ফাদার সুশীল লুইস পেরেরা
২য় পর্যায়: মারীয়ামপুর
১৯৮৩ তে চিঠি দিয়ে প্রচার করা হয় আর ১৯৮৪ তে ক্লাস শুরু করা হয় ৩ মাস করে। মাঝে মাঝে ছুটি রেখে মোট ২ বছরে ৯ মাস ক্লাস করা হয়। এভাবে প্রথম দলের প্রশিক্ষণ শেষ হয় ১৯৮৫ তে। ফা. লিও (অভিষেকের পর প্রথম নিয়োগ পান বোর্ণী, পরে বনপাড়া ও শেষে মারিয়ামপুর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে, রোম থেকে ফিরে এসে মারীয়ামপুর যান ও এ ক্লাসে ফা. মেনাপাসেকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দেন। ফা. মেনাপাসে ট্রেনিং ছিল না বলে সিস্টারদের বাদ দেন কাটেখিস্টের কাজ থেকে। ফা. মেনাপাসের সময় শুরু হয় সান্তালদের মধ্যে যারা কাজ করেন তাদের কয়েকজনকে কিছু দিনের জন্য ডুমকার দুধানী নামক স্থানে কলকুয়েমে পাঠানো। আগে যারা কাজ করত তাদের সবাই সেখানে যেতে পারত তবে বর্তমানে শুধু সান্তালরা সেখানে যান। ফা. লিওর মাধ্যমে জানা যায় প্রথমবার ক্লাসে ১৪/১৫ জনের মত ছিলেন। এর মধ্যে ৫ জন শান্তিরাণী সিস্টার ছিলেন; যেমন: সিস্টার লিনা, সি. গরেটি, সি. ফেলেসিতা, সি. জ্যোতি এবং অন্য আরো কয়েকজন খ্রিস্টভক্ত ছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে। এ প্রশিক্ষণের প্রধান বিষয় ছিল পবিত্র বাইবেল ও সাথে উপাসনা, মণ্ডলির ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়। প্রথম দিকে প্রতিদিন ৬ ঘন্টা করে শিক্ষা দেয়া হতো। সকালে ৪ ঘন্টা ও বিকালে ২ ঘন্টা ক’রে। এ প্রশিক্ষণে ফা. মেনাপাসে পিমে, ফা. লিও দেশাই নিয়মিত ক্লাস করাতেন, সঙ্গে বাইরের অনেকে তাতে সহায়তা দিতেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দেশীয় ব্যক্তিও ছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল যেন দেশের কয়েকজন এ সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। ফা. আরতুরো পিমে একবার হিন্দু শাস্ত্র পড়াতে সেখানে গিয়েছিলেন। ফা. পল রোজারিও ও ক্লাস করিয়েছেন। আমি নিজেও সেখানে ক্লাসের জন্য গিয়েছি। ১৯৮৫তে এটি শেষ হয়, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর. ফা. লিও আন্ধারকোটা চলে আসেন। পরে ফা. মেনাপাসে, পিমে, কয়েকবার সে প্রশিক্ষণ চালান। আর এভাবেই তা ১৯৮৯/৯০ পর্যন্ত চলে। পরে যখন কেউ ছিল না তখন ফা. পল রোজারিও ক্লাস, নির্জন ধ্যান প্রভৃতি দেখতে থাকেন। তিনি বেশ দক্ষতার সাথে অনেক বছর এ দায়িত্ব পালন ক’রে বাণী প্রচারকদের শিক্ষা গঠন ও পরিচালনা দিয়েছেন।
এই প্রশিক্ষণের এক বিশেষত্ব ছিল যে, আগের মত প্রতি শনিবার সেখানকার অংশগ্রহণকারীগণ আশেপাশের গ্রামে যেতেন। সেভাবে তাদের গ্রামের কিছু অভিজ্ঞতা হতো। তারা সবার সামনে দাঁড়াতে ও কথা বলতে, সহভাগিতা করতে পারতেন। ফা. লিও ২০০০ এ মারিয়ামপুর যাওয়া পর্যন্ত সেভাবেই চলে।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফা. লিও দিনাজপুর যান ও ১৯৯০ থেকে দিনাজপুর জ্ঞান সাধনে এ প্রশিক্ষণ চালাতে থাকেন। সেখানে বছরে ৩ মাস ক’রে ২ বছরে ৬ মাস ও ৩ বছরে ৯ মাস ক’রে তা শেষ হতো। পরে তা মাথা সাগরের পালকীয় কেন্দ্রে চলতো। ১ম বছর, ২য় বছর, ৩য় বছর ভাগ ভাগ ক’রে বাইবেল পড়ানো হতো, মণ্ডলির শিক্ষা ভাগ করে পড়ানো হতো। ফা. যোসেফ মুরমু এ সব বিষয়ে কিছুটা জড়িত ছিলেন। সেভাবে ভাগ করে উপাসনা, ভাটিকান দলীল প্রভৃতি বিষয় পাঠদান করা হতো। অনেক উৎসাহ আগ্রহ নিয়ে সেসব করা হতো। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় টাকা নেয়া হবে না কোন প্যারিসকে এ বিষয়ে খরচ দিতে হয়নি। পরে বিশপ মসেস কিছু খরচ চান, তাই তা দুর্বল হয়। মাঝে মাঝে তা কিছু দিন বন্ধ ছিল। তবে তা না চলার পরিস্কার কারণ জানা যায়নি। ২০১৪ থেকে ১০/১২ ব্যক্তি নিয়ে পুনরায় তা মাথা সাগরের পালকীয় কেন্দ্রে শুরু করা হয় ফা. বিদ্যার পরিচালনায়। অবশ্য জানা যায় না তা কেমন চলছিল। কত দিন চলে তাও পরিস্কার জানা যায়নি। টাকা ধরে তাই অনেকে আসে না। তাছাড়াও দেখতে হয় কে প্রশিক্ষণ আয়োজন করে, চালায়। অনেকবার সে ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য হলে লোক আসে অন্যথায় কম লোক আসে বা কয়েকবার কর্মসূচী ভাল চলে না। সেসব বিষয় ও বিবেচনায় আনতে হবে। উপরের কাটেখিস্ট কর্মসূচী কিন্তু দিনাজপুর রাজশাহীর জন্য খুব সুন্দর ফলাফল এনেছে। তারা ফিরে গিয়ে নিবেদিত হয়ে অনেক চেষ্টা ক’রে নানাভাবে কাজ করেছেন। তাদের সেসব কাজের ফলে ধর্ম বিস্তার এসব শিক্ষা তাদের জন্য অনেক উপকার আনে। তাদের অনেক বিষয়ে লেখাপড়া করতে হয়। তারা অনেক বিষয়ে ধারণা ও অভিজ্ঞতা পায় যা পরে তাদের অনেক সহায়তা করে। মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা, অনুভূতি গভীর হয়েছে। তাদের সেসব কাজের ফলে ধর্ম বিস্তার হয়েছে মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা ও চেতনা জোরালো হয়েছে। তাদের অনেক অবদান- সেসব গুরুত্বসহ দেখতে হবে।
ধর্মপ্রদেশ হবার আগে ভিকারিয়া পর্যায়ে কাটেখিস্ট প্রশিক্ষণ হতো বলদিপুকুর, রুহিয়া প্রভৃতি স্থানে। বেশীর ভাগ সময় এ দু স্থানেই হতো। এভাবে অনেক নূতন ফাদার ও সে প্রশিক্ষণে ক্লাস নিত, যেন তারাও শিখতে পারে।
ভক্ত জনগণের জন্য যেন কিছু করা হয়- জনগণের গঠন টাকা ছাড়া করা। তাদের জন্য কিছু খরচ করতে হবে। ফাদারদের জন্য কত খরচ করা হয়, ভক্ত জনগণের কাছ থেকে কত চাওয়া হয় তাদের বেশী দেওয়া হয় না, সর্বদা চাওয়া হয়। কত দালান, প্রতিষ্ঠান তেরী করা হয় কিন্তু ঐ তুলনায় কর্মী বা সেবক মানুষ তৈরী হয় কি? এটি একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটি নিয়ে সবাইকে বার বার ও গভীর চিন্তা করতে হবে।
রাজশাহীতে অনেক চেষ্টায় মাত্র দুবার (২০০৯ ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে) কয়েক মাস ধ’রে এ কার্যসূচী চালানো হয়। তবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। যা হোক পরে তা আর করা সম্ভব হয়নি। তবে বড় প্রশ্ন হল: পরে কারা কাজ করবে যদি আমরা সঠিক মানুষ গঠন না করি? তাই জোরালো মতামত, প্রস্তাব ও আহ্বান হত যেভাবেই হোক সবার আলোচনা, পরামর্শ, পরিকল্পনা ও সহায়তায় এ কর্মসূচী যেন নূতন করে বার বার চালানো হয়। কাটেখিস্টদের জোরালো অবদান ও প্রভাব আমরা কোনভাবেই অবহেলা করতে পারব না।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ ২৯তম বছর অতিক্রম করছে, কয়েক বছর তার রজত জয়ন্তী পালন করা হয়েছে। ধর্মপ্রদেশের জন্য পুরোহিত, সিস্টার, কাটেখিস্ট, প্রার্থনা পরিচালক ও বিশ্বাসী ভক্তজনগণের অবদান রয়েছে তা অনস্বীকার্য। ধর্মপ্রদেশের ২৯ বছরের পথচলায় সকলের অবদানের জন্য প্রত্যেকেই আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে তাই জানাই শত প্রণাম। তবে কথা হল বর্তমানে কাটেখিস্টদের জন্য যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় বা অনেক ব্যক্তি তাতে অংশগ্রহণ করে না। ফলে তাতে অংশগ্রহণ ও অবদানও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
কাটেখিস্ট বার্নাবাস হাসদা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের রজত জয়ন্তী স্মরণিকায় অনেককে কাটেখিস্টের সেবা দায়িত্বে আহ্বান জানিয়ে নিজে লিখেন: “বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে প্রত্যাশা: ধর্মপ্রদেশের ৫০ বছর অর্থবহ জুবিলীর জন্য ভক্তজনগণের তথা কাটেখিস্ট, প্রার্থনা পরিচালকদের গঠন প্রশিক্ষণ একান্তভাবে জরুরী। গঠনগৃহে যাজকগণই যাজক প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
কাটেখিস্টগণই কাটেখিস্টদের, প্রার্থনা পরিচালকদের গঠন দিবেন। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ কাটেখিস্ট তথা প্রশিক্ষিত কাটেখিস্ট। যাজকগণ মণ্ডলিকে বিশ্বাসের ভিত্তি জাগিয়ে তুলবেন। আমরাও তরুণ যুব বয়সে কাটেখিস্ট হয়েছিলাম। সকল কাটেখিস্টদের পক্ষ হতে তরুণ/যুবাদের আহ্বান জানাই। তোমরা এগিয়ে এসো যাজকদের সঙ্গে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশকে সুন্দরভাবে সাজাই।” (পৃ. ১৪০)। সত্যিই অনেক শিক্ষিত যুবককে এ পথে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের উপর মণ্ডলি অনেক ভরসা রাখে।
ভবিষ্যতের জন্য কিছু চিন্তা ও প্রস্তাব- দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার খ্রিস্টমণ্ডলির প্রেরণকার্য বিষয়ক নির্দেশ নামা ১৭ অনুচ্ছেদ বলে: “ধর্মশিক্ষাদান পদ্ধতি ও বাস্তব পালকীয় কাজ সম্পর্কেও তারা অধ্যয়ন করবেন; আর একই সময় খ্রিস্টভক্তদের জীবন-আদর্শে নিজেদের গঠন করবেন এবং অক্লান্তভাবে জীবনের পবিত্রতা ও ভক্তির অন্বেষণ করবেন। সময় সময় সম্মেলন ও শিক্ষা- প্রবাহের ব্যবস্থা করা উচিত, যেখানে ঐ সমস্ত বিজ্ঞান ও দক্ষতা সম্বন্ধে ধর্মশিক্ষকদের আধুনিকীকরণ করা হবে যা তাদের সেবকর্মের জন্য প্রয়োজনীয়, আর সেখানে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন পরিপুষ্ট ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া, যারা একাজে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে নিয়োগ করেন, ন্যায্য বেতন প্রদান ক’রে তাদের জীবন যাত্রার মার্জিত মান ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।” সকল চেষ্টায় এ প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে যে কোন মূল্যে। তা কোনভাবেই থামানো যাবে না। যত কষ্টই হোক না কেন যার দায়িত্ব আছে তিনি যেন সক্রিয়ভাবে এবিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আরো লম্বা সময় নিয়ে ভাল পরিকল্পনা করে, যুগোপযোগী ক’রে তা আয়োজন করতে হবে। কারণ মণ্ডলিতে তারা হলেন যাজকের প্রতিনিধি ও সাহায্যকারী। তাদের মাধ্যমে মণ্ডলির বিস্তার হতে পারে।
যারা তাদের প্রশিক্ষণে পাঠাবেন তাদের সাথে তারা যোগ রাখবেন তাদের খোঁজ নিবেন- সাহায্য করবেন। ঐ ব্যক্তি তার মনে থেকে কাটেখিস্ট হবার দৃঢ় ইচ্ছা রক্ষা করবেন। ঐ ব্যক্তিও তার মিশনের ফাদারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবেন। কাটেখিস্টরা একে অন্যকে কথা, প্রার্থনা, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। কেউ অসুস্থ হলে, মারা গেলে তারা নিজেরা চাঁদা তুলে তাকে সাহায্য করতে পারেন। কাটেখিস্টগণ ঈশ্বর ও মানব প্রেমে জীবন নিবেদন করবেন। কাটেখিস্টদের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকগণ হলেন আধ্যাত্মিক পরিচালকের মত- তাদের ভূমিকা তারা যেন সেভাবেই পরিচালনা করেন। যারা প্রশিক্ষণ চালাবেন তারা যেন শুধু করার খাতিরেই নয় তারা যেন মনপ্রাণ দিয়েই ভালবাসা ও দায়িত্ব সহকারে বার বার সেসব করেন। একই সাথে সবার সাথে ভাল যোগাযোগ রাখবেন তারা যেন মন খুলে তার সঙ্গে কথা বলতে ও পরামর্শ করতে পারেন।
উপসংহার– বর্তমান যুগে তাদের কাজ অনেক বেশী কারণ যাজক সংখ্যা অনেক কম, অন্যদিক অনেক ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা তত ভাল নয়। বিভিন্ন কারণে মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে ও দূরে দূরে বসবাস করে বেশী। তাদের ব্যস্ততাও বেশী। তাছাড়াও ভক্তদের সংখ্যা বেড়েছে আর সে সঙ্গে বেড়েছে তাদের নানা জটিলতা, সমস্যা ও প্রয়োজন। তাই নানা অগ্রগতির সঙ্গে সকল বাস্তবতা বিবেচনা ক’রে এরূপ ব্যক্তিদের জন্য আঞ্চলিক ও ধর্মপ্রদেশীয় প্রশিক্ষণ- প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা দরকার যেন তারা বাইবেল, উপাসনা ও ধর্মবিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করতে পারেন। অথবা উপযুক্ত কোন কেন্দ্রে তাদের নিয়মিত আধ্যাত্মিক ও ঐশতাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অতি জরুরী। যাতে তারা অনেক কিছু অর্জন ক’রে ঈশ্বর ও মণ্ডলির জন্য নানাবিধ সেবাকাজ করতে পারেন। তারা নিজেরা আদর্শ হবেন, ধর্মকর্ম করবেন ও সেভাবে নিজ জীবনে সকল শিক্ষা বাস্তবায়ন ক’রে অন্যদের সেপথে চালাবেন। তাদের ব্যক্তি জীবন থেকে যিশু-প্রচার শুরু হয়ে তা পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলির সকল প্রান্তে প্রসারিত হোক।