ফাদার সুশীল লুইস

ভূমিকা: রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের একজন সার্বক্ষণিক ধর্মপ্রচারক বার্নাবাস হাসদা নিজেদের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিষয়ে বলছিলেন : “দেহগ্রহণকারী যিশু খ্রিস্টই হলেন বাণীর মূল উৎস। তিনিই কেন্দ্রবিন্দু। তাঁকেই আমরা প্রচার করি। তিনিই ইহকাল ও পরকালের মুক্তিদাতা ও উদ্ধারকর্তা, তিনি ঈশ্বরপুত্র। ভক্তজনগণের মধ্য হতে নিযুক্ত খ্রিস্ট বাণী প্রচারককে কাটেখিস্ট বলা হয়ে থাকে সাধারণ অর্থে সময়ের ব্যাপকতায় ভিত্তিতে তাকে সার্বক্ষণিক কাটেখিস্ট বলা হয়।”

কাটেখিস্ট অন্যদের কানে যিশুকেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাসের কথা পৌঁছে দেন বা শোনান। কাটেখিস্টগণ হলেন  মণ্ডলির প্রেরণকাজের সেবাকর্মী। ঈশ্বর তাঁর আদেশ, শিক্ষা ও বাণী মানুষের অন্তরে দেন। তারা যেন তাঁর আশির্বাদ নিয়ে তাঁর দেয়া কর্তব্যরূপে তাঁর বাণী ও যিশুর আদর্শ সবার কাছে প্রচার করেন। সেভাবে যিশুর এ বাণী অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল এ প্রেরণ কর্মীদের দায় ও মহাদায়িত্ব, সহজ কথায় সেজন্যই তারা আহুত ও প্রেরিত। ১ করি ৯:১৬ বলে: “হায় রে আমি, মঙ্গল সমাচার যদি না প্রচার করি”। অন্যভাবে বললে বলতে হবে যিনি অন্যকে খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসে শিক্ষা ও পরিচালনা দেন। প্রভুর কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তা অন্যকে দেবার জন্য হল এ ধর্মশিক্ষা ফলে যেন মানুষ প্রভুর পথ জানতে পারেন। ধর্মশিক্ষা হল বাইবেল, উপাসনা, সাধুগণের জ্ঞান ও ঐতিহ্য ভিত্তি করে। এটা হল জীবন পরিবর্তনের জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

অবশ্য দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার পরে জোর দেয়া হয় মণ্ডলির শিক্ষা, বাণী প্রচার যেন হয় বাইবেলভিত্তিক। একইসাথে ভাটিকান মহাসভার শিক্ষা হল: বাণী প্রচার যুগোপযোগী ও বোধগম্য করার জন্য বাণী প্রচারকগণ যেন যুগলক্ষণ ও জনগণের সংস্কৃতির বিষয়ে সচেতন থাকে। দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার বর্তমান জগতে খ্রিস্টমণ্ডলির পালকীয় সংবিধান ৪৪ নং ধারা বলে: “পবিত্র আত্মার সহায়তায় ঈশ্বরের সকল জনগণ, বিশেষ করে পালকীয় কর্মী ও ঐশতত্ত্ববিদদের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনে তাদের পার্থক্য নির্ণয় করা এবং ঐশবাণীর আলোকে তাদের ব্যাখ্যাদান করা, যাতে প্রকাশিক সত্যকে অধিকতর গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, বুঝতে পারা যায় এবং অধিকতর উপযোগী ক’রে উপস্থাপন করা যায়।” আর সেভাবেই কথা ও কাজে তারা যীশুকে সবার কাছে প্রচার করবেন।

এর মাধ্যমে ভক্তবৃন্দ যিশুর কথা, কাজ ও তাঁর নিদর্শনগুলি বুঝতে চেষ্টা করবেন। পোপ ২য় জন পল জোর দিয়েছেন যে-কাটেখিস্ট- হোক পুরোহিত, ধর্মব্রতী-ধর্মব্রতিনী বা ভক্তজনগণ তারা যেন তাদের ব্যক্তিগত সাক্ষ্য এবং মণ্ডলির ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দ্বারা যিশুর মঙ্গলবাণী সহভাগিতা ক’রে তাদের খ্রিস্টের সঙ্গে মিলন বন্ধনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

প্রচারসেবীদের অবদান- দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার খ্রিস্টমণ্ডলি বিষয়ক ধর্মতাত্ত্বিক সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৩ ভক্তদের প্রৈরিতিক সেবাকাজ প্রসঙ্গে বলে: “প্রত্যেক স্থানে ও সমগ্র পৃথিবীতে মুক্তির পরিকল্পনা সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া খ্রিস্টে দীক্ষিত ভক্ত সাধারণের মহৎ কর্তব্য।” মণ্ডলিতে শত শত ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা দানের কাজ চলে এসেছে আর আজও তা কোনভাবে চলছে। যিশুর বাণীপ্রচার, ধর্মশিক্ষাদান মণ্ডলির জীবন, এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সেবাকাজ। ধর্মপ্রচারক বা কাটেখিস্ট নামক কিছু ব্যক্তি মণ্ডলির এ শিক্ষাগঠন কাজে জড়িত।

যুগে যুগে মণ্ডলিতে অনেক ভক্ত নারী পুরুষ আত্মত্যাগ ক’রে ভ্রাম্যমান বাণী প্রচার কাজে নেমেছিলেন। আজকের যুগেও আমাদের দেশে কাটেখিস্টগণ বিভিন্ন মানুষের কাছে বাণী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সহজে বলা যেতে পারে যে, তাদের অবদানেই মণ্ডলি আজ এ পর্যন্ত এসেছে, তার বিস্তার হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিভিন্ন মানুষের মধ্যে।

তারা নানা পরিস্থিতিতে তাদের সকল দান ব্যবহার ক’রে (এফে ৪:৬) মণ্ডলিকে কার্যকরী ও উপস্থিত করেন তাদের প্রচার ও জীবন দিয়ে। আর সেভাবে তারা মণ্ডলির প্রেরণকর্মে “একজন জীবন্ত সাক্ষ্য ও হাতিয়ার স্বরূপ” (মণ্ডলি বিষয়ক ধর্মতাত্ত্বিক সংবিধান- অনুচ্ছেদ ৩৩ ভক্তদের প্রৈরিতিক সেবাকাজ প্রসঙ্গে বলে)। সাধু পলের সহকর্মী নারী পুরুষদের মত (ফিলি ৪:৩; রোমীয় ১৬:৩) অনেক ভক্ত মানুষও নানা স্থানে বিভিন্নভাবে বাণী প্রচার ক’রে মুক্তিদায়ী প্রেরণকর্মে অংশগ্রহণ করেন। তাদের নিবেদিত বাণী প্রচার, ধর্ম শিক্ষা দান, প্রার্থনা পরিচালনা, নীতি শিক্ষা, যত্নদান প্রভৃতির জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ।

আর বর্তমানে তারা ভাল প্রস্তুতি নিলে, প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে বাণী প্রচারে অনেক সফলতা আাসবে। বাণী প্রচারের উদ্দেশ্য- দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার খ্রিস্টমণ্ডলির প্রেরণকার্য বিষয়ক নির্দেশ নামা ১৭ অনুচ্ছেদ বলে: “ ধর্মশিক্ষক বাহিনী, পুরুষ ও মহিলা উভয়ই প্রশংসার যোগ্য; জাতিগণের মাঝে প্রেরণকার্য তাদের কাছে বহুলাংশে ঋণী। প্রৈরিতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা তাদের মহৎ কাজের মাধ্যমে মণ্ডলিও বিশ্বাস বিস্তারের কাজে উল্লেখযোগ্য ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অবদান রাখেন।”

বাণী প্রচারের উদ্দেশ্য হল ধর্মশ্বিাস শিক্ষাদান, বাণী বুঝতে ও তা অন্তরস্থ করতে সহায়তা করা, তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তব্য বিষয়ে সচেতন ও তৎপর করা, বাণী অনুসারে জীবনযাপন করা ইত্যাদি। মানুষ যেন যিশুর কথা, কাজ, শিক্ষা, আদর্শ নিজেরা বুঝতে পারেন। বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার ক’রে খ্রিস্টর মঙ্গলবাণীকে অন্যের কাছে প্রদান করা হল লক্ষ্য। আর সেভাবে ঐশবাণীর আলোকে তাদের ব্যাখ্যাসমূহ মানুষদের সাহায্য করবে ঈশ্বর প্রকাশিত সত্যসমূহ হৃদয় গভীরে বুঝতে ও সে অনুসারে জীবন যাপন করতে। প্রভুর বাণী প্রচার হল এরূপ মানুষের জীবন ব্রত। মানুষের প্রয়োজন, পরিপক্কতা ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থান-কাল পাত্র ভেদে বাণী প্রচার বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। যেমন বাইবেল শিক্ষা, খ্রীষ্টবিশ্বাসের শিক্ষা, উপদেশ, নৈতিক শিক্ষা, দীক্ষার্থীদের জন্য ভক্তিকথা, দীক্ষিতদের কাছে গভীরতর ধর্মশিক্ষা, নানা সংস্কার প্রস্তুতি গঠন, যুবা-বয়স্ক ধর্মশিক্ষা, অখ্রীষ্টানদের কাছে প্রথম প্রভুর বাণী ঘোষণা ইত্যাদি। তাদের এ কাজের উদ্দেশ্য হল অন্যদের কাথলিক বিশ্বাসে গড়ে তোলা, কাথলিক বিশ্বাসে শিক্ষাদানের নির্দেশনা দান করা আর এভাবেই তারা যেন যিশুর জীবনে গঠিত হয়ে পবিত্র ত্রিত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। বর্তমান যুগে সংলাপসুলভ ব্যাখ্যা মানুষের স্বাধীনতার মূল্য দেয় এবং তা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। এর মাধ্যমে বিশ্বাস জাগ্রত করা ও ভক্তদের অন্তরে পুষ্টি সাধন করা সম্ভব হয়। তারা যেন প্রতিদিনের প্রার্থনা ও ধর্মকর্মের তাৎপর্য উপলব্ধি করে ও সেসবের গভীর স্বাদ উপলব্ধি করতে পারেন ।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটু পিছন ফিরে তাকাতে চাই কী করে উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর দিনাজপুরে (বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশসহ) যথাযথ বাণী প্রচার লক্ষ্যে- কাটেখিস্টদের সযত্ন গঠন প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়েছে। সময় সুযোগ ও পরিবেশ বুঝে বাস্তবতা বিবেচনা ক’রে ধাপে ধাপে তাদের জন্য কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যেন তারা অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ ধর্মপ্রচারক হতে পারেন।

দুই পর্যায়ে এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পর্বে দিনাজপুর কাথিড্রাল এলাকায় ও পরে দ্বিতীয় দলে দিনাজপুরের মারিয়ামপুর ধর্মপল্লীতে ।

* (ফাদার সুশীল লুইস পেরেরার লেখা  “রাজশাহী ও দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের কাটেখিস্টদের প্রথম যুগের যৌথ গঠন প্রশিক্ষণ” এই শিরোনামে তিনটি অংশে ধারাবাবিক ভাবে বরেন্দ্রদূত অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। পাঠকগণ আমাদের সাথেই থাকুন।)

Please follow and like us: