ফাদার যোয়াকিম রবিন হেম্ব্রম

আজ আমরা পালন করছি মহান বিজয় দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বিজয় মহামূল্যবান। বিজয় মানুষকে স্বাধীন করে। আর স্বাধীনতা মানুষকে মুক্ত করে সকল সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধন হতে। আমাদের এই বিজয় একদিনে আসেনি। এ বিজয় বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও অধ্যাবসায়ের ফল। আমাদের এ বিজয় প্রতিটি মানুষের প্রচেষ্টা ও সাধনার ফল। অনেক মানুষের জীবনের বিনিময়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এদিনেই এদেশের মানুষের জীবনে এসেছে মুক্তি, জাতি লাভ করেছে বিজয়ের স্বাদ। এ বিজয় ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি, জাতীর প্রতি ভালবাসার ফল। আজ বাংলার মানুষ মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে এ আমার দেশ, এ আমার ভাষা, এ আমার পতাকা এবং এই আমার সপ্নের স্বাধীনতা। এ বিজয় আমাদের অহংকার। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি একটি সূর্য্য, একটি মুক্তি এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

স্বাধীনতার পটভূমি: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হয়ে বিজয়ের গৌরব অর্জন করে। কিন্তু এই মুক্তিলাভের আকাঙ্খা, এই বিজয়ের আকাঙ্খা বহু যুগের প্রত্যাশার। ব্রিটিশ শাসনের সূচনার মাধ্যমে বাঙালী পরাধীনতা বরণ করে নেয়। অন্যায়-অত্যাচার-লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে জাতি বহুবার সংগঠিত হয়েছিল এই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ লাভ করবে বলে। জাতি বার বার পরাজিত হয়েছে কিন্তু দমে যায়নি।

প্রায় ২০০ বছর ক্রীতদাস থাকার পরও স্বাধীনতার সপ্ন থেকে জাতি কখনো পিছু পা হয়নি। বহু সাধনার ফলে ব্রিটিশদের দেশত্যাগে বাধ্য করে এক বিজয়ের স্বপ্ন সূচনা করেছিল জাতি। কিন্তু এই সপ্নকেও কাল হাতে কষাঘাত করেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। শত বছরের চির যৌবনা বাঙালীকে, বাঙালা-ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে- হানাদার বাহিনী বারবার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপর হানা দেয়। ‘মাগো ওরা আর তোমাকে মা বলে ডাকতে দিবে না” ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। বল মা তা কি হয়’। তাইতো রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মান রক্ষা করেছে আমাদের দামাল ছেলেরা। এই রক্ত মূল্যেই ২১শে ফেরুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান নিরস্কুশ জয় লাভ, ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে  মার্শাল ল-জারী করা, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণ-আন্দোলন, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের গণ- অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সংগ্রাম আমাদের বিজয়ের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালীর উপর নির্বিচারে গণ হত্যা চালায়। একের পর এক পরিবার-গ্রাম ও এলাকাকে পুড়ে ছাই করে দেয়। বাঙালীর এই ক্রান্তিকালে সর্ব যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর নেতৃত্ব জাতি পেয়েছে এক অন্ধকার জগতে আলোর সন্ধান। মৃত্যুর মধ্যে লাভ করেছে নতুন জীবন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা আজকের এই বিজয় অর্জন করেছি। এই বিজয় আমাদের সাধনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

কিন্তু বিজয়ের এই ইতিহাসকে আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছি। মানুষ হিসেবে একে অন্যকে ভালবাসা যেমন মৌলিক দায়িত্ব তেমনি দেশকে ভালবাসাও একটি পবিত্র দায়িত্ব। ভালবাসাহীনতাই একটি জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থই বেশি প্রবল আকারে দেখা যাচ্ছে। ফলে মানুষকে আর মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। আমাদের এই পবিত্র দেশকে আমরা নানাভাবে অপবিত্র করে তুলেছি। এ কি ছিল মুক্তি উদ্দেশ্য? এ কি ছিল বিজয়ের প্রত্যাশা?

তাই আসুন, সকলে একত্রে- অজ্ঞতা থেকে, মন্দতা থেকে, হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে, দুর্নীতি, ঘুষ, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু মানুষের উপর নির্যাতন ও সকল প্রকার অন্ধকারের কাজ থেকে দেশকে মুক্ত করি। আমাদের দেশের সাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রচার করি, তাদেরকে দেশকে ভালবাসতে অনুপ্রাণিত করি। তখনই থাকবেনা কোন পরাধীনতা। তখন শুধু হবে; এক দেশ-এক জাতি, এক সত্ত্বা, এক মাটি ও মানুষ। তাই আসুন বিজয়ের চেতনায় আমরা সকলে অনুপ্রাণিত হই। আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হই। তবেই বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ আমরা লাভ করতে পারব। বাংলাদেশের জয় হোক।।

Please follow and like us: