ফাদার সাগর কোড়াইয়া
একমাস বাদেই আবারো থাইল্যাণ্ড যেতে হবে ভাবিনি। এবারের গন্তব্য ব্যাংকক হয়ে উত্তর থাইল্যাণ্ডের চিয়াংমাই ধর্মপ্রদেশের চমথং জেলার আন্তর্জাতিক যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (আইওয়াইটিসি) মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার বিষয়ক সক্ষমতা বৃদ্ধি নামক কর্মশালায় অংশগ্রহণ। জুন মাসে তিনজন গিয়েছিলাম। তবে এইবার আমাকে একাই যেতে হয়েছে। একা কখনো দেশের বাহিরে যাইনি। তাই ভয় কাজ করছিলো। আরো ভয় দেশের পরিস্থিতির কারণে যদি প্লেন না ছাড়ে। কারণ কয়েকদিন যাবৎ দেশে কার্ফু চলছে।
থাইল্যাণ্ড থেকে আয়োজনকারীদের নিমন্ত্রণের চিঠিতে ‘মানবাধিকার’ শব্দ থাকায় অভিবাসন অফিসারের নানাবিধ প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়েছে। সব ভয় দূর করে থাই এয়ারলাইন্সে উঠে বসি। রাত তখন তিনটা পাড় হয়েছে। ধারণা ছিলো, এই শেষ রাতে কয়জনইবা দেশের বাইরে যায়। তবে ওয়েটিং রুমে গিয়ে আমার সে ধারণা ভেঙ্গে গেল। মনে হলো বাঙ্গালী বুঝি আমি একাই। প্লেন ছাড়ার খানিকবাদেই খাবার এসে হাজির। মজা করে খেলাম। জীবনের প্রথম শেষ রাতে এসে এই ধরণের ভারি খাবার খাওয়া। দু’চোখে ঘুম নেই। দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। ভাবছি, আমার সোনার বাংলা ভালো নেই।
আমার জন্য হয়েছে আরেকটি সমস্যা। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে আমাকে তিন ঘন্টা পরের প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু কানেক্টিং প্লেন ছিলো না তাই ব্যাংককে লাগেজ সংগ্রহ করে আমিই প্রথম বোর্ডিং পাস নিই। বোর্ডিং পাস দেখে জানতে পারলাম প্লেন চারঘন্টা পরে ছাড়বে। অপেক্ষায় থাকাটা আমার জন্য সবচেয়ে বিরক্তজনক। বিশাল বড় এয়ারপোর্ট। প্রথম কেউ এলে ভ্যাবাচেকা খাওয়ার অবস্থা হবে। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ওয়াইফাই থাকাই সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। তবে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।
অবশেষে সময় হলো। চিয়াংমাইগামী ব্যাংকক এয়ারওয়েজ অপেক্ষায় আছে। এখানেও একই অবস্থা। যাত্রীরা অধিকাংশই ভ্রমণপিয়াসু বিদেশী। ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকে চিয়াংমাইয়ের দূরত্ব প্রায় ছয়শত ছিয়াশি কিলোমিটার। প্লেনে একঘন্টা দশ মিনিট সময় লাগে। জানালার পাশে বসায় বাহিরের দৃশ্য চোখে পড়ছিলো। ঘন্টা খানেক পর নিচের দিকে তাকাতে বুঝতে পারলাম চিয়াংমাই চলে এসেছি। শহরের পাশ ঘেঁষে পাহাড়গুলো আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে। আমাদের প্লেন শহরের ওপর দিয়ে কয়েকবার ঘুরাফেরা করলো। হয়তোবা নামার জায়গা পাচ্ছিলো না। এয়ারপোর্টে নেমে লাগেজ সংগ্রহ করে বাইরে এলাম। দেখি আমার জন্য চারজন সুন্দরী তরুণী অপেক্ষমান। চারজনের কেউ ইংরেজি বলতে পারে না। যাক, মাইক্রো বাসে উঠে বসার সাথে সাথে পাহাড় পাশে রেখে মাইক্রো সাঁইসাঁই শব্দে দৌঁড়ে চললো। ভেবেছিলাম, একটু ঘুমিয়ে নিবো। তবে ড্রাইভারের কথা বলার দৌরাত্ম দেখে ঘুম পালিয়ে গেল। ড্রাইভার মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে।
থাইল্যাণ্ড সমন্ধে কিছু না বললেই নয়। সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটি দেশ। রাস্তায় কোন ধরণের ময়লা-আবর্জনা নেই। আবহাওয়া বলতে গেলে বাংলাদেশের মতোই। বাংলাদেশের সাথে গাছপালা থেকে শুরু করে লতাপাতা সবই মিলে। থাই জনগণ বেশ ভদ্র; আর সেটা ব্যাংকক এয়ারপোর্টে প্রবেশ করা মাত্র যে কেউ বুঝতে পারে। পুরো দেশটাই ভ্রমণপিয়াসুদের আনাগোনায় ভরপুর। দেশের আয়ের বড় একটি উৎস হচ্ছে এই খাত। তাই ভ্রমণপ্রিয়াসুদের সর্বোচ্চ সেবা ও সুযোগ-সুবিধা সরবরাহের চেষ্টা করে থাই সরকার। দেশটি সবুজে ভরপুর। রাস্তঘাট প্রশস্ত এবং রাস্তায় যানজট একদম চোখেই পড়ে না। অবাক হবার বিষয়, রাস্তাঘাটে যানবাহনের হুইসেল নেই। যদি কেউ ভুলবশত তা করে তাহলে সবাই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়। দেশের সম্পদ যাচ্ছেতাই ব্যবহার করার মানসিকতা থাইদের মধ্যে নেই। পানি, বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা বেশ সচেতন। কর্মঠ জাতি হিসেবে তাদের সুনাম রয়েছে। ভোর হতেই থাইরা কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। প্রায় সবারই নিজস্ব মোটরবাইক ও গাড়ি রয়েছে।
আমাদের সেন্টারটি চিয়াংমাই ধর্মপ্রদেশ থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার পশ্চিমে ল্যামপংএ পাহাড়ঘেরা স্থানে অবস্থিত। একজন থাই মনফোর্ট (গাব্রিয়েল) ব্রাদার আনুরাগ বিশাল একটি জায়গা নিয়ে সেন্টারটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সত্যি অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সেন্টারটি প্রতিষ্ঠায় প্রকৃতির কোন প্রকার ক্ষতি করা হয়নি। বরং প্রকৃতিকে স্বস্থানে রেখেই সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছে। ব্রাদার গরীব ছাত্রদের এখানে রেখে পড়াশুনায় সহায়তা করেন। এই সেন্টারে ব্রাদার কফি চাষ থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা ধরণের কাজের সাথে যুক্ত আছেন। আগামীতে ব্রাদার অনুরাগের এখানে আরো অনেক প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
কর্মশালার একটি অংশ ছিলো তিনদিনে তিনটি গ্রামের মানুষের জীবন ব্যবস্থা অভিজ্ঞতা করা। প্রথমদিন আমরা দই সাং নামক আদিবাসীদের সমন্ধে জানতে পারি। এই আদিবাসীরা পাহাড়ের ওপরে বাস করে। আমার ধারণা ছিলো, বাংলাদেশের আদিবাসীদের মতো এখানকার আদিবাসীরা অনেকক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে। তবে আমার ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছে। এই আদিবাসীরা সময়ের – স্রোতের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। বর্তমান সকল প্রকার প্রযুক্তির সাথে তারা পরিচিত। তবে নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেনি। তারা নিজেদের প্রকৃতির সন্তান বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। তারা মনে করে যে, তাদের এই স্থানে জীবন এবং আত্মার যত্ন নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে এই আদিবাসীরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা লাভ করেছে। কেউ যেন গাছ কাঁটতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রতিবছর বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টধর্মের রীতি অনুযায়ী গাছের অভিষেক (ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে অবস্থিত গাছগুলোতে বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসীদের ঘেরুয়া কাপড় ও খ্রিস্টধর্মের ক্রুশ বাঁধা) অনুষ্ঠান করা হয়।
খুন ত্যাই গ্রামটি অনিন্দ্য সুন্দর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বারোশত ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছবির মতো বাড়িগুলোর অবস্থান। এই গ্রামে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং ঐতিহ্যগত বিশ্বাসে বিশ্বাসী জনগণের বসবাস। গ্রামের অধিকাংশই কৃষিকাজের সাথে জড়িত। পাহাড়ের কোলে ধান, নানাবিধ সবজি, ফল ও কফির চাষ করা হয়। অনেকে ব্যবসা-বানিজ্যের সাথেও যুক্ত। এখানকার জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের একটি অনুশীলন দেখে বেশ ভালো লাগলো। দুপুরের আহারের পর পাহাড়ী রাস্তা ধরে পাহাড়ের পাদদেশের ধানের জমিতে যাই। ধানের চারা রোপনের কয়েক সপ্তাহ পরে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী চারার আশির্বাদ অনুষ্ঠান করা হয়। স্থানীয় মিশনের একজন ফাদার আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা জমিতে পৌঁছলে ফাদার প্রার্থনা, ধর্মীয় গান এবং পবিত্র জলসিঞ্চনের মধ্য দিয়ে ধানের জমি আশির্বাদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
তৃতীয় দিন আমরা বান ফা মন নামক একটি পাহাড়বেষ্টিত গ্রামে যাই। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স মিশনারীরা প্রথম এই গ্রামে আসেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। এক সময় গ্রামটিতে খাদ্যের অভাব ছিলো প্রকট। বিশেষ করে ধান উৎপাদনে গ্রামটি পিছিয়ে ছিলো দীর্ঘ একটি সময়। তবে মিশনারীদের সহযোগিতায় গ্রামটিতে ধানের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। তারা ধান সংগ্রহের জন্য রাইস ম্যারিট (Rice Merit) নামক একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। আর ধান সংগ্রহ করে থাইল্যাণ্ডের সেমিনারী ও গরীব এলাকাগুলোতে তা পৌঁচ্ছে দেয়। গ্রামবাসী জানান যে, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নেপালে অনুষ্ঠিত ভূমিকম্পের সময় এই গ্রাম থেকে তারা সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, ‘অন্যদের সাথে খাবার চাউল সহযোগিতা করা মানে জীবন সহভাগিতা করা’।
থাইল্যাণ্ডের অভিজ্ঞতা বলে শেষ করা যাবে না। নানা ধরণের অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিলো থাইল্যাণ্ড সফর। থাই জনগণের মধ্যে একটি সুন্দর ধারণা রয়েছে যে, প্রকৃতি এবং প্রকৃতির পশুপাখি তাদের বাঁচায়; পশুপাখি শিকার করে খাবে, প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহও করবে তবে প্রকৃতি ও পশুপাখিকে যত্ন করা সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।