ফাদার সুনীল রোজারিও । বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি
সাধারণ অর্থে শিক্ষা হলো- ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে উন্মোচিত ও পরিচালিত হওয়া। বৃহৎ অর্থে শিক্ষা হলো ‘সর্বজনীন’। এই সর্বজনীন শিক্ষা কোনো কাল, কোনো সীমানা ও কোনো জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সর্বজনীন শিক্ষা হলো- জীবনব্যাপী শিক্ষা। সক্রেটিস বলেছেন, “শিক্ষা হলো- সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত-বৈধ ধারণার উন্মোচনকরণ- যেগুলো মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকে।”
বৃহৎ অর্থে শিক্ষার গুরুত্ব বরাবরই ইতিবাচক, তবে বিশেষ অর্থে ধর্মশিক্ষার গুরুত্ব ভিন্ন কারণ ধর্মশিক্ষা ঈশ্বর বিশ্বাস, সত্যের অনুসন্ধান, জীবন ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, পরবর্তী জীবন, ভালো-মন্দ, বিভিন্ন মূল্যবোধ- যেমন: ন্যায্যতা, সত্যবাদিতা, নৈতিকতা, ইত্যাদি সম্পর্কে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন সাধন করে। আধ্যাত্মিক জীবন গঠনে ধর্মশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এই দিকটা বিবেচনা করে বাংলাদেশের শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে, “ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে পরিচিতি, আচরণগত উৎকর্ষসাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি ও চরিত্র গঠন।”
শিক্ষানীতিতে খ্রিস্টধর্ম শিক্ষার ব্যাপারে বলা হয়েছে-
১। যিশুর জীবন, কাজ ও শিক্ষার মধ্যদিয়ে জীবনের পূর্ণতা লাভের পথ ও পরামর্শ এবং নির্দেশনা প্রদান করা হবে।
২। খ্রিস্ট ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়া, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে।
৩। শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ জীবন-যাপন করা এবং অন্যদের সুস্থ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবন-যাপনে সাহায্য করতে শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে তৈরি করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়া হবে।
৪। শিক্ষার্থীর চরিত্রে মহৎ গুণাবলি অর্জন, সৎ সাহস ও দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধকরণ এবং শিক্ষার্থীকে সামাজিক ও জাতীয় চেতনায় নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে।
ক। পরিবার : এতে করে বোঝা যায় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা ঐচ্ছিক বিষয় নয়। তবে সন্তান বিদ্যালয়ের আগে পরিবারের। পরিবার যদি প্রাথমিক পাঠশালা হয়ে থাকে তাহলে ধর্মের প্রথম পাঠটা সন্তানগণ পরিবার থেকে লাভ করার কথা। যেমন- নিয়মিত প্রার্থনা, বড়দের আদর্শ, পরিবারের ঐতিহ্য, পরিবারের পরিবেশ, কথাবার্তার ধরন, সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক, পরিবারে নানাবিধ অনুশীলন- এই বিষয়গুলো সন্তানকে মানসিকভাবে তৈরি করে। মনে রাখতে হবে, পরিবার যেমন সন্তান হবে তেমন। সাধু পৌল বলেছেন, “তোমরা, পিতারা, তোমাদের সন্তানদের রাগিয়ে তুলো না, বরং প্রভুরই শিক্ষা ও শাসনের আদর্শে তাদের মানুষ ক’রে তোল” (এফেসীয় ৬:৪)।
সন্তানগণ মা-বাবার সবচেয়ে আপন এবং সন্তানদের কাছে মা-বাবা সবচেয়ে আপন। তাহলে এই অভিযোগটা কেনো আসে যে, সন্তান কথা শোনে না। সন্তানগণ যখন পিতা-মাতাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় আদর্শ খুঁজে না পায়, তাহলে বয়ে যাবে। উভয়ের মধ্যে খোলামেলা সম্পর্ক, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ থাকতে হবে। তা না হলে সন্তানগণ নিজের সমস্যার কথা পিতা মাতাকে না বলে তার মতো সমস্যাগ্রস্থ বন্ধুর সঙ্গে সহভাগিতা করবে। মনে রাখতে হবে, সন্তানগণ হলো পরিবারের এ্যাসেট- এখানে বিনিয়োগ যতো বেশি হবে, লাভ ততো উত্তম হবে। মনে রাখতে হবে, বালুভর্তি ঘটি-বাটি থেকে ভবিষ্যতে কখনোই সোনা-দানা বের হয়ে আসবে না।
খ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে- ধর্মীয় আদর্শ যেনো অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ের উপর প্রভাব রাখতে পারে। এর পর দেখতে হবে, পরিবারে যে সব শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়, সেই শিক্ষাগুলো দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে নিতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা খণ্ডকালীন বিষয় নয়। বাংলা, ইংরেজির মতো নিয়মিত ক্লাস থাকতে হবে। ধর্ম শিক্ষককে হতে হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পেশা হিসেবে ডিগ্রিধারি। যাকে তাকে দিয়ে এই দায়িত্ব পালন কার্যকর নয়। ধর্মশিক্ষার জন্য বাইবেলের আলোকে শ্রেণিভিত্তিক থাকতে হবে একটা পাঠ্যসূচি। বাইবেলের সুনির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ছাড়ারও আজকের বাস্তবতায় বিশ্ব মণ্ডলি, চার্চের পিতৃগণ কী বলছেন- সেসব বিষয়ের উপরও আলোকপাত করতে হবে। এর পর শিক্ষা বছর শেষে অন্যান্য বিষয়ের মতো সমমানে পরীক্ষা ও সমমানে মার্ক বন্টন থাকতে হবে। তবে এখানে একটা বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে যে, ছাত্ররা তাদের আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের দরজা বন্ধ রেখে শুধু পাশের জন্য যেনো ধর্মশিক্ষা গ্রহণ না করে। আজকাল ছাত্ররা ধর্মশিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে মনে করে। অর্থাৎ মানের দিকদিয়ে অন্যান্য বিষয় থেকে নিচে ধর্মের অবস্থান।
গ। চার্চ বা মণ্ডলি : পরিবারে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষার যে পাঠগুলো দেওয়া সম্ভব নয়- সেই পাঠগুলো দেওয়ার সযোগ থাকতে হবে গির্জা চত্বরে। বিষয়গুলো নিম্নরূপ হতে পারে-
১। যারা বাইরের স্কুলে লেখাপড়া করে তাদের জন্য গির্জা চত্বরে সাপ্তাহিক ধর্মশিক্ষা ব্যবস্থা;
২। প্রাথমিক, হাইস্কুল-কলেজ এবং বয়স্কদের জন্য বাইবেল কুইজ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করা;
৩। শিক্ষার্থীদের জন্য সাপ্তাহিক খ্রিস্টযাগের ব্যবস্থা করা;
৪। গির্জা চত্বরে খ্রিস্টীয় সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করা;
৫। খ্রিস্টযাগে সাহায্যের জন্য সেবক শিক্ষার ব্যবস্থা করা;
৬। খ্রিস্টযাগে বাইবেল (পত্র) পাঠের জন্য অনুশীলন করা;
৭। বাৎসরিক নির্জন ধ্যানের ব্যবস্থা করা;
৮। বিভিন্ন সংঘ-সমিতির বৈঠক নিয়মিতকরণএবং বৈঠকে যাজক, সিস্টারেদের উপস্থিত থাকা, ইত্যাদি।
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো আজকের জন্য নতুন কিছু নয়। এগুলো এক সময় প্রচলিত ছিলো- কিন্তু এখন নানা অজুহাতে ঐতিহ্যটা প্রচলিত নেই। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে মণ্ডলির প্রথম কাজ হলো জনগণের মধ্যে আধ্যাত্মিক জীবন গঠন করা।
প্রকৃত শিক্ষা মানে জ্ঞানী হয়ে ওঠা। ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো- মানুষ যেনো অন্তরে জ্ঞানী হয়ে উঠে এবং ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানব সমাজকে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং সৃষ্টির মধ্যে আরো সৃষ্টি করে। আমি যদি সৃষ্টি করতে না পারি, সাধু টমাস আকুইনাস বলেছেন, “তোমার জন্য স্বর্গের দরজা বন্ধ থাকবে।” আধ্যাত্মিক জ্ঞানী সে, যে সৃষ্টি করতে পারেন। মানুষের মধ্যে যে সামর্থ, প্রতিভা রয়েছে, ধর্মশিক্ষা সেটাকে সর্বাধিক ব্যবহারে সহায়তা ক’রে প্রাণে সংস্কার সাধন করে। ধর্মশিক্ষার প্রধান কাজ হলো, শিখার জন্য সুযোগ ও ইচ্ছাকে রোপন করা- যেনো অনবরত বেড়ে ওঠে ফলশালী হয়। প্রকৃত শিক্ষা হলো একটি আধ্যাত্মিক আহ্বান- এবং ঈশ্বরের জনগণ হয়ে উঠা। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।