ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি
কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকেই এই ডিভাইসটি খুব দ্রুত নানা কাজের সহায়ক হয়ে উঠছে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে যখন বিশ্লেষণধর্মী ডিজিটাল কম্পিউটার আবিষ্কার হয়, তখন থেকে এর পারদর্শিতা ও কাজের পরিধি আরো বাড়তে থাকে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আলেন টার্নিং নামের একজন বৃটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানীর “Computing Machinery and Intelligence ” শিরোনামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক ধারণা সম্বলিত একটি গবেষণা পত্র “Mind” নামক একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু হয়। গবেষণা পত্রের মূল বিষয় ছিলো- যন্ত্রের স্বয়ংক্রীয় আচরণ সম্ভাবনা। গবেষণার শুরুতেই ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই ভবিষ্যৎ যন্ত্রের নামকরণ করা হয় Artificial Intelligence বা “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।” পরের বছর নিউ হাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ডার্টমউথ কলেজে একদল গবেষক দুই মাস ধরে এক কর্মশালায় কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। সেই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানামুখী গবেষণা। আজকের Artificial Intelligence বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নানা গবেষণার বাস্তব অবস্থান।
বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম এবং তার নেতাগণ বর্তমান প্রযুক্তি এবং ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত নৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলতে চান, প্রযুক্তির ক্রমবর্ধনশীল উন্নয়ন স্বাভাবিক কিন্তু তার কারণে মানুষের মধ্যে নৈতিক অধঃপতণ ও অবক্ষয় যেন না ঘটে। এইসব প্রযুক্তির মধ্যে সাম্প্রতিককালের “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” (Artificial Intelligence) যেভাবে মানুষের কার্যকলাপ, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে- তা তাঁদের মতে, “সমন্বিত মানব উন্নয়ন” ত্বরান্বিত করার বিরুদ্ধ আচরণ। যদি যন্ত্রই মানুষকে সব বলে দিবে তাহলে ঈশ্বর কেন মানুষকে প্রতিভা দিয়েছেন। মানুষের প্রতিভা সম্পর্কে পবিত্র বাইবেল কী বলে- “ঐশ আত্মাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেককে দেওয়া হয় সকলেরই মঙ্গলের জন্য। একজনকে পবিত্র আত্মা দান করেন প্রজ্ঞার ভাষা, আর একজনকে সেই পবিত্র আত্মাই দান করেন ধর্মজ্ঞানের ভাষা, আর একজন সেই আত্মাই দান করেন পরম বিশ্বাস। কাউকে আবার একই আত্মা দান করেন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা। অন্য কাউকে নানা অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা, অন্য একজনকে প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা আত্মিক শক্তির স্বরূপ বিচার করার ক্ষমতা। অন্য কাউকে নানা অজ্ঞাত ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা। অন্য কাউকে আবার সেই ভাষা বুঝিয়ে দেবার ক্ষমতা। কিন্তু এই সমস্ত কিছুই সেই এক অদ্বিতীয় আত্মার কাজ। তাঁর আপন ইচ্ছ মতো যিনি এক একজনকে এক এক বিশেষ শক্তি দিয়ে থাকেন (১ম করিন্থীয় ১২:৭-১১)”। বাইবেলের ভাষায়, ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে যার যার মতো করে প্রতিভা দিয়েছেন- সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু এই সৃষ্টি যেন হয় মানুষের কল্যাণের জন্য এবং সৃষ্টি যেন কিছুতেই নৈতিকতাকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে না দেয়। সুতরাং প্রযুক্তির ভূমিকা হবে মানবজাতির কল্যাণ ও উৎকর্ষসাধন- নৈতিকতা বর্জন নয়, আধ্যাত্মিকতার বিনাশ নয়।
ঈশ্বর বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি ক’রে মানুষের হাতে তা তুলে দিয়েছেন, যেন মানুষ তাঁর সৃষ্টিকে আরো সুন্দর করতে পারেন। বিশ্ব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হলেন উত্তম। “ঈশ্বর বলিলেন, তোমরা ফলবান ও বহুবংশ হও এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভূত কর” (আদি ১:১৮)। “বশীভূত” করার অর্থ এই নয় যে, মানুষের ধারণার মধ্যে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বদলে দেওয়া, নৈতিকতা ও পাপের ধারণা (Notion of Sin) বদলে দেওয়া। যন্ত্র যদি মানুষের মতো আচরণ করে তাহলে নতুন প্রজন্ম যন্ত্রের আচরণের মধ্যে বেড়ে উঠবে। যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে ? নাকি ঈশ্বরের সঙ্গে নতুন করে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হবে ? গত মার্চ মাসের ২৭ তারিখে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের নামকরা প্রযুক্তি ইনডাস্ট্রি কর্মকর্তা, ধর্মীয় নেতা ও থিওলজিয়ানদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই প্রশ্নগুলো রেখেছেন। পোপ তাঁদের বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত আগমন সরাসরি মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে। পোপ ফ্রান্সিস প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রশংসা করে বলেন, “প্রযুক্তির উন্নয়ন যেন বিশ্বে ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপনে সহায়ক হয়”। পোপ আরো বলেন, “নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন করার পূর্বে অবশ্যই মূল্যায়ন করে দেখতে হবে, তাতে নারী-পুরুষের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে কিনা”। বৈঠক শেষে ক্যাথলিক, ইহুদি এবং মুসলিম নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর ক’রে গবেষকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তারা যেন “নৈতিক অবকাঠামোর মধ্যে প্রযুক্তি” সীমাবদ্ধ রাখেন। গত আগস্টের ৮ তারিখে ভাটিকান থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা ও ব্যবহারের মধ্যে দায়িত্বশীল হতে হবে, যেন এগুলো মানবতার সেবায়, ধরিত্রী রক্ষা, নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় বিধান নিশ্চিত করে”। সুতরাং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হবে “বিশ্বে ন্যায্যতা ও শান্তি” স্থাপনে সহযোগিতা করা। চলতি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারির বিশ্ব শান্তি দিবস উপলক্ষে পোপ যে বাণী দিয়েছেন তার মূল বিষয় ছিল “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং শান্তি।” পোপ বিশ্ব শান্তি দিবসের বাণীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ও অনৈতিক দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।
ভাটিকান সংবাদ সংস্থা অন্য একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ৫৮তম বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগ দিবসে পোপের বাণীর মূল বিষয় হবে, “কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা ও হৃদয়ের প্রজ্ঞা: পরিপূর্ণ মানবীয় যোগাযোগের জন্য”। যা ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়- মানুষের হৃদয়ে রেখে দেওয়া ঈশ্বরের জ্ঞান দিয়ে মানুষের মধ্যে যে জ্ঞানের প্রসার ঘটছে, তা যেন হয় মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে, যেন মানবিক নৈতিকতার সীমা অতিক্রম না করে। বার্তায় বলা হয়েছে যে, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ বিবর্তন পদ্ধতি যন্ত্রের দ্বারা ও যন্ত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো স্বাভাবিক করে তুলছে, যার কারণে যন্ত্রের তৈরি চিন্তা, ভাষা ও মানুষের তৈরি ভাষার পার্থক্য নির্ণয় করা ক্রমবর্ধমানভাবে কঠিন হয়ে উঠছে”। মনে হচ্ছে, মানুষের যোগ্যতাকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে যন্ত্রের যোগ্যতা। মানুষ সামাজিক জীব, তাই কোন ভাবেই উচিৎ হবে না- যন্ত্র দিয়ে মানুষকে একাকীত্ব ক’রে তোলা। একটি স্কুলে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে ভেবে দেখুন সেই যন্ত্রের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক কেমন হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা আর যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা এক হবার নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থাটা শুধু বার্তা ও তথ্যের আদান প্রদান নয়- কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া ও তাতে ক’রে বেড়ে উঠা। মানুষের উপর যন্ত্রের কর্তৃত্ব নয় কিন্তু যন্ত্রের উপর থাকতে হবে মানুষের কর্তৃত্ব।
আর একটি নৈতিক প্রশ্ন হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কী ব্যাহত হবে? সংশয়টা এখানেই, জ্ঞান উন্নয়নের যে স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান- তার তাগিদ থেকে মানুষ সরে যাবে। ফলে জ্ঞান চর্চার বিবর্তন থেমে যাবে আর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি ভাষা, ইংগীত ও উচ্চারণ কখনোই মানুষের ভাষা, ইংগীত ও উচ্চারণের সমকক্ষ হতে পারে না। তবুও বিদ্যালয়ের কৃত্রিম শিক্ষক যে ভাষা, ইংগীত, উচ্চারণ-আচরণ করবে- ছাত্ররা তাই অনুকরণ করবে। এটা হয়ে দাঁড়াতে পারে মানুষকে অপসারণ করে সেখানে যন্ত্র স্থান করে নেওয়া। প্রশ্নবাক্যে যন্ত্র যখন সঠিক আচরণ করার জন্য সচেতন হয়ে ওঠে, তখন মানুষের মধ্যকার মানবিক গুণ স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে, অবক্ষয় হতে পারে নৈতিকতার। অন্যদিকে মানুষের গোপনীয়তাও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। কারণ মেশিনের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলোর বিশ্লেষণের ক্ষমতা দিন দিন তীব্র হয়ে ওঠছে। যে বিশ্লেষণ থেকে মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ বাদ যাবে না।
সুতরাং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সীমা অতিক্রম করার আগেই কিছু সর্বজনীন পদক্ষেপ নিতে হবে যেন মানব সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতে না পরে। প্রথমত: গবেষকদের দায়িত্ব নিয়ে এগুতে হবে- যেন যান্ত্রিক উন্নয়ন মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। আর সমান্তরালভাবে দেখতে হবে- মানুষের বাক্যের চেয়ে যন্ত্রের মাদকীয় বাক্যের প্রতি মানুষের ভালোবাসা যেন চরমে না উঠে।