ফাদার যোয়াকিম রবিন হেম্ব্রম

ভূমিকা: জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য। জন্মিলে মরতে হবে, অমর কে কোথা কবে’। মানুষের জীবনে এই দুটি লাইন চরমভাবে সত্য। কিন্তু মানুষ এই জগৎ সংসারে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়। মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য সে বিন্দুমাত্র ক্রটি করে না। দৈহিক রঙ্গ-রসে জাগতিক সুখ-ভোগ করতেই মানুষ আগ্রহী। কিন্তু প্রকৃতির বিধান অমান্য করা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। কালের স্রোতে আমাদের জীবনাবসানের ঘটনা একদিন ঘটবেই। আমাদের দেহ নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু আত্ম অবিনশ্বর, চিরন্তন, চিরস্থায়ী, বিনাশের উর্ধ্বে। মৃত্যুর পরেই এই আত্মিক জীবনের সূচনা ঘটে। মৃত্যু দৈহিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মিক জীবনের সূচনা করে থাকে, যার নাম অনন্ত জীবন।

 

–  মৃত্যু সম্পর্কে  Harpas Bible Dictionary তে তিন ধরণের সজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-

   Biologically: Death is the end of every creature existence; God alone is immortal (Ps. 90:1-6)

   Metaphorically: death is a vale judgement upon those things that detract from life as the Creator intended it (1 Sam. 2:6-7).

   Mythologically: Death is a power that acts independently (jer 9:21)

 

–  মৃত্যু সম্পর্কে  Pope Francis’ বাছাইকৃত কয়েকটি বিখ্যাত উক্তিগুলো হলো-

  1. The question of death is a question of life
  2. Death affects us all.
  3. Our lives do not end with death.
  4. The one who practices mercy does not fear death.
  5. God will keep us steadfast even in our final passage of death.
  6. Death is defeated, hope is restored.
  7. The More We Live Life, The Less We Fear Death.
  8. We begin to die when we forget about death.

মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার বাসনা চিরন্তন। আমরা কেউ-ই মরতে চাইনা। আমরা সবাই অমর হতে চাই।   কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছেন, মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। নিজেকে পৃথিবীর মাঝে টিকিয়ে রাখতে মানুষের কর্ম প্রচেষ্ঠার কোন কমতি নেই। আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে জানতে পারি যে মিশর দেশের রাজারা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে অমর হয়ে বেঁচে থাকার জন্য অনেক আপ্রাণ চেষ্ঠা করেছিলেন। নিজেদের জীবনকে অমর করতে না পেরে অবশেষে তাদের দেহকে অমর করার অবিরাম প্রচেষ্ঠা তারা করেছেন। অবশেষে অনেক পরিশ্রম ও গবেষণা করে তারা তাদের দেহকে মমি করে রাখার পন্থা আবিষ্কার করেছেন। এই মমির মাধ্যমেই তারা এই পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকার চিরন্তন বাসনা পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন।

মৃত্যু হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা বা বিষয় নয়। আবার মৃত্যু ভবিষ্যতেরও কোন কাজ বা ঘটনা বা বিষয় নয়। মৃত্যু একটা প্রক্রিয়া, জীবনব্যাপী চলমান একটা প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আমরা প্রতিদিনই প্রতি মূহুর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি নি:শ্বাসে; ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে চলতে চলতে যখন আমাদের জীবনে চূড়ান্ত মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে তখন আমরা হয়ে পড়ব নির্জীব একটি মাংসের পিন্ডমাত্র।

মৃত্যু সম্পর্কে ইসলাম ও সনাতন ধর্মের ধারণা নিম্ন রূপ:

ইসলাম ধর্মে মতে, মৃত্যু হল দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছেদ এবং সেই সময় থেকেই পরকালের সূচনা। আখিরাহ বা পরকাল ইসলামের ৬টি প্রধান বিশ্বাসের অন্যতম একটি বিশ্বাস। তারা মনে করে মৃত্যুতেই জীবনের শেষ নয় বরং নতুন রূপে জীবনের একটি অবিরাম যাত্রা। পৃথিবী হল জীবনের জন্য ক্ষণস্থায়ী বা অস্থায়ী জায়গা এবং প্রতিটি আত্মার জন্য একটি পরীক্ষার সময়। প্রকৃত জীবন শুরু হয় বিচারের দিনে যেখানে মানুষকে দুটি দলে ভাগ করে বিচার করা হয়। ধার্মিক ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবে ও অধার্মিক ব্যক্তিরা জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে।

সনাতন  ধর্মে মৃত্যুকে স্বতন্ত্র শাশ্বত আধ্যাত্মিক জীব আত্মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যা বর্তমান অস্থায়ী দেহ থেকে বেরিয়ে আসে। আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যায় যখন শরীর তার সচেতন আত্মাকে বা জীবনকে ধরে রাখতে পারে না। এটি মানসিক বা শারীরিক কারণে হতে পারে বা নিজের কর্ম সম্পাদনে অক্ষমতার কারণেও হতে পারে। তবে মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় তার কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করতে নতুন দেহ ধারণ করবে।

বেশকিছু বছর আগে একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে সৎগুরুকে Invite করা হয় ওনার Brain এর গামা ওয়েভস চেক করার জন্য। এরপর সৎগুরুর মাথার সাথে ১৪টি ইলেকটল লাগিয়ে ওনাকে মেডিটেড করার জন্য বলা হয়। তখন দেখা যায় মনিটরের ওয়েভ এর লাইন টা একেবারে ফ্লেড অর্থাৎ সরল রেখা দেখাতে শুরু করে। রিসার্চারদের মতে এটা একমাত্র মৃত মানুষের ক্ষেত্রেই হওয়া সম্ভাব কারণ মনিটরে ফ্লেড লাইন মানে ব্রেনে একটিভিটির কোন চিহ্নই নেই। ফলে সেই রির্সাচারা সৎগুরুকে Brain Death বলে ডিক্লিয়ার করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। আর কাউকে Brain Death ডিক্লিয়ার করা মানে তাকে মেডিকেলি এবং লিগ্যালি দুক্ষেত্রে মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়।

এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মেডিকেল সাইন্স যেটাকে মৃত বলে মেনে নেয় আসলে অনেক সময় তা সত্য নাও হতে পারে। আগে মেডিকেল সাইন্স এর মত অনুযায়ী ধরা হত- শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা হৃদ স্পন্দন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সেই ব্যক্তিটি মৃত। কিন্তু তারপর কিছু লোক শ্বাস-প্রশ্বাস বা হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার পর আবার জীবিত হয়ে উঠার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে, আসলে কখন একজন মানুষকে প্রকৃত পক্ষে মৃত বলে মানা উচিত তার সঠিক উত্তর খুঁজে না পাওয়ায় সাইন্স — ব্রেইন ডেথ, সোমাটিক ডেথ এই রকম বিভিন্ন টারমনলজি ব্যবহার করে থাকে বা ব্যবহার কারে আসছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়——- তাহলে ঠিক কখন একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত অর্থে মৃত বলে মেনে নেওয়া যায় ? যোগসূত্র এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।

যোগসূত্র অনুসারে মৃত্যু: যোগসূত্র অনুসারে যখন কোন ব্যক্তির শরীর থেকে পঞ্চপ্রাণ বা পঞ্চবায়ু সম্পূর্ণ রূপে বার হয়ে যায় তখন একমাত্র সেই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণরূপে মৃত বলে মেনে নেওয়া উচিত। এই পঞ্চপ্রাণ বা পঞ্চবায়ু হল- সামানাবায়ু, প্রাণাবায়ু, উডানাবায়ু, আপানাবায়ু এবং ভিয়্যানাবায়ু। যোগসূত্র অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই আস্তে আস্তে একেক করে পঞ্চবায়ু শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

প্রথমত: শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার পর ২১-২৪ মিনিটের মধ্যে সবার আগে সামানাবায়ু দেহ থেকে বের যায়। আমাদের দেহের তাপমাত্র নিয়ন্ত্রণ হয় সামানাবায়ু দ্বারা; আর এই কারনেই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার পর আমাদের দেহ বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত: শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার ৪৮-৯০ মিনিটের মধ্যে প্রাণাবায়ু শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আমাদের হৃদস্পন্দন এবং চিন্তাভাবনা করার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ হয় প্রাণাবায়ু দ্বারা আর এ কারণেই  শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার পর শেষকৃত্য করার আগে অন্তত:পক্ষে পক্ষ্যে ৯০ মিনিট অবশ্যই অপেক্ষা করার কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত: শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার পর ৬-১২ ঘন্টার মধ্যে উডানাবায়ু দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আমাদের দেহে লবতা নিয়ন্ত্রণ হয় উডানা বায়ুর দ্বারা। এই কারনেই উডানা বায়ু দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ মৃতদেহ তুলতে গেলে ভারী বলে মনে হতে শুরু করে। আসলে, কিন্তু সেই মৃত দেহের কোন ওজন বাড়ে না। কিন্তু উডানাবায়ু বের হওয়ার ফলে দেহটি ভারী বলে মনে হয়।

চতুর্থ: শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার ৮-১৮ ঘন্টার মধ্যে আপানাবায়ু দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আমাদের দেহের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ হয় আপানা বায়ুর দ্বারা। এজন্য অনেক সময় দেখা যায় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার কিছু সময় পর হঠাৎ সেই দেহ নিজে নিজেই অল্প হয়ত নড়ে উঠে। কারণ যতক্ষণ আপানাবায়ু দেহ ছেড়ে সম্পূর্ণ রূপে বেরিয়ে না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত খুব সামান্য হলেও সে দেহে অনুভূতি কাজ করতে থাকে।

পঞ্চম: যদি মৃত্যু সাধারণ বয়স জনিত কারণে সংঘঠিত হয় তাহলে ১১-১৪ দিন এবং যদি কোন এ্যাকসিডেন্ট বা অপঘাতে মৃত্যু হয় তাহলে ৪৮-৯০ দিন সময় ধরে ধিয়্যানা বায়ু দেহ থেকে বের হতে সময় নেয়। এই সময় কেবল মাত্র প্রাণ বা আত্মাকে পরবর্তী যাত্রার জন্য সাহায্য করা সম্ভব। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে এই সময় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালনের চেষ্ঠা করা হয়।

দেহের সাথে প্রাণের মিলনের নাম যেমন জন্ম; ঠিক তেমনি, দেহের সাথে প্রাণের বিচ্ছেদের নাম মৃত্যু। মিলন অর্থাৎ জন্ম যেমন আস্তে আস্তে সময় নিয়ে সম্পন্ন হয় একই ভাবে বিচ্ছেদ অর্থাৎ মৃত্যুও সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয়। দেহ থেকে প্রাণের বিচ্ছেদ এক সীমা অব্দি পেরিয়ে যাবার পর সেই প্রাণ আর দেহে ফিরিয়ে আনা যায় না। তখনই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ রূপে মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়। (তথ্যসূত্র: সৎগুরু রচিত বিখ্যাত বই: ডেথ থেকে সংগৃহিত)

একবার একজন বিখ্যাত ফিজিও থেরাপিষ্ট সাধু জনমেরী ভিয়ান্নীর কাছে আসলেন। তিনি সাধু জনমেরী ভিয়ান্নীকে বললেন, ফাদার আপনি তো একসাধু ব্যক্তি। দীর্ঘ দিন যাপন আপনি পবিত্র জীবন-যাপন করে আসছেন। আপনারতো ভাল মৃত্যু হবে এবং আপনি নিশ্চিত স্বর্গে যাবেন! কিন্তু আমি তো একজন পাপী মানুষ, বেশি ধর্মকর্ম করিনি, এখন কিভাবে আমার ভাল মৃত্যু হবে আর আমি স্বর্গে যেতে পারি।

সাধু জন মেরী ভিয়ান্নী উত্তরে সেই ফিজিও থেরাপিষ্টকে বলেছিলেন, “See, my children, to die well we must live well; to live well, we must seriously examine ourselves: every evening think over what we have done during the day; at the end of each week review what we have done during the week; at the end of each month review what we have done during the month; at the end of the year, what we have done during the year. By this means, my children, we cannot fail to correct ourselves, and to become fervent Christians in a short time. Then, when death comes, we are quite ready; we are happy to go to Heaven.

পবিত্র বাইবেলে মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা: পবিত্র বাইবেলে জুড়ে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক আলোচনা রয়েছে। মৃত্যু বিষয়টি যদিও কঠিন একটি বিষয় বা আবেগিক বিষয় তবুও এই কঠিন বিষয়টি পবিত্র বাইবেলে বেশ কয়েক জায়গায় উল্লেখ আছে। শোকার্তদের জন্য পবিত্র বাইবেল হল; আশা ও সান্ত্বনার উৎস। মৃত্যু সমন্ধে বাইবেলের অনেক বাণীর মধ্যে অন্যতম হল; “সব কিছুর জন্য একটা সময় আছে, আকাশের নীচে প্রত্যেকটি কাজেরই একটা নিদিষ্ট সময় আছে, আছে জন্মের সময় আছে মৃত্যুর সময়” (উপদেশক ৩:১-২)। মৃত্যু সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হল যোহন ১১:২৫-২৬ পদে যিশু বলেছেন, “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন। যে আমার উপর বিশ্বাস করে, সে মরলেও জীবিত থাকবে। আর যে জীবিত আছে এবং আমার উপর বিশ্বাস করে সে কখনো মারা যাবে না”। “আদমের সাথে সংযুক্ত বলে সকলের যেমন মৃত্যু হয়; তেমনি খ্রিস্টের সাথে সংযুক্ত বলেই সকলে তেমনি সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে” (১ করিন্থীয় ১৫:২১-২২) অতএব প্রভু যিশু খ্রিস্ট আমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে;  তাঁর প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমেই আমরা অনন্ত জীবন লাভ করতে পারব।

আধ্যাত্মিক মৃত্যু কি?

মৃত্যু হল একটি বিচ্ছেদ। শারীরিক মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছেদ ঘটে। আর আধ্যাত্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে আত্মার বিচ্ছেদ ঘটে। আদিপুস্তক ২: ১৭ পদে ঈশ্বর আদমকে এদেন বাগানের ভাল-মন্দ জ্ঞানের গাছটি থেকে ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আদম অবাধ্য হয়েছিলেন। আবার আদিপুস্তক ৩: ৮ পদে আদম ও হবা যখন ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন তখন ঈশ্বরের কাছ থেকে নিজেদেরকে তারা আড়াল করার চেষ্ঠা করেছিলেন। যার মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে তাদের বন্ধু ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারা আধ্যাত্মিকভাবে মৃত ছিল। খ্রিস্ট ছাড়া একজন মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে মৃত।

এফেসীয়দের কাছে পত্রে ৪:১৮ পদে সাধু পল বলেন; যারা ঐশ জীবন বা খ্রিস্টের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন তারা মৃত ব্যক্তির সমান। যারা নিজেদেরকে আদমের মত ঈশ্বরের কাছ থেকে আড়াল করে ও ঈশ্বরের অবাধ্য হয় তারা আধ্যাত্মিকভাবে মৃত। “তোমরা তো এক সময় নিজেদের পাপ ও অপরাধের ফলে মৃতই ছিলে” (এফেসীয় ২:১)। “কিন্তু ঈশ্বর তবুও খ্রিস্টের সঙ্গে তোমাদের সঞ্জিবিত করে তুলেছেন তিনি আমাদের সকল পাপ ক্ষমাই করেছেন” (কলসীয় ২:১৩)। শারীরিকভাবে মৃত লাজার জীবন দাতা খ্রিস্টের করুণাগুণেই আবার বেঁচে উঠেছিলেন। একইভাবে আমরাও আধ্যাত্মিকভাবে মৃত তবে যিশু নিজেই আমাদের উদ্ধার করবেন তবে আমার সৎ কর্মের জন্য নয়; নিতান্তই কৃপা করেই তিনি আমাদের পরিত্রাণ করবেন (তিত ৩:১)।

মৃত্যু যেমন বাস্তাব সত্য, স্বর্গ-নরকও তেমনি ধ্রুব সত্য। এ পৃথিবীতে জন্ম নিলেই মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়, চির বিদায়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়। তবে একজন খ্রিস্টভক্ত হিসেবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মৃত্যুই শেষ কথা নয়, মৃত্যুও পর রয়েছে অনন্ত জীবন যা কোনদিন শেষ হবার নয়। চিরদিন চিরকাল তা থাকবে। মৃত্যুও মধ্য দিয়ে ঈশ্বর আমাদের তাঁর কাছে ডাকেন। আত্মার সাথে পরম আত্মার মিলনের যে নিরন্তন আকাক্ষা, দেহত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা তার সেই অসীমতাকে অভিজ্ঞতা করতে সমর্থ হই।

আভিলার সাধ্বী তেরেজা ঈশ্বরের সাথে অনন্তকালীন মিলনের আকাঙ্খায় পূর্ণ আস্থা সহকারে বলেছিলেন, “আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই। তাঁকে দেখার জন্য আমাকে মরতেই হবে।” আবার লালন মধ্যে পরমাত্মার সাথে মিলনে এক গভীর আকাঙ্খা ছিল। তাই তো তিনি গান রচনা করে গেয়েছেন, “মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষেরও সনে”। মৃত্যু হল আমাদের পার্থিব যাত্রার তীর্থ পথে ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও দয়াপূর্ণ জীবনের পরিসমাপ্তি। দেহের সমাপ্তির হাত ধরেই শুরু হয় অনন্তকালীন জীবনের যাত্রা। অবিনশ্বর ক্ষয়হীন এক জীবনের জয় যাত্রা।

কেননা মৃত্যুর পর কোন পুনর্জন্ম নেই, আছে পুনরুত্থান। এজন্যই খ্রিস্টমণ্ডলি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে আমাদের প্রতিনিয়ত আহ্বান জানায়, যাতে খ্রিস্টের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যুতে অংশগ্রহণ করে, আমরা তাঁর পুনরুত্থানের অংশীদার হতে পারি। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমিই পুনরুত্থান, আমিই জীবন। যে আমার উপর বিশ্বাস রাখে এবং আমার দেহ ও রক্ত ভোজন ও পান করে শেষ দিনে আমি তাকে পুনর্জীবিত করে তুলব”। আর খ্রিস্টভক্ত হিসেবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও আশা করি যে, খ্রিস্ট যেমন মৃত্যুর পর প্রকৃত অর্থে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং অনন্তকাল জীবিত থাকবেন তেমনি আমরাও খ্রিস্টের মতোই, তারই সঙ্গে ও তারই মাধ্যমে পুনরুত্থিত হব এবং অনন্তকাল জীবিত থাকব।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ

১। সজল বন্দোপাধ্যায় ও খ্রীস্তিয়া মিঙ্গে, মঙ্গলবার্তা, জেভিয়ার প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৩।

২। হোক তব জয়গান, সম্পাদনায়; বিকাশ জেমস রিবেরু, সিএসসি, পবিত্র ক্রুশ সাধনাগৃহ, রামপুরা, ঢাকা, ২০০৮।

৩। Harper’s Bible Dictionary, ed. by Paul J. Achtemeier, Theological Publication in India, Bangalor, 2005.

৪।https://acatholiclife.blogspot.com/2006/08/on-death-by-st-john-vianney.html (11.11.2023)

৫। https://www.youtube.com/watch?v=rZbrw6cpYjY&t=14s (11.11.2023)

Please follow and like us: