ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি
পোপ ফ্রান্সিস হলেন প্রথম পোপ যিনি সর্বপ্রথম জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। জুন মাসের ১৩-১৫ তারিখ পযর্ন্ত দক্ষিণ ইতালির পুগলিয়া অঞ্চলের বোরগো ইগ্নাজিয়া নামক স্থানে অনুষ্ঠিত এই শীর্ষ সম্মেলনে পোপ ১৪ তারিখে ভাষণ দেন। বিশে্বর ৭ জাতিভুক্ত ধনী দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানকারি নেতাদের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পোপ কথা বলেন। তিনি তাঁর ভাষণের শুরুতেই রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের দায়বদ্ধতা হলো কত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেনো ঝুঁকি কমিয়ে মানবতার সেবা করতে পারে। পোপ বলেন, “আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো এমন শক্তিশালী এবং অপরিহার্য যন্ত্রকে কৌশলগতভাবে উন্নয়নকামী দৃষ্টান্ত আরোও শক্তিশালী করা উৎসাহিত করতে পারি না, কিন্তু আমাদের অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হুমকির বিরুদ্ধে একটা বেষ্টনি নির্মাণ করতে হবে।” এ প্রসঙ্গে পোপ রাজনৈতিক নেতাদের করণীয় পদক্ষেপে তাগিদ দিয়ে বলেন, অনেকে মনে করেন রাজনীতি একটি “অতৃপ্তিজনক শব্দ, মাঝে মধ্যে ভুল, দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাজনীতিকে অসম্মান করার চেষ্টা করা হয় বা অর্থনীতি দিয়ে বিবেচনা করা হয় নয়তো বা নানা ধারণা দিয়ে মোচড়ানোর চেষ্টা করা হয়।” পোপ বিশ্ব রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উল্লেখ করে বলেন, “সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক শান্তি” কার্যকর ও অগ্রগতির জন্য একটি সুস্থ রাজনৈতিক জীবন প্রয়োজন।
জি-৭ সম্মেলনে যোগদানকারি বিশ্ব নেতাদের- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা ও এর থেকে তৈরি বিপদ সম্পর্কে বিশেষ ইঙ্গীত প্রদান করেছেন। পোপ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আচরণ “উত্তেজনাপূর্ণ এবং ভযঙ্কর।” তাঁর মতে, এই যন্ত্রটি মানুষের কাছে জ্ঞানের পরিধি সমৃদ্ধ করতে, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে দ্রু ত এগিয়ে নিতে এবং “মেশিনের জন্য প্রয়োজনীয় এবং কষ্টসাধ্য কাজ” সম্পন্ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বার্তায় একটা মূল আশঙ্কার কথা এভাবে উল্লেখ করে বলেছেন, “তবুও একই সময়ে যন্ত্রটি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আধিপত্যশীল এবং নিপীড়িত সামাজিক শ্রেণির মধ্যে অধিক মাত্রায় অবিচার নিয়ে আসতে পারে, সেই সঙ্গে একটা বিপদজনক সম্ভাবনার উদ্ভব ঘটিয়ে সংস্কৃতিকে নিক্ষেপ ক’রে একটা অপ্রত্যাশিত সংস্কৃতি গ্রহণ করতে পারে।” তিনি বলেন, যন্ত্র এবং প্রযুক্তির “ ক্ষতি এবং লাভ নির্ভর করে এর ব্যবহারের দ্বারা।”
পোপ ফ্রান্সিস বিশ্ব সম্প্রদায়কে একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ব্যবহারের নীতিগুলো খুঁজে বের করার যেমন আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার যুক্তিকতাও তুলে ধরেছেন। উদাহরণসরূপ পোপ “প্রাণঘাতী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র” নিষিদ্ধ করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, “কোনো যন্ত্রকে কখনোই একজন মানুষের জীবন নিতে বেছে নেওয়া উচিত নয়।” তিনি বলেন- যন্ত্র বা অস্ত্র নয়, “সিদ্ধান্ত গ্রহণ মানুষের উপর ছেড়ে দিতে হবে।” তিনি আরোও বলেন, “ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকর্তৃক তৈরি তথ্য-উপাত্তের উপর পছন্দের বিষয়টি ও যন্ত্রের দ্বারা মানব মর্যাদা রক্ষার সঠিক নিয়ন্ত্রণ মানুষের নিয়ন্ত্রণেই থাকতে হবে।” পোপ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, মানবতা আশাহীন ভবিষ্যতের জন্য নিন্দিত হবে, “যদি আমরা মানুষের নিজের এবং তাদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেড়ে নেই, তাদের যন্ত্রের পছন্দের উপর নির্ভর করার কারণে ধ্বংস করে দিই।” পোপ শিক্ষার্থীদের “উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার” বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এইসব “চমকপ্রদ যন্ত্র,” এবং যেগুলোর পরিচালনা পদ্ধতি অনলাইনে সহজলভ্য- ফলে যে কোনো বিষয়ের উপর রচনা তৈরি বা চিত্র তৈরি করার সুযোগ রেখে দেয়। তিনি এই প্রসঙ্গে আরো বলেন, যদি এই যন্ত্রগুলো উৎপাদনশীল না হয় তবে তারা এগুলোর উন্নয়ন, নতুন বিশ্লেষণ ধারণার উন্নয়ন না এনে যা খুঁজে পায় তার পুনরাবৃত্তি করে মাত্র বা এর পূর্ব ধারণায় ভুল-ত্রুটি আছে কিনা তা পরীক্ষা না করে একটা “আবেদনময়ী রূপ” দেওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার পাঠ্যবলে, “শুধু ভূয়া খবরকে বৈধতা দেওয়া এবং প্রভাবশালী সংষ্কৃতিকে শক্তিশালী করার ঝুঁকি চালায় না- কিন্তু শিক্ষাগত প্রক্রিয়াকে ক্ষুন্ন করে।” পোপ ফ্রান্সিস তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বনেতাদের বলেন, “মানুষের মূল্য এবং মর্যাদা বুঝার বিষয়ে সঠিক নীতি এই পদ্ধতিগুলোর বাস্তবায়ন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।” তিনি বলেন, “আসলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো উদ্ভাবন নিরপেক্ষ নয়।”
প্রযুক্তি কোনো না কোনোভাবে সামাজিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং এক ধরনের “ক্ষমতার বিন্যাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। এইভাবে নিদির্ষ্ট কিছু মানুষকে ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করতে সক্ষম করে তোলে এবং অন্যদেরকে বিভিন্ন কাজ করতে বাঁধা প্রদান করে। যারা এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক এবং বিকাশ ঘটিয়েছেন, “অধিক বা কম মাত্রায় স্পষ্টভাবে প্রযুক্তির এই গঠনমূলক শক্তিমাত্রা সর্বদা তাদের বিশ্ব দর্শনকে অর্ন্তভুক্ত করেছে।” পোপ আরোও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্মকান্ডগুলো উত্তম এবং আগামীদিনের প্রতিটি মানুষের জন্য মঙ্গলের লক্ষ্য থাকতে হবে- একটি নৈতিক অনুপ্রেরণা, থাকতে হবে, যা সমর্থনলাভ ক’রে চিহ্নিত হবে। তিনি যন্ত্র সম্পর্কে তাঁর ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার “উত্তম ব্যবহার” করা সবার উপর নির্ভর করে। “কিন্তু এই ধরনের উত্তম ব্যবহার সম্ভব করার জন্য এবং ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করার দায়িত্ব রাজনীতির উপরে।”
পোপ ফ্রান্সিস চলতি বছরের শুরু থেকেই তাঁর বিভিন্ন বার্তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মতামত প্রকাশ করে আসছেন। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তির ক্রমবর্ধনশীল উন্নয়ন স্বাভাবিক কিন্তু তার কারণে মানুষের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ও অবক্ষয় যেনো না ঘটে। প্রযুক্তির মধ্যে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” যেভাবে মানুষের কার্যকলাপ, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে- তা তাঁদের মতে, “সমন্বিত মানব উন্নয়ন” ত্বরান্বিত করার বিরুদ্ধ আচরণ। যদি যন্ত্রই মানুষকে সব বলে দিবে তাহলে ঈশ্বর কেনো মানুষকে প্রতিভা দিয়েছেন। বাইবেলের ভাষায়, ঈশ্বর প্রতিটি মানূষকে যার যার মতো করে প্রতিভা দিয়েছেন- সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু এই সৃষ্টি যেনো হয় মানুষের কল্যাণের জন্য এবং সৃষ্টি যেনো কিছুতেই নৈতিকতাকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে না দেয়। সুতরাং প্রযুক্তির ভূমিকা হবে মানবজাতির কল্যাণ ও উৎকর্ষসাধন- নৈতিকতা বর্জন নয়, আধ্যাত্মিকতার বিনাশ নয়।
“ঈশ্বর বলিলেন, তোমরা ফলবান ও বহুবংশ হও এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভূত কর” (আদি ১:১৮)। “বশীভূত” করার অর্থ এই নয় যে, মানুষের ধারণার মধ্যে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বদলে দেওয়া, নৈতিকতা ও পাপের ধারণা (Notion of Sin) বদলে দেওয়া। যন্ত্র যদি মানুষের মতো আচরণ করে তাহলে নতুন প্রজন্ম যন্ত্রের আচরণের মধ্যে বেড়ে উঠবে। যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে ? নাকি ঈশ্বরের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হবে ? প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রশংসা করে পোপ বলেন, “প্রযুক্তির উন্নয়ন যেনো বিশ্বে ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপনে সহায়ক হয়” এবং “নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন করার পূর্বে অবশ্যই মূল্যায়ন করে দেখতে হবে, তাতে নারী-পুরুষের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে কিনা।” পোপ নেতাদের কাছে একটা নৈতিক প্রশ্ন রেখেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কী ব্যহত হবে? সংশয়টা এখানেই, জ্ঞান উন্নয়নের যে স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান- তার তাগিদ থেকে মানুষ সরে যাবে। ফলে জ্ঞান চর্চার বিবর্তন থেমে যাবে আর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর। বিদ্যালয়ের কৃত্রিম শিক্ষক যে ভাষা, ইংগীত, উচ্চারণ-আচরণ করবে- ছাত্ররা তাই অনুকরণ করবে। এটা হয়ে দাঁড়াতে পারে মানুষকে অপসারণ ক’রে সেখানে যন্ত্র স্থান করে নেওয়া। প্রশ্নবাক্যে যন্ত্র যখন সঠিক আচরণ করার জন্য সচেতন হয়ে ওঠে, তখন মানুষের মধ্যকার মানবিক গুণ স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে, অবক্ষয় হতে পারে নৈতিকতার। ডিজিটাল বিপ্লব আমাদের জন্য বৃহত্তর স্বাধীনতা আনতে পারে- কিন্ত যদি তা আমাদের বন্দি ক’রে না রাখে- যাকে আজকে বলা হয় “প্রতিধ্বনিত কক্ষ।” এমনাবস্থায়, তথ্য প্রযুক্তির বহুমুখীকরণ বিস্তৃত না হয়ে ঝুঁকি তৈরি হয় নিযন্ত্রণহীন ও বিশৃঙ্খলার এবং শিকার হয় বাজার ব্যবস্থার অথবা ধনীগোষ্ঠীর।
পোপের ভাষায়, প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের জন্যে, বিশ্ব শান্তির জন্যে। এই প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণ ও শান্তি বয়ে আনবে- যাদের হাতে প্রযুক্তির রিমোট কন্ট্রোল রয়েছে- তাদের শুভ বুদ্ধির কল্ল্যাণে। পোপ বলতে চান, দ্রুত বর্ধনশীল এই বিস্ময়কর নব প্রবর্তন, যার কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা আমাদের অনুধাবন ও মূল্যায়ন সামর্থের বাইরে এবং ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে উভয়দিকে- উত্তেজনা এবং অজ্ঞতা। এই বিষয়টিই পরিস্কারভাবে মানুষের স্বভাব নিয়ে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে- ভবিষ্যতের গবেষণাগারে নির্মিত মনুষ্যরূপি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আমাদের সাদৃশ্যতা নিয়ে। পোপের ভাষায়, আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে পুরোমাত্রায় মানব স্বভাবে অবস্থান ক’রে এই সাংস্কৃতিক রূপান্তরকে ভালো উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারি।