পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস ২০২৪ খ্রিস্টাব্দটিকে প্রার্থনা-বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর কারণ বা উদ্দেশ্য হলো খ্রিস্টমণ্ডলির ঐতিহ্য অনুসরণ করে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হবে খ্রিস্ট-জয়ন্তী বা জুবিলী বছর। এই বছর আমরা প্রার্থনা করে প্রস্তুতি গ্রহণ করব যেন আগামী বছর যথাযোগ্যভাবে আমরা খ্রিস্ট-জয়ন্তী উদযাপন করতে পারি। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে সেই মোশীর সময় থেকেই জুবিলী পালনের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। সেইসময় অবশ্য প্রত্যেক ৫০তম বছরে জুবিলী পালনের নির্দেশ ছিল। জুবিলী বছরে সকল দাস-দাসীদের মুক্ত-স্বাধীন করে দেওয়া হতো; সকল প্রকার ঋণ বা ধার-দেনা মওকুফ করে দেওয়া হতো; এবং ইস্রায়েল জাতির সকল অঞ্চলে ঘোষণা করা হতো মুক্তি বা পরিত্রাণ। সেটি ছিল পাপ থেকে মন ফেরানোর বছর; পরিত্রাণ ঘোষণার বছর (লেবীয় ২৫:১০)। কাথলিক মণ্ডলিতে প্রতি ২৫ বছর পরপর খ্রিস্ট-জুবিলী পালিত হয়ে আসছে; এই বছরটি হলো ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের বছর।
খ্রিস্ট-মণ্ডলিতে এই বছরটি হলো পাপ ও পাপের শাস্তি থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণ পাওয়ার বছর; এই বছরটি হলো বিরোধীদের মধ্যে পুণর্মিলনের ও মন পরিবর্তনের বছর, পুনর্মিলন সংস্কার বা সাক্রামেন্ত গ্রহণের বছর; সংহতি, আশা, ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপনের বছর; এই বছরটি হলো সকল ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলে-মিশে ঈশ্বরকে সেবা করার অঙ্গীকার পূরণের বছর। জুবিলী বছর হলো খ্রিস্টের বছর যখন তিনি মানব জাতির কাছে তাঁর জীবন ও অনুগ্রহ প্রদান করেন।
তাই খ্রিস্ট-মণ্ডলি এই বিশেষ বছরগুলি পালন করে যিশু খ্রিস্টের জন্মের বা এই পৃথিবীতে তাঁর আগমনের বিশেষ অনুগ্রহ-বর্ষ হিসেবে। পোপ ফ্রান্সিসের নির্দেশে আগামী বছর যে খ্রিস্ট-জুবিলীর বছর পালন করা হবে তা হবে তা হবে “আশার বর্ষকাল”; পোপ মহোদয় চান যেন আগামী বছর আমরা হয়ে উঠি “আশার তীর্থযাত্রী”(আর্চবিশপ রিনো ফিসিকেল্লার কাছে লেখা পোপের চিঠি)।
তাই এই বর্তমান বছরটি হলো একটি প্রার্থনার বছর যেন আমরা আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি। এটা এমনই এক প্রস্তুতি যা আমরা প্রত্যক্ষ করি প্রায়শ্চিত্তকালে যখন আমরা কৃচ্ছ সাধনা, ধ্যান-প্রার্থনা ও প্রয়শ্চিত্তের মধ্য দিয়ে আমরা খ্রিস্টের পুনরুত্থান উৎসবের জন্য প্রস্তুত হই। ভাটিকানের প্রেশ অফিস থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়, “জুবিলী যেন গোটা খ্রিস্টমণ্ডলিতে ও সকল ঐশ জনগণের জীবনে আধ্যাত্মিক নবায়ন ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে, আর তা যেন সত্যিকারের একটি আশার চিহ্ন হয়ে ওঠে, সেই জন্য তা প্রত্যেক মানব সমাজে এমনভাবে প্রস্তুত ও উদযাপন করতে হবে যেন তা সত্যিকার অর্থেই খ্রিস্টীয় আশার চিহ্ন হয়ে ওঠে”।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, “এই বছর আমাদের নতুন নতুন প্রার্থনা তৈরী করা বা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করার বছর নয়, বরং এই বছর আমরা যেন খ্রিস্টীয় জীবনে প্রার্থনার মূল্য ও মর্যাদা তা নতুন করে অনুধাবন করতে পারি। আমরা শিখব কিভাবে প্রার্থনা করতে হয়, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই ডিজিটাল যুগে কিভাবে খ্রিস্টভক্তদের প্রার্থনায় প্রশিক্ষিত করে তুলবো যেন আমাদের সকলের প্রার্থনা ফলপ্রদ হয়” (আর্চবিশপ রিনো ফিসিকেল্লার কাছে লেখা পোপের চিঠি)। ঈশ্বরের দয়ায় যদি ঐশ জনগণ প্রার্থনার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তার কথা নতুনভাবে অনুধাবন করতে পারে, তা হ’লেই এই জুবিলী-বর্ষ ফল-প্রদ হয়েছে বলা যাবে। আমরা তা কিভাবে আরম্ভ করব – পোপ ফ্রান্সিস তার একটি পরামর্শ রেখেছেন।
তিনি বলেছেন যে, জুবিলী পালনের পূর্বে এই প্রস্তুতির বছরটিতে আমি চাই যেন আমরা সকলে মহা “প্রার্থনা-ম্ফিনীতে” সময় কাটাই। সব কিছুর উপরে প্রার্থনার অর্থ হলো যে ঈশ্বরের সামনে বা কাছে আমাদের উপস্থিত থাকার ও তাঁর কথা শোনার ইচ্ছা বা আগ্রহ ও একাগ্রতা এবং তাঁকে আরাধনায় প্রণত হওয়া। ঈশ্বর আমাদের কত যে ভালবাসেন আর তিনি আমাদের কত উপহার দান দিয়েছেন তার কোন সীমা পরিসীমা নেই সেই জন্য তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোও প্রার্থনার উদ্দেশ্য। তিনি কোন না কোনভাবে আমাদের দৈনিক প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে, বিশ্বভ্রহ্মান্ডের সকল কিছু তিনি আমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমাদের তিনি দিয়েছেন তাঁর সকল সৃষ্টি, প্রকৃতি ও পরিবেশ যেন আমরা তা উপভোগ করি, আনন্দ করি ও তা ব্যবহার করে উপকৃত হই। সেই সঙ্গে তিনি আমাদের এই দায়িত্বও দিয়েছেন যেন আমরা সেইসব কিছুর যত্ন করি, সেগুলি রক্ষা করি ও সেগুলির প্রতি দায়িত্বশীল হই। আমরা যেন তাঁর সৃষ্টির সব কিছু উপভোগ করি, কিন্তু যেন তা ভক্ষণ করার মত ধ্বংস না করি। প্রার্থনাই আমাদের সেই উপলব্ধি দান করবে ও আমাদের দায়িত্বশীল খ্রিস্টভক্ত হতে প্রেরণা জোগাবে।
প্রার্থনা হলো “হৃদয় ও আত্মায়” এক হওয়ার বহিঃপ্রকাশ (প্রেরিত ৪:৩২), যা আমাদের সংহতি প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে এবং আমরা তখন আমাদের অভাবী ভাই-বোনদের সঙ্গে আমাদের আহার সহভাগিতা করতে পারি। প্রার্থনা জগতের প্রত্যেক মানুষকে এক ঈশ্বরের দিকে মন ফেরাতে প্রেরণা দেয় এবং ঈশ্বরের কাছে সকল মানুষের হৃদয়ের গভীরে যা লিপিবদ্ধ রয়েছে তা প্রকাশ করে। প্রার্থনা হচ্ছে পবিত্রতা লাভের সেই রাজকীয় পথ, যা আমাদের অনেক কাজে ব্যস্ত থাকলেও আমাদের ধ্যানী মানুষ হতে সাহায্য করে। মোট কথা প্রার্থনা হোক এই বছর আমাদের জীবন-ব্রত – যার ফলে আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত হবে ঈশ্বরের প্রাচুর্য্যময় অনুগ্রহ গ্রহণ করার জন্য। এইভাবে আমরা যে প্রভু যিশুর সেখানো প্রার্থনায় বলি “হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতা” তা সত্যিকারভাবেই আমাদের খ্রিস্টীয় জীবনের কর্মসূচী হয়ে ওঠে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও