ফাদার সুশীল লুইস পেরেরা
১ম পর্যায়
প্রথম দল: ১৯৬৮-১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ- প্রথম দলের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন স্বর্গীয় ফা. মাংকা, পিমে। দিনাজপুর কাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক সুপরিচিত, নিবেদিপ্রাণ কাটেখিস্ট এতে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম দল: রামবাবু, হারুণ খালকো, লরেন্স মুরমু, যোসেফ হাসদা, ফাদার সামসনের বাবা যোসেফ মারান্ডী, ফ্রান্সিস তপ্ন প্রমুখ। তারা সে যুগে বড় গির্জার উত্তর পাশে পেসে হাউসে থাকতেন। খ্রিস্টযাগে প্রস্তুতিসহ তাদের বাইবেল পড়া (পাঠ) দেখে অনেকে উৎসাহিত হতেন। তাদের মত হলে তারাও একদিন পবিত্র বাইবেল পড়তে পারবেন। শুনেছি রামবাবু, হারুণ খালকো, ধর্মীয় বিষয়ে ৩ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলেন। এদলে ২-৩ জন সিস্টার ছিলেন। আর প্রশিক্ষণ শেষে তারা বিভিন্ন স্থানে চলে যান। যেমন লরেন্স মুরমু ধানজুড়ি, যোসেফ মরমু রহনপুর, রামবাবু মারীয়ামপুর, ফ্রান্সিস তপ্ন বেনীদয়পার, হারুন খালকো বলদিপুকুর। তারা অনেকে সার্বক্ষণিক কাটেখিস্ট ছিলেন বা পরে সেরূপ হয়ে মণ্ডলি ও সমাজে অনেক অবদান রাখেন।
লরেন্স মুরমু- ৭০ থেকে ৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধানজুড়ি মিশনে ছিলেন আর পরে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে আন্ধারকোটা মিশনে আসেন পালকীয় কাজ করতে। তিনি সার্বক্ষণিক ধর্মপ্রচারকরূপে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বৃহত্তর আন্ধারকোটা ধর্মপল্লীতে প্রচার কাজ করতে থাকেন। তিনি সেযুগে তার প্রচার কাজে নানাভাবে অবদান রেখে বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক সহায়তা করেছিলেন। পরে আন্ধাকোটা থেকে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুরশুনিপাড়া মিশন ভাগ হয়ে গেলে তিনি সেখানে সার্বক্ষণিক ধর্মপ্রদেশীয় কাটেখিস্ট হিসেবে স্থায়ীভাবে বাস করতে যান ও মিশনের পূর্বদিকে ফুলবাড়ী গ্রামে বাড়ী করে আমৃত্যু সেখানে থাকেন । তিনি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি ঈশ্বরের কোলে চির আশ্রয় নেন। হারুণ খালকো বলদিপুকুর ও অন্যান্য এলাকায় বাণী বিস্তারে সেবাকাজ করেছেন। রামবাবু মারিয়ামপুর ধর্মপল্লীতে দীর্ঘদিন সেবাকাজ ক’রে পরবাসী হয়েছেন। প্রভু ঈশ্বর তাঁদের এবং বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচার কাজ ক’রে যারা অনন্ত যাত্রা করেছেন, পরিচিত অপরিচিত প্রত্যেককে অনন্ত শান্তি দান করুন।
এটি হয়ে যাবার পর বিভিন্ন কারণে ২য়টি হবার আগে মাঝখানে কিছু দিন বিরতি ছিল। ৩ বছর করে ২ দলের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এর পরে আর সেখানে সেভাবে প্রশিক্ষণ হয়নি।
২য় দল: ১৯৭৪- ১৯৭৬ পর্যন্ত চলে এ প্রশিক্ষণ।
২য় দল পরিচালনা করেন স্বর্গীয় ফা. চেজারে পেসে, পিমে। সে প্রশিক্ষণে ভারতীয় ধর্মশিক্ষার বই “পরিপ্রশ্ন” বেশী পড়ানো হত। আর পরিচালক সেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দানের জন্য আগাগোড়া এ বই ব্যবহার করতেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে দিনাজপুর বিশপ ভবনে কাটেখিস্টদের লম্বা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বার্নাবাস হাঁসদা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের রজত জয়ন্তী স্মরণিকায় নিজে লিখেন: “প্রশিক্ষণের শুরুতে ৪ জন সিস্টার ২ জন যুবতী এবং বিভিন্ন ধর্মপল্লী হতে ২৫ জন যুবক ছিলাম। প্রশিক্ষণের ২ মাসের মধ্যে ভাল ভাল যুবকেরা চলে যেতে লাগল। অবশেষে প্রশিক্ষণ শেষে ৮ জুলাই ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিস্টার ও দিদিমণি ছাড়া মাত্র ১০ জন যুবক টিকে থাকলাম। আমরা দলে ছিলাম- সিস্টার কস্তানতিনা রায় (এসসি), সিস্টার অলিভিয়া লাকড়া (সিআইসি), সিস্টার মার্থা সরেন (সিআইসি), সিস্টার ভিনসেন্সা মণ্ডল (এসসি), তেরেজা মার্ডী মেয়ে হিসেবে নাম ছিল পরে তিনি সিস্টার হন এবং নাম নেন মনিকা (সিআইসি), ফ্রান্সিস কুজুর, মসেস সরেন (পরে ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ নেন), মারকুস বাস্কে, যোসেফ হাসদা (সুইহারী), পিটার বিশ্বাস (ঝরা গোপালপুর), ফিলিপ কিসপট্টা (পাথরঘাটা), লরেন্স জেঠা মাস্টার (চানপুকুর), অরূপ রিচার্ড হালদার (খুলনা শেলাবুনিয়্), উইলিয়াম মহন্ত (খুলনা শেলাবুনিয়া), বার্নাবাস হাঁসদা (নিজপাড়া আর পরে রহনপুর)।” (পৃষ্ঠা ১৩৯)।
চ্যারিটি সম্প্রদায়ের সিস্টার কস্তানতিনা রায়, সিস্টার ভিনসেন্সা মণ্ডল; শান্তিরাণী সম্প্রদায়ের সিস্টার অলিভিয়া লাকড়া, সিস্টার মার্থা সরেন প্রশিক্ষণে নানাভাবে ফাদারকে সাহায্য করতেন। তবে সিস্টার ভিনসেন্সা মণ্ডল ফাদারকে কিছুটা সাহায্য করতেন তার শিক্ষার বিষয়বস্তু বাংলায় রূপান্তর করতে। সিস্টারগণ তাদের নিজেদের বাড়ীতে থাকতেন কনভেন্টে। মেয়েরাও হোস্টেলে থাকেতন। পুরুষগণ ফাদারের দালানের উপরের ঘরে থাকতেন, নীচের হলে ক্লাস হতো। অবশ্য কাথিড্রালের উত্তরের ঘরেও থাকতেন, কারণ সেটা কাটেখিস্টদের দালান হিসেবেই ব্যবহৃত হত ও হল ঘরে ক্লাস করতেন।
এ প্রশিক্ষণে বাইবেল পড়াতেন ফা. রোসকোনি পিমে ও মণ্ডলির ইতিহাস পড়াতেন বিশপ থিও। ফা. ভেরপেল্লীও মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস করাতেন।। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফা. লিও দেশাই সেমিনারীতে থেকে এদের ধর্ম বিষয়ে কিছু ক্লাস করাতেন। সেখানে তাদের পবিত্র বাইবেল ও ধর্ম বিষয়ে শিখানো হতো বেশী। তা ছাড়াও মাণ্ডলিক আইন, নৈতিকতা, উপাসনা প্রভৃতি বিষয়ে গঠন দেয়া হতো। অবশ্য সেখানে ইংরেজিও শিক্ষা দেয়া হতো সময় নিয়ে। ফাদার পিনুস পিমে বিভিন্ন স্থানে ও সময়ে ক্লাস করান। আগে আরো অনেকে নানা স্থান থেকে এসে ক্লাস করাতেন। তেইজে ব্রা. জ্যাকও সেখানে ক্লাসের জন্য গেছেন। বরিশাল থেকে রবি গমেজ ও অন্যান্য স্থান থেকে আরো অনেকে সেখানে ক্লাসের জন্য গেছেন।
এ প্রশিক্ষণ-একটানা ২ বছরের জন্য অনুষ্ঠিত হতো, তবে মাঝে মাঝে বিরতি ও ছুটি ছিল কোন কোন সময় বা উপলক্ষ্যে। মাঝখানে ফা. লুইজি ভেরপেল্লী স্বর্গবাসী হন চানুপুকুর মিশনে জলে ডুবে।
প্রতি রবিবার ক্লাস ছুটি থাকতো। শনিবার বিকেলে তারা অন্য মিশনের গ্রামে যেতেন ও রবিবারে প্রার্থনা পরিচালনা ক’রে তবে তারা রবিবার বিকেলে কেন্দ্রে ফিরে আসতেন কারণ সোমবারে সকালে পরের সপ্তাহের ক্লাস শুরু হতো। এভাবে তারা রবিবারগুলিতে অনেক গ্রামে গিয়েছেন, মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছেন এবং অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
এই প্রশিক্ষণের এক বিশেষত্ব ছিল যে, কখন কখনও বেশী সময়ের জন্য (১ সপ্তাহ) সেখানকার অংশগ্রহণকারীগণ দলে দলে আশেপাশের গ্রামে যেতেন, সেখানে থাকতেন, রবিবার প্রার্থনা চালাতেন। সেভাবে তাদের গ্রামের কিছুর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা হতো। তারা সবার সামনে দাঁড়াতে ও কথা বলতে পারতেন। সেসবে সিস্টারগণ থাকতেন এক দলে এবং অন্যরা থাকতেন অন্য দলে।
জানা যায় প্রথমে এ গঠন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ২৫ জন। এ কর্মসূচী যখন শেষ হয় তখন ১০ জন পুরুষ, ৪জন সিস্টার ও ২ জন মহিলা নিয়ে মোট সেখানে ছিল ১৫ জন। বাকীরা নিজেদের সুবিধামত সময়ে নিজের পথে চলে যায়।
ঘটা করে প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান বিষয়ে অংশগ্রহণকারী বার্নাবাস হাঁসদা নিজেই এভাবে লিখেন: “অবশেষে ৮ জুলাই ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ দিনাজপুর ক্যাথিড্রাল গির্জায় বিকাল ৪টায় বালুবাড়ী, গনেশতলা, সুইহারী, লিটিল ফ্লাওয়ার, সেন্ট যোসেফ মাইনর সেমিনারী, সেন্ট ফিলিপস বোর্ডিং ও ক্যাথিড্রাল প্যারিস-এর ভক্তজনগণসহ বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টভক্তের উপস্থিতিতে তৎকালীন বিশপ পরম শ্রদ্ধেয় মাইকেল রোজারিও মহাখ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন। তাকে সহায়তা করেন আমাদের প্রশিক্ষক ডিরেক্টর নমস্য ফাদার চেসারে পেসে এবং উপস্থিত ছিলেন ১৭ জন ফাদার। মহাখ্রিস্টযাগে বিশপ মহোদয় আমাদের প্রত্যেককে কাথলিক পবিত্র বাইবেল, স্বর্ণক্রুশ ও সনদপত্র প্রদান করেন এবং বাণী প্রচারক হিসেবে মনোনীত করেন। এ মহতী অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল ভক্তজনগণের জন্য ঐশ কৃপা লাভের এবং বাণী প্রচার কার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়বদ্ধতা স্বরূপ। ” (উপরোক্ত পৃ. ১৩৯-১৪০) প্রশিক্ষণ শেষে যুগের প্রয়োজন, বিভিন্ন মিশনের চাহিদা, ফাদারগণের অনুরোধ, প্রচার কাজের তাগিদ, বাস্তবতা প্রভৃতি অনুসারে এক এক জন একেক স্থানে সেবাকাজ করতে থাকেন নিজেদের সুবিধা অনুসারে। কেউ বেশী সময় কেউ কম সময় প্রচার কাজ করেন নিজের মিশনে বা অন্যত্র।
যারা ধর্মপ্রচারকের প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তাদের অনেকে মাত্র নির্দিষ্ট সময় প্রচার কাজ ক’রে বা হতে পারে কিছু বছর এ কাজ ক’রে তা বাদ দেন। জানা যায় যে, মসেস সরেন (দিনাজপুর) ফিলিপাইনের জাম্বুয়াঙ্গা গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। পরে ফিরে এসে বিভিন্ন স্থানে সেবাদান করেন শেষে সিংড়া আশ্রমে কিছু বছর সেবাকাজ করে বর্তমানে অবসরে আছেন। আরো জানা যায় যে, ঠাঁকুরগাঁও মিশনের গুপেন বাস্কে, ঝরা গোপালপুরের পিটার বিশ্বাস ও রহনপুরের বার্ণাবাস তাদের প্রচারকের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আর অন্য সকলে একাজ বাদ দিয়েছেন।
কাটেখিস্টদের বার্ষিক নবায়ন প্রশিক্ষণ ও নির্জনধ্যান- সার্বক্ষণিক কাটেখিস্টদের প্রতিবছর কোন বিষয় নিয়ে ১৫ দিন নবায়ন প্রশিক্ষণ হতো পরে ৩ দিনের নির্জন ধ্যান হতো ভস্ম বুধবারের ঠিক আগে। আর তার পরেই তারা মফঃস্বল শুরু করতেন। এটি নিয়মিত চলতো। পরে আস্তে আস্তে তা কয়েক বছর বাদ পড়ে বা নামমাত্র কয়েক দিন হয় ফা. যোসেফ মুরমুর সময়। কিছুবার তা বুলাকিপুর, সিংড়া, পালকীয় কেন্দ্র ও বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। পরে অনেক আলোচনার পর নির্জন ধ্যান দুবার হয়।
এ ধারাবাহিকতায় প্রথমদিকে রাজশাহীতে কিছুদিন এ কার্যক্রম চলতে থাকে। মাঝে মাঝে বাদ পড়ে মাঝে মাঝে কয়েক দিন নির্জন ধ্যান হয়। তবে সংক্ষেপে বলতে হয় এ ক্ষেত্রে বেশ অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে তাই আরো জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল আর আছে।
অবশ্য আমাদের অনেকে যশোর প্রশিক্ষণ নিতে যায় ও সেভাবে শিক্ষা লাভ ক’রে সার্বক্ষণিক ও খন্ডকালীন কাটেখিস্ট হন। আর কেউ কেউ অন্য কোথাও প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকতে পারেন।
ফা. লিও দেশাই ৩ বার মারীয়ামপুর যান: প্রথমবার ১৯৭৫, দ্বিতীয় বার ১৯৮৩ ও তৃতীয় বার ২০০০ খ্রিস্টাব্দে। শেষবার তাকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মনোনয়ন দেয়া হয় কিন্তু সেখানে তিনি যান ২০০১ খ্রিস্টাবে। ফা. পিনুস মারা গেলে তার দেহ আগের দিন রাতে দিনাজপুর সেমিনারীর চ্যাপেলে রাখা হয় ও পরের দিন কাথিড্রালে নেয়া হয়। সেসময় পর্যন্ত ফা লিও সেখানেই (জ্ঞান সাধনে) ছিলেন। আরো পরে ফা. কার্লো মেনাপাসে কাটেখিস্টদের পরিচালনার দায়িত্ব পান। তিনি তাদেরসহ নির্জন ধ্যান ও প্রশিক্ষণ চালাতেন।