তপস্যাকাল উপলক্ষে পোপের বাণী- ২০২৪

ভাষান্তর : ফা. সুনীল রোজারিও, বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি। 

স্নেহের ভাই ও বোনেরা,

ঈশ্বর যখন নিজেকে প্রকাশ করেন, তখন তাঁর বার্তা সর্বদাই আমাদের জন্য মুক্তির : “আমি তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু, যিনি মিসর দেশ হ’তে, দাস-গৃহ হ’তে তোমাকে বের ক’রে এনেছি (যাত্রা ২০:২)।” এটা ছিলো সিনাই পর্বতে মোশীকে দেওয়া ঈশ্বরের প্রথম বার্তা। যারা সে সব শুনেছে তাদের কাছে ঈশ্বরের প্রকাশিত যাত্রার বার্তা ছিলো সুপরিচিত: তাদের দাসত্বের অভিজ্ঞতা ছিলো তখনোও ভারী। মরুভূমিতে তারা পেয়েছিলো “দশটি বাক্য” যা তাদের জন্য ছিলো মুক্তির পথ। আমরা যাকে বলি “আজ্ঞা” যার মধ্যদিয়ে জোর দেওয়া হয় মানুষকে গঠিত করার জন্য ঈশ্বরের ভালোবাসার শক্তিকে। মুক্তির আহ্বান একটি দাবি- তবে যার উত্তর সরাসরি দেওয়া হয়নি বরং যাত্রার মধ্যদিয়ে যার পরিপক্কতা আসবে। ঠিক যেমন ইস্রায়েল জাতি মিসরের প্রতি আসক্ত ছিলো, অতীতকে ফিরে চাইতো এবং মরুভূমিতে ঈশ্বর ও মোশীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ একাশ করতো- ঠিক তেমনি ঈশ্বরের জনগণ অতীতের নির্যাতিত দাসত্বে আজোও মন ফিরায়- যা পিছনে ফেলে আসার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। সেই সময়ের এই সত্য আমাদের অনুধাবন করতে হবে, সেই আশাহত সময়, মরুভূমিতে জীবন যাপন এবং গন্তব্যে যখন প্রতিশ্রুত ভূমি অনুপস্থিত ছিলো। তপস্যাকাল হলো অনুগ্রহের কাল যেখানে মরুভূমি হয়ে উঠতে পারে- প্রবক্তা হোসেয়া’র ভাষায়, ঈশ্বর তাঁর জনগণকে গঠন করেন, তিনি আমাদের দাসত্ব পিছনে ফেলে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান লাভের অভিজ্ঞতা দান করেন। ঠিক যেনো বরের মতো, ঈশ্বর আমাদের তাঁর দিকে আকর্ষন করেন এবং মৃদুস্বরে অন্তরে ভালোবাসার কথা বলেন।

দাসত্ব থেকে নিস্তারের উদ্দেশ্যে যাত্রা আলাদা কোনো বিষয নয়। আমরা যদি আমাদের তপস্যাকাল ফলপ্রসূ করতে চাই তাহলে প্রথম কাজ হবে বাস্তবতার দিকে আমাদের চোখ খোলার ইচ্ছা প্রকাশ করা। ঈশ্বর যখন জলন্ত ঝোপের পাশ থেকে মোশীকে ডাকালেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তিনি প্রকাশ করলেন যে, তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে শুনেন, “পরে সদাপ্রভু বললেন, সত্যই আমি মিসরে আপন প্রজাদের কষ্ট দেখেছি এবং শাসকদের সামনে তাদের ক্রন্দনও শুনেছি। আসলে আমি তাদের দুঃখ জানি। আর মিস্ত্রীয়দের কবল থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য এবং সেই দেশ হ’তে তাদের তুলে নিয়ে উত্তম ও বৃহৎ দেশে অর্থাৎ সেই দুগ্ধ মধু প্রবাহিত দেশে তাদের স্থাপন করবো (যাত্রা ৩:৭-৮)।” আজকেও নির্যাতিত বহু ভাই বোনের কান্না স্বর্গে উঠে আসছে। এসো আমরা নিজেদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি সেই কান্না শুনতে পাই ? তা কি আমাদের কষ্ট দেয় ? তা কি আমদের নাড়া দেয় ? এগুলো আমাদের একে অন্যজন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, ভ্রাতৃত্ব বোধ অস্বীকার করে- যা শুরুতে আমাদের এক বন্ধনে রেখেছিলো।

আমার লাম্পেদুসা সফরের সময় বিশ্বায়নে আমার অনীহা সত্বেও আমি নিজেকে চাপে রাখা দু’টি প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি কোথায় (আদি ৩:৯)” এবং “তোমার ভাই কোথায় (আদি ৪:৯)।” আমাদের তপস্যাকালীন যাত্রা উপযুক্ত হবে যদি আমরা এই দু’টি প্রশ্ন শুনি এবং অনুভব করি যে আজকের দিনেও আমরা ফারাঁওন রাজার অধীনে আছি। এ শাসন যা আমাদের মধ্যে ক্লান্তি ও অনীহা তৈরি করে। এটা একটা অগ্রসরমান শর্ত যা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে এবং ভবিষ্যতকে আটকে রাখে। পৃথিবী, বাতাস এবং জল দূষিত এবং আমাদের হৃদয়ও। সত্যিকার অর্থে, দীক্ষাস্নান আমাদের মুক্তির ধারায় আনলেও আমাদের মধ্যে ব্যাখ্যাহীনভাবে দাসত্বের আবেদন রয়েছে। যেনো পরিচিত বিষয়ের উপর নিরাপত্তার আকর্ষন, যা আমাদের স্বাধীনতার ক্ষতি সাধন করে।

যাত্রা পথে একটি চমৎকার ব্যাখ্যা হলো : ঈশ্বর যিনি দেখেন, জাগান এবং স্বাধীনতা আনেন- ইস্রায়েল জাতি যা তাঁর থেকে চাননি। ফাঁরাওনের স্বপ্ন ছিলো কষ্টের, যিনি স্বর্গের ধারণা ঢেকে রেখে এই বিশ্ব, যেখানে মানব মর্যাদা রয়েছে ঢাকা, যেখানে মৌলিক বন্ধন অস্বীকার করা হয়- যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে নিজের মধ্যেই সবকিছু দাসত্ব করে রাখে। এসো আমরা নিজেদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি একটা নতুন বিশ্ব চাই ? আমি কি প্রস্তুত আছি অতীতের সঙ্গে আপোষ ত্যাগ করতে ? আমার অনেক ভাই বিশপ এবং যারা শান্তি ও ন্যায্যতার জন্য কাজ করছেন, তারা আমাকে আশস্ত করতে চান এই বলে যে, আমাদের আশাহীন ও কষ্টের স্বপ্নগুলো এবং সব নীরব কান্না যা স্বর্গে গিয়ে পৌঁছে এবং ঈশ্বরের হৃদয়কে নাড়া দেয়- সে সব  বাঁধা বন্ধ করতে হবে। এই “ন্যূন আশা” ইস্রায়েল জাতির দাসত্বের গৃহকাতরতার মতো নয় যা তাদের মরুভুমিতে অথর্ব ক’রে সামনে অগ্রসরকে রোধ করেছিলো। যাত্রা বাধাপ্রাপ্ত হ’তে পারে : যার ব্যাখ্যা হতে পারে বাস্তব মানবতা যা এসেছিলো সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের দ্বারপ্রান্তে এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, বিচার কাজের উন্নয়ন, যার সামর্থ ছিলো সব মানুষের মর্যাদা নিশ্চিতকরণ, যা ছিলো অসমতার অন্ধকারে হাতড়ে ফেরা।

ঈশ্বর আমাদের মধ্যে ক্লান্তি আনতে চান না। আসুন আমরা তপস্যাকালকে একটা বড় সময়কাল হিসেবে অভিনন্দন জানাই, যে কাল আমাদের স্মরণ করে দেয়, “আমি তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু, যিনি মিসর দেশ থেকে, দাস-গৃহ থেকে তোমাকে বের করে এনেছি (যাত্রা ২০:২)।” তপস্যাকাল হলো মন পরিবর্তনের সময়, একটি নিস্তারের সময়কাল। আমরা যেমন প্রতি বছর তপস্যাকালের প্রথম রোববার স্মরণ করি যে, যিশু আত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়ে মরুভূমিতে গিয়েছিলেন এবং পাপের প্রলোভনে পড়েছিলেন। মানব দেহধারি খ্রিস্ট এখন চল্লিশদিন ধরে আমাদের সামনে উপস্থিত থাকবেন। ফাঁরাওন রাজের মতো ঈশ্বর আমাদের তাঁর প্রজা হিসেবে দেখতে চান না- কিন্তু দেখতে চান পুত্র-কন্যা হিসেবে। মরুভূমি হলো আমাদের জন্য পরিপক্ক হওয়ার জায়গা- তবে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে পুনরায় দাসত্বে পতিত হওয়া নয়। তপস্যাকালে আমরা পাই ন্যায্যতা ও সামাজিকতার নতুন আদর্শ- যা আমাদের একটি রাস্তায় অগ্রসর হতে বাধ্য করবে, যে রাস্তায় কখনো যাওয়া হয়নি।

যদিও এসব কষ্টসাধ্য, যেমন যাত্রা পুস্তক এবং মরুভূমিতে যিশুর পরীক্ষা যা আমাদের এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা দেয়। ঈশ্বরের কন্ঠে ধ্বনিত হলো, “তুমি আমার আপন পুত্র, পরম প্রীতিভাজন (মার্ক ১:১১)” এবং “আমার সাক্ষাতে তোমার অন্য দেবতা না থাকুক (যাত্রা ২০:৩)” যা মিথ্যার দ্বারা শত্রুগণ বিরোধীতা করেছিলো। এমনকি ফাঁরাওন রাজের চেয়েও ভয়াবহ নমুনা হতে পারে যখন আমরা মনে করি ফাঁরাওনের কন্ঠস্বর আমাদের মধ্যে কথা বলছে। সর্বময় ক্ষমতা, সর্বজনকর্তৃক নিরীক্ষা, অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার, প্রতিটি মানব ব্যক্তি অনুধাবন করতে সামর্থ, কতো গভীর এই প্রলুব্ধকরণ, এই মিথ্যা। এই রাস্তাগুলো ভ্রমনের জন্য এটা খুব সরল। আমরা অর্থের মধ্যে যুক্ত হয়ে থাকতে পাারি, কোনো কর্ম পরিকল্পনা, কোনো ধারণা বা গন্তব্য, আমাদের অবস্থান, ঐতিহ্যের দিকে, এমনকি কোনো বিশেষ ব্যক্তির দিকেও। এগুলো আমাদের সামনের দিকে পরিচালিত না করে নির্জীব করে দেয়। গ্রহণ করার পরিবর্তে সংঘর্ষ তৈরি করে। তার পরেও নতুন মানবতা হলো- যারা দীনজন, যারা সরল, যারা নিজেদের মধ্যে মিথ্যা পরিচর্যা করেনি, “তাদের প্রতিমা রূপা ও স্বর্ণ, তা মানুষের হাতে তৈরি। মুখ থাকতেও তারা কথা বলে না, তারা বোবা, অন্ধ, মূক এবং স্থবির (সাম ১১৪:৪-৫)।” অন্যদিকে নম্র আত্মা সব সময় উন্মুক্ত এবং সচল: উত্তমের নীরব শক্তি যা বিশ্বকে নিরাময় ও টেকসই করে।

তপস্যাকাল কর্মের সময় এবং এই কর্ম হলো নীরবতা। এই নীরবতা হলো প্রার্থনা যেনো ঈশ্বরের বাক্য অনুধাবন করতে পারি, এই নীরবতা হলো আহত ভাই-বোনদের মধ্যে সামারীয়। ঈশ্বরকে ভালোবাসা আর প্রতিবেশীকে ভালোবাসা এক কথা। আমাদের প্রতিবেশীর বাইরে নীরবতায় ঈশ্বরের সাক্ষাতে আরো কোনো দেবতা যেনো না থাকে। সেই জন্য প্রার্থনা, দান ও উপোস- এই তিনটি আলাদা কোনো কর্ম নয় কিন্তু নিজেকে পাপশূন্য করার জন্য একটি কর্ম, যার মধ্যদিয়ে আমাদের ভারী করে রাখা অলীক দেবতাকে বিসর্জন দেই- যেগুলোর সংস্পর্শে আমরা বন্দি হয়ে ছিলাম। তাহলেই আমাদের দেহ ও হৃদয় জাগ্রত হবে। এই নীরবতা ধীরতা তপস্যকালে আমাদের জীবনের ধ্যানময়তা ও নতুন শক্তি আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে ভাই-বোন হিসেবে আমরা একে অন্যের প্রতি আরোও  সোচ্চার হই : হুমকী ও শত্রুর সাক্ষাতে যাত্রা পথে আমাদের সাথীকে আবিষ্কার করি। এটাই হলো ঈশ্বরের স্বপ্ন যে, আমরা আমাদের দাসত্বকে পিছনে ফেলে প্রতিশ্রুত ভূমির দিকে যাত্রা করি।

মণ্ডলির সিনোডাল অবয়ব, যা বছরগুলোতে আমরা পুণ:আবিষ্কার ও পরিচর্যা করছি- তা আমাদের পরামর্শ দেয় যে, তপস্যাকাল হলো একটি সামাজিক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্ত ছোটো বা বড় তা গ্রহণযোগ্য। সিদ্ধান্তের শক্তি রয়েছে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন ও প্রতিবেশীর জীবন বদলে দেওয়ার, ঠিক যেমনভাবে আমরা জিনিসপত্র গ্রহণ করি, প্রকৃতিকে যত্ন করি এবং যারা দৃষ্টির বাইরে এবং নিজেদের মধ্যে তলিয়ে আছে তাদের কাছে আনি। আমি প্রত্যেক খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে এসব করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি : তারা যেনো তাদের সদস্যদের জীবন ধারণ নিয়ে চিন্তা করে, সমাজে তাদের উপস্থিতি নিয়ে পরীক্ষা করে এবং সমাজকে আরো উন্নত করার জন্য তাদের অবদান নিয়ে চিন্তা করে। আমাদের অনুশোচনা এমন হতে হবে না, যা যিশু পরিত্যাগ করেছেন। আমাদেরকে যিশু বলেছেন, “তোমরা যখন উপোস কর তখন ভণ্ডদের মতো বিষন্ন ভাব দেখিয়ো না। তা যে উপোস করছে সেটা লোকদের দেখাবার জন্যই তো তারা মুখখানা অমন শুকনো করে রাখে (মথি ৬:১৬)।” তার পরিবর্তে অন্যে তোমার উজ্জ্বল মুখখানা দেখুক, যেখানে স্বাধীনতা ফুটে উঠবে।  ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করো- যা সবকিছু নতুন করে তোলে। এগুলো শুরু করো ছোটোদের দিয়ে এবং যারা আমাদের নিকটে রয়েছে তাদের মধ্যে। এ কাজগুলো সম্পন্ন হতে পারে আমাদের প্রতিটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যদিয়ে।

তপস্যাকাল হলো পরিবর্তনের একটি সময়, হতাশাগ্রস্থ মানব সমাজ দেখবে নতুনত্বের আর্বিভাব, একটি নব আশার উজ্জ্বলতা। গত গ্রিস্মে লিসবন শহরে আমি যুবকদের বলেছিলাম, “অন্বেষণ অব্যাহত রাখো এবং ঝুঁকি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো। কালের এই মুহুর্তে আমরা বহু ঝুঁকির মোকাবিলা করছি, আমরা বহু মানুষের কান্না জড়িত আবেদন শুনতে পাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা যেনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের খন্ড খন্ড বাস্তবতার অভিজ্ঞতা করছি। তবুও এসো আমরা সাহসের সঙ্গে বিশ্বকে দেখি, মত্যুর তীব্র যন্ত্রণা নয় কিন্তু নতুন করে জন্মের পরিকল্পনা নিয়ে, শেষ নয় কিন্তু ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা দিয়ে। আমাদের এ ভাবে চিন্তা করার সাহস দরকার।” এটা হলো পরিবর্তনের সাহস, দাসত্ব থেকে জীবনলাভ। বিশ্বাস ও দয়া দিয়ে আশার এই শিশুকে হাতে ধারণ করো। তারা তাকে হাঁটতে শিখাবে, এবং একই সময়ে সে সামনে পরিচালিত করবে।

এই তপস্যাকালীন যাত্রায় সবার প্রতি রইলো আমার আশির্বাদ।

-পোপ ফ্রান্সিস, ভাটিকান সিটি-  

Please follow and like us: