ফাদার সাগর কোড়াইয়া
এই প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া। মনের মধ্যে আলাদা কৌতুহল কাজ করছিলো। বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই ভিসা কার্যক্রম করতে হয়েছে। তবু ভয় কাজ করেছে। এই বুঝি ভিসা পেলাম না। যাই হোক, অবশেষে থাইল্যান্ডের ভিসা পেলাম। বাংলাদেশ থেকে আমরা তিনজন ফাদার ভাষা অনুবাদ কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা ভাষাভাষী একজন মহিলাও অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ভারত থেকে আরো চারটি ভাষাভাষী, পাকিস্তান, নেপাল, চীন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ফাদার, সিস্টার, সেমিনারীয়ান ও খ্রিস্টভক্ত অংশগ্রহণ করেন। এফএবিসি’র (ফেডারেশন অফ এশিয়ান বিশপস কনফারেন্স) সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের উদ্যোগে অনুবাদ কর্মশালার প্রস্তুতিস্বরূপ পূর্বেই আয়োজনকারী ব্যক্তিদের সাথে একাধিক অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়ে কর্মশালার বিষয়ে বিস্তর জানতে হয়েছে।
অনুবাদের বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। স্কুলে পড়াকালীন আমাদের বঙ্গানুবাদ শেখানো হতো। আর তখনই জানতে পারি, অনুবাদ দুইভাবে হতে পারে- ভাবানুবাদ ও আক্ষরিক অনুবাদ। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স পরীক্ষায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা বিষয়ে প্রশ্ন এসেছিলো। লেখালেখির ক্ষেত্রে এক ভাষাকে অন্য ভাষায় আকৃতিদানের একমাত্র পথ হচ্ছে অনুবাদ। বিশ্বসাহিত্যে অনুবাদ আরো বেশি চর্চিত ও জনপ্রিয়। অনুবাদকে শিল্প ও সাহিত্যের আদি অবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক সময় কবিরা মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনী ও লোকায়ত ধর্মের মর্মকথা ছন্দাকারে প্রকাশ করেছেন যা আসলে এক প্রকার অনুবাদ কর্মই বলা চলে। তবে ভাষান্তর করলে আমরা অনেকে একে অনুবাদ বলে ভুল করে থাকি। চিন্তা-চেতনার অনুবাদ হয়। ভাষা শুধুমাত্র এর অবয়ব দেয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের লেখার ভাষান্তরিত চেতনাস্বাদ লাভ করে অন্য প্রান্তের পাঠকের মননে জ্ঞানের সমৃদ্ধি শুধু অনুবাদের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
বলে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ মণ্ডলীতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ হয়েছে। বিশেষ করে কাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা, দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিল ও জুবিলী বাইবেল অনুবাদের কাজটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই তিনটির মধ্যে জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ ততটা সুখপাঠ্য নয় বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। আগে ও পরে আরো বেশ সংখ্যক বইয়ের অনুবাদ হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। বিশেষ করে দেশীয় ফাদারদের মধ্যে ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি, ফাদার বার্ণার্ড পালমা, কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও’র সাথে আরো অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য।
মাণ্ডলিক বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে পোপীয় চিঠি, বাণী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশ ও কমিশনের সাথে যুক্ত ফাদারগণ ভূমিকা রাখছেন। এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা থেকেই অধিকাংশ অনুবাদ হয়ে থাকে। ল্যাটিন ও ইটালিয়ান ভাষা থেকেও কিছু লেখা সরাসরি অনুবাদ করা হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও পোপীয় পত্র ও মাণ্ডলিক সমসাময়িক সংবাদের বাংলা অনুবাদ বরেন্দ্র দূত অনলাইনে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করছেন। বিদেশী ফাদারদের মধ্যে সিলভানো গারেল্লো ও আরতুরো, পিমে’র অনুবাদ কাজ বাংলাদেশ মণ্ডলীর জন্য সম্পদস্বরূপ। আরো অনেক বিদেশী ফাদার অনুবাদের কাজে যুক্ত ছিলেন; এক্ষেত্রে ফাদার লুইজি পিনোস ও মারিনো রিগ্যানের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমার ধারণা, অনুবাদ কাজে বাংলাদেশ মণ্ডলী এখনো অনেকদূর পিছিয়ে আছে। আর এই উপলব্ধি এসেছে কর্মশালায় বিভিন্ন দেশ থেকে অংশগ্রহণকারীদের অনুবাদকর্ম দেখে। অনুবাদ প্রসঙ্গে তাদের ধারণা, দক্ষতা, অধ্যবসায়, পড়াশুনা ও পুস্তকের প্রাচুর্য তাদের মণ্ডলীর অনুবাদকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশের ফাদারগণ বাদেও খ্রিস্টভক্তগণকে দেখলাম তারা বিভিন্ন পড়াশুনার পাশাপাশি মাণ্ডলিক দলিলপত্র ও লেখা প্রতিনিয়ত পড়েন। বাংলাদেশে আমরা উপলক্ষ্য দেখে অনুবাদ কাজ করছি ঠিকই কিন্তু অনুবাদকর্মের আনন্দ নিয়ে মাণ্ডলিক প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করতে হয়তোবা প্রচেষ্টা শতভাগ প্রয়োগ করছি না। অবশ্য এটাও সত্য যে, অনুবাদকর্ম সহজ একটি কাজ নয়। অনুবাদের জন্য ব্যক্তি নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ খ্রিস্টান বাংলা ভাষাভাষী হওয়ায় বাংলা অনুবাদকর্ম একসাথে করতে পারলে বাংলা ভাষা অনুবাদে সমৃদ্ধি আসবে। এইদিক দিয়ে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশ মণ্ডলী অনুবাদকর্মে ইতিমধ্যে অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র বাংলা ভাষায়ই নয়; বরং অন্যান্য আদিবাসী ভাষায় মাণ্ডলিক অনেক প্রকাশনা বাংলা থেকে অনুবাদ করা হচ্ছে। কয়েকদিন পূর্বে ফেসবুকে দেখলাম ত্রিপুরা ভাষায় খ্রিস্টযাগ কাঠামো রীতি অনুবাদ করে ত্রিপুরা আদিবাসী খ্রিস্টানরা নিজস্ব ভাষায় খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করছে। আনন্দের বিষয়- বাংলাদেশে সান্তাল (হড়), উঁরাও ও গারো (মান্দি) আদিবাসীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বাইবেল রয়েছে। এছাড়া কয়েক বছর যাবৎ সিল বাংলাদেশের সহায়তায় মাহালী ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজ করা হচ্ছে। দুঃখের বিষয়- আদিবাসী ভাষাগুলোর নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় এই অনুবাদ কাজ করতে হচ্ছে রোমান ও বাংলা হরফ ব্যবহার করে।
ব্যাংককে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রায় প্রতিটি ভাষাভাষীর মধ্যে একটি বিষয় উঠে এসেছে যে, মাণ্ডলিক অনেক শব্দ নিজস্ব ভাষায় এখনো পর্যন্ত অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি। ল্যাটিন বা ইংরেজি ভাষার শব্দাবলীর মধ্যেই এখনো আমরা ঘুরাফেরা করছি। এটাকে ভাষার অপ্রাচুর্যতা ও অপ্রতুলতা বলা যেমন ঠিক তেমনি চেষ্টার অভাব বললেও অত্যুক্তি হবে না। আবার বলা যায় যে, নিজস্ব ভাষার শব্দ ব্যবহার করলে অনেক শব্দ অর্থবোধক হয়ে ওঠে না। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট। বাংলায় একটি শব্দের একাধিক সমার্থক শব্দ থাকলেও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। বরং উৎস শব্দটিই সবার নিকট অর্থবোধক হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ‘সিনোডালিটি’ শব্দটি উদাহরণ হতে পারে। আমরা এর বাংলা করেছি ‘একসাথে পথচলা’। তবে সিনোডালিটি শব্দটিই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অন্যদিকে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ দাঁড়াতে পারে; যেমন চার্চ অর্থ গির্জাঘর, মণ্ডলী, খ্রিস্টযাগ, মিশন, খ্রিস্টান সম্প্রদায়। আবার একই শব্দ অঞ্চলভেদে আলাদা অর্থ দাঁড়ায়; যেমন যাজক, পাদ্রী, ফাদার, পুরোহিত, স্বামী ও আচার্য। অনুবাদ আমরা যেভাবেই করি না কেন সে ক্ষেত্রে কৃষ্টি-সংস্কৃতি, অর্থ, গ্রহণযোগ্যতা, বোধগম্যতা, ভাষার মাধুর্য, সুখপাঠ্য ও শ্রুতিমধুর বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতে হয়।
অনুবাদ এক জগতের আলোকে অন্য জগতের সাথে মিশিয়ে দেয়। এক ভূমির সুস্বাদু বৃক্ষকে অন্য ভূমিতে রোপণ করে সেই ফলের স্বাদ অন্যকে প্রদান করে অনুবাদ কাজ। অনুবাদের ক্ষেত্রে উৎস-ভাষার আভিধানিক অর্থ জানাই যথেষ্ট নয়। অঞ্চলভেদে এমনকি সময়ভেদেও শব্দের প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক অর্থও জানতে হয়। একই ধরনের দুটি শব্দ পুরোপুরি ভিন্ন অর্থ বোঝাতে পারে। সান্তাল আদিবাসীদের গির্জা বললে তারা খ্রিস্টযাগ আর গির্জা করা বলতে খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণকেই বুঝে থাকে। এই কারণে অনুবাদ কেবল ভাষাগত বিষয় নয়, সাংস্কৃতিক বিষয়ও বটে। অনুবাদ কাজ ভাষা থেকে ভাষায় রূপান্তর শুধু নয়; পাশাপাশি নিজের ভাষার আদ্যপান্ত যেমন জানা দরকার তেমনি যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হচ্ছে সেই ভাষা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ মণ্ডলীর সবচেয়ে বড় ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যাপিঠ হচ্ছে বনানী সেমিনারী। এখানে রয়েছে বিশাল লাইব্রেরী। বিশ্বের অনেক ভাষার বইয়ের ভাষার বলাটা অত্যুক্তি হবে না। তবে ভাষা জানা না থাকায় বইগুলো অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা শুধু এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই নয় বরং দেশীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের সর্বত্রই বিদ্যমান। বিদেশী ভাষার প্রতিই আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। ফাদার সিলভানো গারেল্লো জীবিত থাকাকালীন যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে তিনি বলতেন, ’বাপু, বনানী সেমিনারীতে তোমাদের ইংরেজিতে পড়িয়ে কি হবে। তোমরা তো বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সাথে কাজ করবে’। কথাটি একান্ত সত্য! তবে পাঠ্যপুস্তকের বাংলা অনুবাদ না থাকায় হয়তো সে পরিস্থিতি হচ্ছে। বনানী সেমিনারীর খ্রিস্টমণ্ডলীর ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক ফাদার দিলীপ এস. কস্তা সেমিনারীয়ানদের সহায়তায় অনুবাদ কাজটি সম্পন্ন করে লাইব্রেরীতে রাখছেন; যা বাংলা অনুবাদকর্মকে সমৃদ্ধ করছে। তবে অনুবাদগুলো পরিমার্জন-পরিশোধন ও যোজন-বিয়োজন করে বইয়াকারে প্রকাশ করা যায়। বনানী সেমিনারীতে অনুবাদ বিষয়ক একটি বিষয় বা সাবজেক্ট যুক্ত হলে মন্দ হয় না। মাণ্ডলিক সংবিধান (ক্যানন ল) ইংরেজি ভাষায় হওয়ায় অনেকেই সেটা পড়তে পারছেন না; তাই মাণ্ডলিক সংবিধানের বাংলা অনুবাদ সময়ের দাবি।
অনুবাদ সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে আরও কিছু বদ্ধমূল ধারণা হল, অনুবাদ কখনও মূলের সমমর্যাদায় আসতে পারে না। মূল যদি হয় মাস্টার তাহলে অনুবাদ হল সারভেন্ট বা ভৃত্য। কিন্তু এটা সত্য যে, মূলের চেয়ে অনুবাদটিই অনেক সময় ভালো ও গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার কারণে ইংরেজি ভাষার সাথে অন্য ভাষার অনুবাদ সমস্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হলেও বাংলার সাথে খুবই নগণ্য। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলী মাণ্ডলিক পুস্তক, তথ্য ও দলিলপত্র অনুবাদে এগিয়ে আসতে পারে। আর তা করার জন্য অনুবাদককে পেশাদারিত্বের পর্যায়ে উন্নীত, অনুবাদকের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উত্তরোত্তর দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা, অনুবাদককে আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত হওয়া, নিয়মিত সম্মেলন বা কনফারেন্সের আয়োজন করা এবং অনুবাদকর্ম ও অনুবাদ তত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা জরুরী। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলী তা করতে পারলে একদিন অনুবাদকর্মে বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।