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ ঈশ্বর পবিত্র খ্রিস্টযজ্ঞে যাজকদের সাহায্যকারী সেবক হিসেবে আমাকে বেছে নিয়েছেন।’
বাণীপাঠক পদ লাভকারী মিসেস মনিকা বাড়ৈই বলেন, আজকের এই দিনে আমার অনুভূতি অনেক আনন্দের কারণ আমি পবিত্র মঙ্গলবাণী প্রচারের জন্য মাণ্ডলিকভাবে একটি বিশেষ সেবাদায়িত্ব লাভ করেছি। আমি যেন এই পবিত্র দায়িত্ব বিশ্বস্তভাবে পালন করতে পারি।’
পরিশেষে ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত বাণী-পাঠক ও বেদীসেবকপদে প্রতিষ্ঠা লাভকারী সকলকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান এবং এই পবিত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মহতী অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন