ফাদার উজ্জ্বল রিবেরু
প্রতিটি মানুষের জীবনে মা হচ্ছে কাছের ও অতি আপন ব্যক্তি। মায়ের সাথে রয়েছে ভালোবাসার একটি নিবিড় সম্পর্ক। কারণ মাতৃগর্ভ থেকেই আমরা মায়ের সাথেই জড়িয়ে রয়েছি। তাই আমরা মায়ের স্নেহে থাকতে চাই, মায়ের আচঁল তলে আশ্রয় নেই। গ্রাম বাংলায় প্রচলিত একটি বাক্য রয়েছে, “মা ঘরে নেই যাহার, সংসার অরণ্য তাহার”। শৈশবে বা কৈশরে যারা মাকে হারায় তারাই শুরু বুঝতে পারে জীবনে মায়ের কত প্রয়োজন। মা ছাড়া জীবন শূণ্যতার, অন্ধকার ও একাকিত্বের আর তাই যিশু ক্রুশের উপর থেকে তাঁর মাকে আমাদের দিয়েছেন এবং বলেছেন যোহন, ঐ দেখ তোমার মা। এই কথার মধ্য দিয়ে এই বিশ্ব পেয়েছে জগত মাতাকে। আদি মাতা হবার অবাধ্যতার কারণে মানুষের পতন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু নবীনা হবা মারিয়ার বাধ্যতার গুণে জগতে পরিত্রাণের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। মা-মারিয়ার যে সকল গুণাবলী একজন খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে অনুসরণ করতে পারি তাই আলোচ্য করা হয়েছে।
বাধ্যতা: মা-মারিয়ার জীবনে বাধ্যতা হলো অন্যতম একটি গুণ। পবিত্র মঙ্গল সমাচারে আমরা দেখতে পাই মহাদূত গাব্রিয়েলের মুখ থেকে মারিয়া যখন ঈশ্বরের পুণ্য ইচ্ছার কথা শুনতে পেলেন আর তখন তিনি বলেছিলেন “ আমি প্রভুর দাসী, আপনি যা বলছেন, আমার তাই হোক” (লুক ১:২৮-৩৮)। সাধু ইরেনিয়াস মারিয়ার বাধ্যতা সম্পর্কে বলেছেন, মারিয়া “ তাঁর বাধ্যতার গুণে নিজের এবং সমস্ত মানব জাতির পরিত্রাণের কারণ হয়ে উঠেছেন।” আর সত্যিই তাই মা-মারিয়ার বাধ্যতার মধ্য দিয়েই জগতে ঈশ্বরের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়েছে। মণ্ডলির আদি পিতৃগণ ও আচার্যদের ভাষায়, “ হবার অবাধ্যতার গ্রন্থির সাথে যুক্ত হয়েছে মারিয়ার বাধ্যতার গ্রন্থি: অবিশ্বাসের দ্বারা হবা যে বন্ধন সৃষ্টি করেছেন, কুমারী মারিয়া তাঁর বিশ্বাসের দ্বারা সেই বন্ধন মুক্ত করেছেন।
নম্রতা : আমরা সকলেই জানি যে নম্রতা হলো সকল গুণের রাণী। কেননা নম্রতা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। মা-মারিয়াও ঠিক তেমনি ভাবেই ছিলেন সহজ, সরল ও নম্র ব্যক্তিত্বের। তিনি বিনম্রতার সহিত ঈশ্বরের ইচ্ছাকে নিজের জীবনে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেকে এতই নমিত করেছেন যে, তিনি বলেছেন, “আমি প্রভুর দাসী”। মারিয়ার বিনম্রতাই আমাদের কাছে আদর্শ ও অনুকরণের।
পবিত্রতা: মা-মারিয়ার পবিত্র জীবনই তাকে করে তুলেছে যিশুর জননী। মারিয়া ছোট বেলা থেকেই পবিত্র জীবন যাপন করতেন এবং সব পরিস্থিতিতে পবিত্রতা ধরে রেখেছিলেন। নিয়ম সিন্দুক হলো পবিত্র জায়গা। আর মা-মারিয়াকে বলা হয় নিয়ম সিন্দুক। কেননা যিশুকে গর্ভে ধারণ করার মধ্য দিয়ে তিনি নিয়ম সিন্দুক হয়ে উঠেছেন। তিনি এতটাই পবিত্র ছিলেন যে, পুত্র ঈশ্বর তাঁর গর্ভে বসবাস করেছেন।
বিশ্বাসী: মা-মারিয়া পরিপূর্ণ ঈশ্বরের বিশ্বাসী ছিলেন এবং ঈশ্বরের বাক্যে সর্বদাই বিশ্বাস স্থাপন করে চলেছেন। ঈশ্বরের উপর দৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই তিনি স্বর্গ দূতের কথায় বিশ্বাস করে হ্যাঁ বলেছিলেন এবং বলেছেন “ আমার তাই হোক”। মারিয়া এই হ্যাঁ বলা সত্যিই বিশ্বাসের স্তম্ভস্বরূপ, আমাদের সামনে আদর্শ যেন আমরাও সর্বোপরি ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ হয়ে উঠি।
ঈশ্বর নির্ভরতা: মা-মারিয়ার আরেকটি বড় গুণ হলো ঈশ্বর নির্ভরতা । মা-মারিয়া ঈশ্বরের উপর পরিপূর্ণ নির্ভর করেছিলেন ও আস্থা স্থাপন করে চলেছেন। তাই তিনি কুমারী হয়েও মা হওয়ার ঝুুঁকি গ্রহণ করে পৃথিবীর মানুষের মুক্তির জন্য যিশুকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন।
পরোপকারী: পবিত্র মঙ্গল সমাচারে মা-মারিয়ার সম্পর্কে বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই তিনি একজন পরোপকারী মানুষ ছিলেন। অন্যের সাহায্যে কতটা দরদী ও উদার ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। তাঁর বোন এলিজাবেথকে সাহায্য করার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই সাথে কানা নগরে বিয়ে বাড়িতে অন্যের প্রয়োজনের কথা যিশুর কাছে প্রকাশ করেছেন।
মা-মারিয়ার জীবন ও গুণাবলী নিয়ে যদি আমরা ধ্যান করি তাহলে আরো অনেক গুণাবলী আমরা দেখতে পাবো। কিন্তু উপরে উল্লেখিত গুণাবলী মঙ্গলসমাচারের আলোকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মা-মারিয়ার গুণাবলী ধ্যান করতে গিয়ে আমরা নিজেরা চিন্তা করতে পারি, আমরা কি মা-মারিয়ার মত বাধ্য, নম্র, পবিত্র, বিশ্বাসী, ঈশ্বরনির্ভরশীল ও পরোপকারী ? আর যদি না হয়ে থাকি একজন খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের করণীয় কি? সত্যিই মা-মারিয়া হতে পারে আমাদের জীবনে একজন আদর্শ মানুষ এবং মা। যার মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করলে ও তাঁকে অনুসরণ করলে আমাদের জীবনও হয়ে উঠবে ধন্য। মা-মারিয়া হচ্ছেন আমাদের জীবনে যিশুর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। যিশু নিজেই সেই উপহার আমাদের দান করেছেন। মারিয়া উঠে সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে যাত্রা করেছিলেন সেই একই ভাবে আমরাও প্রত্যেকে জেগে উঠি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতো বেড়িয়ে পরি।