ফাদার সাগর কোড়াইয়া
পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারী রবিবার এই বছরকে প্রার্থনা বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি প্রার্থনা বর্ষ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্ট জয়ন্তীর দ্বার উন্মুক্ত করে জনগণকে একটি আধ্যাত্মিক যাত্রায় সন্মিলিত করতে চান। যিশুর জন্মের ২০২৫ বছর পূর্তিতে সমগ্র পৃথিবী আশা ও আনন্দে ভরে উঠার অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছে। পঁচিশ বছর পূর্বে খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছরের জুবিলীর প্রস্তুতিস্বরূপ তিনটি বছরে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মূলসুরের ওপরে বাংলাদেশ মণ্ডলি জনগণকে পরিচালনা করেছে। মূলভাবগুলো ছিলো ‘খ্রিস্টে আমরা দীক্ষিত’ (১৯৯৭), ‘আত্মায় আমরা এক’ (১৯৯৮) এবং ‘পিতার দিকে যাত্রা’ (১৯৯৯)। তবে এই বছর পুণ্যপিতার প্রার্থনা বর্ষ ঘোষণা ও খ্রিস্ট জুবিলীকে ‘আশার তীর্থযাত্রা’ হিসেবে ঘোষণা করা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মণ্ডলির তীর্থযাত্রাকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
জুবিলী জয়ন্তী একটি কালের বা সময়ের পূর্ণতা ইঙ্গিত করে (গালাতীয় ৪:৪)। জুবিলী বা জয়ন্তী অর্থ হল তুরীধ্বনী বা আনন্দোৎসব (লেবীয় ২৫:১০)। এই আনন্দ পৃথিবীর সকল জাতি ও সকল মানুষের; যারা প্রতিনিয়ত স্বর্গের দিকে যাত্রা করছে। এই আনন্দ শুধু মনের অভ্যন্তরীণ আনন্দই নয় বরং অভ্যন্তরের সাথে বাহ্যিক আনন্দকেও প্রকাশ করে। খ্রিস্টমণ্ডলি আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ কারণ পরিত্রাণের বাণী ও ঐশ্যরাজ্যের পথ খ্রিস্টের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থনা বর্ষে নানা ধরণের আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপের পর খ্রিস্ট জুবিলী বর্ষ আমাদের এমন দিব্যদৃষ্টি দান করবে যা আমাদের জীবনকে প্রার্থনাময় করে তুলবে।
পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস খ্রিস্ট জুবিলীকে ‘আশার তীর্থযাত্রা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। ‘আশা’ হচ্ছে খ্রিস্টিয় গুণ। আশা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আশা করি বিধায় শত সমস্যার মধ্যেও এগিয়ে যাই। আশা আছে বলেই যিশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি কারণ আমরাও একদিন পুনরুত্থিত হবো। আশার কারণেই স্বর্গের দিকে যাত্রা আব্যাহত রয়েছে। আশা আছে বলেই নিশ্চিন্তে পদক্ষেপ ফেলি। আশাহীন জীবন মৃতপ্রায়। বর্তমান জগতে সব শ্রেণীর মানুষ নিরাশার মধ্যে জীবন যাপন করছে। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আশার পরিবর্তে নিরাশা বিরাজমান। সন্তানদের প্রতি পিতামাতার আশা হারিয়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে উচ্চ ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে আশার অভাবে প্রতিষ্ঠানের বেহাল অবস্থা দাঁড়ায়। তবে আগামী বছর যিশুর জন্ম জুবিলী উৎসব আমাদের আশার আলো দেখায়। আর সেই আলোতে খ্রিস্ট জুবিলীর দিকে যাত্রায় প্রার্থনা একটি বড় শক্তি।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রার্থনা করেন। প্রার্থনার একটি শক্তি রয়েছে। প্রার্থনা হচ্ছে মন্ত্রের মতো। মন্ত্র যেমন ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় কাজই করতে পারে তেমনি প্রার্থনা শুধুমাত্র ইতিবাচক ফলই ফলায়। প্রার্থনায় যদি কোন ফল উৎপাদন না হতো তাহলে বিশ্বে প্রতিদিন এত বিশ্বাসী মানুষ প্রার্থনা করতো না। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমরা প্রার্থনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি; কিন্তু ঈশ্বর প্রার্থনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন না’। আমাদের প্রার্থনা যেন হয় ‘অনবরত প্রার্থনা’। “আর সেই জন্যই আমি তোমাদের বলছি, প্রার্থনায় তোমরা যখন যা কিছু চাও, তখন বিশ্বাস কর যে, তোমরা তা পেয়েই গেছ” (মার্ক ১১:২৪)।
প্রার্থনা বর্ষের মূলভাব হচ্ছে ‘প্রভু আমাদের প্রার্থনা করতে শেখান’ (লুক ১১:১)। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, পোপ ফ্রান্সিস কেনইবা জুবিলী বর্ষের আগের বর্ষকে প্রার্থনা বর্ষ ঘোষণা করেছেন? এর অর্থ কি এই যে, আমরা প্রার্থনা করতে জানি না? আসলে প্রার্থনায় আমরা প্রত্যেকেই শিক্ষানবিশ। আমরা কেউ একেবারেই প্রার্থনা শিখে ফেলি না। বরং প্রতিদিন প্রার্থনা করতে শিখি। যত প্রার্থনা করি ততই বুঝতে পারি যে, প্রার্থনা করতে জানি না। প্রার্থনায় আলাদা আনন্দ উপলব্ধি করতে হয়। হয়তোবা সারাদিন প্রার্থনা করছি কিন্তু আনন্দ নেই; শুধু নিয়ম রক্ষা হচ্ছে। তবে অনেকের এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রার্থনায় কয়েক মূহুর্তের জন্য এক ধরণের আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম হয়েছে যা সারা জীবনের প্রার্থনায় হয়নি। আসলে সত্যিকার প্রার্থনা হচ্ছে সেটাই।
প্রার্থনা আমাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে সহায়তা করে। তবে যখন ঈশ্বরে বিশ্বাসের চেয়ে ঈশ্বরকে অনুভব ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হই তখন তা বড় প্রার্থনা হয়ে উঠে। প্রার্থনা করা হচ্ছে একটি কাজ। তবে এর থেকেও ঊর্ধ্বে আমাদের উঠতে হয়। আমাদের জীবনকে প্রার্থনায় রূপান্তর করতে হয় সব সময়। যা হয়তোবা আমরা অনেকেই জানি না। জীবনে প্রার্থনার মধ্যে ঐক্যতান (Symphony of Prayer) থাকতে হয়। প্রার্থনাচরণ ও জীবনাচরণের মধ্যে ঐক্যতান আনতে না পারলে দুটি দুই দিকে চলতে থাকে। জোর করে হয়তোবা দুটির মধ্যে একতা আনার চেষ্টা করা যাবে তবে তা ভন্ডামীর নামান্তর। তখন প্রার্থনা ও জীবনাচরণের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধতে বাধ্য। প্রার্থনালয়ে আমি যা করি তা যেন মানুষালয়ে একই চিত্র প্রকাশ করে।
প্রার্থনা কি; তা পোপ ফ্রান্সিস উল্লেখ করে বলেন, ‘প্রার্থনা হচ্ছে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে থাকার বাসনা, ঈশ্বরের কথা শোনা এবং ঈশ্বরের আরাধনা। প্রার্থনা হচ্ছে খ্রিস্টবিশ্বাসীর বিশ্বাস, আশা ও সেবার জীবনের যত্ন’। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমরা অন্যের প্রতি মনোযোগী হই। অন্যকে স্বাগতম জানাই এবং যিশুর মতো দয়ালু হৃদয় নিয়ে অন্যের নিকট পৌঁছাই। আমাদের নিকট অনেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রার্থনার আহ্বান জানান। হয়তোবা ব্যস্ততা বা অন্য কোন কারণে প্রার্থনা করতে ভুলে যাই। তবে যে কোন মূহুর্ত ও পরিস্থিতিতে সে ব্যক্তিকে স্মরণে আনা এক ধরণের প্রার্থনা হতে পারে। পুণ্যপিতা বলেন, ‘প্রার্থনা বর্ষে আমরা আরো বেশি নম্র হতে এবং প্রার্থনায় আরো বেশি সময় দিতে আহুত’।
প্রার্থনায় ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রভুকে এবং নিজেকে জানা যায়। প্রার্থনা ঈশ্বরের পরিকল্পনায় থাকার জন্য কৃপা-আশীর্বাদ প্রদান করে। প্রার্থনায় আমরা পবিত্র আত্মাকে আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে এবং কি করা উচিত তা নির্ধারণে সাহায্য করি। প্রার্থনা ছাড়া আমাদের কাজ ফলবিহীন এবং আমাদের বাণী প্রচারে কোন আত্মা থাকে না। কারণ প্রার্থনা হচ্ছে আমাদের আত্মা ও আধ্যাত্মিক জীবনের অক্সিজেন।
জুবিলী বর্ষ পালনের পূর্বের বছরটি প্রার্থনা বর্ষ হিসাবে ঘোষণা পোপ ফ্রান্সিসের বিচক্ষণতার পরিচয়কেই প্রকাশ করে। প্রার্থনা বর্ষ পালন করার মধ্য দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে জুবিলী বর্ষের দিকে আধ্যাত্মিক যাত্রা করছি। জীবনে প্রার্থনা না থাকলে খ্রিস্টের জুবিলী বর্ষ পালন অনর্থ বলেই মনে করি। কারণ প্রার্থনার মধ্য দিয়েই আমরা যিশুকে চিনতে পারি। জুবিলী পালনের প্রস্তুতিতে তাই আমাদের প্রধান কাজ হলো পাপ ও মন্দতা জয় করে মন পরিবর্তন করা। আর তা করতে গেলে প্রার্থনা ছাড়া অসম্ভব। আমাদের প্রস্তুতি হবে ঠিক শিষ্যদেরই মতো “প্রভু আমাদের প্রার্থনা করতে শেখান”।