ড. ফাদার শংকর ডমিনিক গমেজ

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর, বরকত নাম না জানা আরো অনেকে রাজপথে নেমেছিল প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্যে এবং সেদিনই তারা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রাজপথে। কেননা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিয়ে তারা দিতে চেয়েছিল ঊর্দু। যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি, কথা বলি, সে ভাষাকে ওরা নেড়ে নিতে চেয়েছিল।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হবার পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক একটি দেশের জন্ম হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে দেখা যায় মাঝখানে ভারত এবং সহস্র মাইল দূরে দু’টো অংশ, একটি সরকার। পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান সরকার দেশ পরিচালনা করে এবং লোকদের উপর দমন-নিপীড়ন করে। এমনকি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেন ঊর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্র ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং ভাষা রক্ষার জন্য শুরু হয় ভাষা-আন্দোলন।

সেদিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, রফিক, বরকতসহ আরো অনেকে শহিদ হন। পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে নেই যে মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য সন্তানেরা জীবন দিয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষাকে পেয়েছি। আর তাই প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

বাংলা ভাষার জন্য বাঙ্গালীর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেসক্যু এর ৩০তম অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত ২১ ফেব্রুয়ারি, এদিন শহীদদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। এদিন আমরা বুকের রক্ত দিয়ে লিখেছি ফেব্রুয়ারি। জীবন দিয়ে রক্ষা করেছি মায়ের ভাষা বাংলাকে। তাই বাংলা ভাষা আমাদের কাছে এত প্রিয় মাতৃভাষা।

২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন বাঙালীর মাতৃভাষা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক লড়াই হলেও এর মধ্যেই স্বাধীনতার মূলমন্ত্র নিহিত ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাস্ট্রে জন্ম হয় পৃথিবীর মানচিত্রে। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতি বিজয় লাভ করে। তাই প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উৎযাপন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্মরণীয় ইতিহাস। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সন্তানেরা জীবন দিয়েছে ভাষার জন্য তথা একটি স্বাধীন দেশের জন্য। বাংলার মাটি রক্তে হয়েছে রঞ্জিত। তাইতো বাংলার লাল-সবুজের পতাকা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আমরা গান করি “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি”।

Please follow and like us: