ফাদার সাগর কোড়াইয়া
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে প্রতি বছর পালকীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মপ্রদেশের রূপরেখা কেমন হবে তা এই পালকীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়েই উঠে আসে। ফলে ধর্মপ্রদেশকে সার্বিক দিক দিয়ে গতিশীল করতে এই সম্মেলন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মপাল কর্তৃক প্রদত্ত রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের এই বছরের পালকীয় পত্রের মূলভাব হচ্ছে ‘মিলন সাধনায়: অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি’। পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের ‘সিনোডাল মণ্ডলী’র ধারণারই অনুরূপ বলা যায় এই মূলভাবকে। তবে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বাস্তবতার আলোকে বিশপের এই পত্রটি নতুন আলো ও পথের সন্ধান দেবে বলেই মনে করি।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ তিনটি ভিকারিয়ায় বিভক্ত। তিনটি ভিকারীয়ার বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন। তবে বিশপের পত্রে ব্যক্তি, সমাজ ও এলাকার যে অসঙ্গতিগুলো উঠে এসেছে তা শুধুমাত্র কতিপয় এলাকার সমস্যাই নয়। বরং ভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতির আলোকে সমস্যাগুলো ভিন্নতর হতে পারে কিন্তু এর প্রভাব সর্বত্র একইভাবে বিরাজমান। সমস্যাগুলো কিভাবে অতিক্রম করা যায় তাও বিশপের পত্রে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে ধর্মপল্লী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি ছাড়া সিনোডাল মণ্ডলীর বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব নয়। মিলন সাধনা শুধু মুখে ও কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না বরং কাজের মধ্য দিয়ে মিলন সাধনা অনুশীলন করতে হবে। আর মিলন সাধনার বাহ্যিক রূপ হচ্ছে ‘অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি’।
বিশপের পালকীয় পত্রের শেষে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো যেন বর্তমান সময়ের ব্যক্তি জীবন, পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী, জাতিসত্ত্বা ও গ্রামের বাস্তবতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আসলেই কি বৃহত্তর এই অনুষঙ্গগুলো ভালো আছে; নাকি বাস্তবতার প্রবাহে গড্ডলিকার মতো ভেসে যাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে সব অনুষঙ্গগুলোকেই ভেঙ্গে চুরে দেখতে হবে। বিচার-বিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুধ্যানের আলোকে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে সেগুলোর উত্তমতাকে অনুশীলন ও মন্দতাকে বিসর্জন করাই হবে মিলন সাধনার মধ্য দিয়ে ‘অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি’ প্রতিষ্ঠা।
পুণ্যপিতা সাধু দ্বিতীয় জন পলের একটি উক্তি এখানে লক্ষ্যণীয়, ‘পরিবার তুমি পরিবার হও’। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। আসলে কি পরিবার গঠন করাটাই সমাপ্তি; নাকি পরিবার উদযাপন করাটা প্রয়োজন? অধিকাংশই পরিবার গঠন করাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান। আর তখনই সমস্যা দেখা দেয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মিলন ও ভালবাসাপূর্ণ সম্পর্ক আর গড়ে উঠে না। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের ভাঙ্গণ দেখা দেয়। আর এর প্রভাব এসে পড়ে সন্তানদের উপর।
সন্তান জন্ম দিলে জনক-জননী হওয়া যায় কিন্তু পিতামাতা হতে গেলে সন্তানের জন্মের পর যে সুযত্ন তার কোন বিকল্প নেই। তবে অঞ্চলভেদে পরিবারগুলোর দিকে তাকালে ভয়াবহ চিত্রই ভেসে আছে। এমনও দেখা যায়, সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে পিতামাতারা সে খোঁজ কখনোই রাখেন না। বলতে দ্বিধা নেই, পরিবারের গরু-ছাগলগুলোর যত্ন ও খোঁজ পিতামাতারা যেভাবে রাখেন সেভাবে সন্তানদের দিকে দৃষ্টি দেন না। আর এই যদি হয় পরিবারের চিত্র তাহলে বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের নিকট থেকে কিই’বা আশা করা যেতে পারে। এর ফলে অল্প বয়সে পড়াশুনা থেকে সন্তানদের ঝড়ে পড়ার শব্দই শুধু শোনা যায়। এছাড়াও বয়স হবার পূর্বে অবৈধ্যভাবে ছেলেমেয়ের বসবাসের ফলে একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাগুলো অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে মণ্ডলী এত বছর ধরে পালকীয় কী যত্ন নিয়েছে? সত্যি কথা বলতে কি, পরিবার যতক্ষণ না সচেতন হবে মণ্ডলী সেখানে কিছুই করতে পারবে না। কারণ পরিবারের সমন্বয়েই মণ্ডলী গড়ে উঠে। পরিবার হচ্ছে মণ্ডলীর কোষ।
এক সময় স্কুলের সামাজ বিজ্ঞান বইয়ে পড়ানো হতো, সমাজ কিভাবে গঠিত হয়? উত্তরে বলতাম, কয়েকটি পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ গড়ে উঠে। বর্তমানে সমাজ কাঠামোর দিকে তাকালে ভয়াবহ চিত্র ভেসে আসে। যেহেতু পরিবারগুলো ভালো নেই আর তাই সমাজ যে অসুস্থ হবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সমাজের মধ্যে হিংসা-দ্ব›দ্ব-বিবাদ ও মনোমালিন্য লেগেই আছে। কেউ কারো ভালো দেখলেই গাত্রদাহ থেকে গৃহদাহ শুরু হয়ে যায়। এ যেন অনেকটা কাঁকড়া দর্শনের মতো। কয়েকটি কাঁকড়া একটি পাত্রে রাখলে যদি কোন কাঁকড়া পাত্র বেয়ে উপরে উঠে আসতে চায় তাহলে অন্য কাঁকড়াগুলো উপরে উঠে আসা কাঁকড়ার পা ধরে টেনে নিচে নামায়। আমাদের সমাজে এরকম বহু কাঁকড়া রয়েছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ একটি রোগ। আর এই রোগটিই দিনকে দিন সবাইকে গ্রাস করে ফেলছে। এটা শুধু কতিপয় অঞ্চলের সমস্যাই নয় বরং এটি সমগ্র বিশ্বের সর্বজনীন সমস্যা। বিশেষ করে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এসে সবার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ আরো স্পষ্ট। ফলে সবাই দেহগতভাবে খুব কাছাকাছি কিন্তু মানসিক দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের কারণে প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়ার আগ্রহ যাচ্ছে কমে। যিশুর আদেশ, “প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালবাসবে” (মার্ক ১২:৩০) বাক্যটির বাস্তব অনুশীলনে ঘাটতি। পরিবারে প্রবীণরা ছায়ার মতো। বয়োবৃদ্ধিতে এই প্রবীণরা অবহেলা ও অনাদরের শিকার। এটির অবশ্য কারণ রয়েছে। শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধাপিত হয়। আজ যারা প্রবীণ এক সময় তারাই যুব বয়সে পরিবারের প্রবীণদের অযত্ন করেছে; আর তা সেই সময়ের শিশুরা দেখে শিখেছে। আজ সেই শিশুরাই বড় হয়ে প্রবীণদের দেখভাল করা থেকে বিরত। তবে আমরা এই অবস্থা দেখতে চাই না।
পরিবার ও সমাজে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও শিক্ষার গঠন এবং অনুশীলনের অভাবে নানা ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া খ্রিস্টীয় শিক্ষার পরিপন্থি পরম্পরাগত শিক্ষার প্রভাব তো রয়েছেই। আর এগুলো সবই সম্ভব হচ্ছে পরিবার ও সমাজের গঠনমূলক ও খ্রিস্টীয় নেতৃত্বের অভাবে। পরিবারে সন্তানদের গঠনে পিতামাতার জীবনাচারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সন্তান যদি দেখে পিতামাতার ধর্মকর্মের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই তাহলে সন্তানদের শিক্ষায় ঘাটতি যে থাকবে তা নির্ধিদ্বায় বলে দেওয়া যায়। বিশেষ করে পরিবারে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তমানে যত সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেখানকার মূল সমস্যা হচ্ছে, “পরিবার ও সমাজে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস” অনুশীলনের অভাব।
২০২৫ খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের জুবিলী জয়ন্তী উৎসব। এই জুবিলী বর্ষে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা হবে ‘আশার তীর্থযাত্রী’। পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস এই বছরকে প্রার্থনা বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়াও কয়েক বছর যাবৎ সিনোডাল মণ্ডলী গড়ে তোলার জন্য সমগ্র মাতামণ্ডলী একত্রে কাজ করছে। পৃথিবীর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এই সময়ে উপরোক্ত বিষয়গুলো জনগণকে ভাবিয়ে তুলছে।
বিশপের পালকীয় পত্রটি জনগণ ও পরিচালনা পর্ষদদের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে দীক্ষাস্নাত হিসেবে প্রত্যেক খ্রিস্টভক্তের জীবনাচারণ ও দায়িত্ব কেমন হবে তা এই পত্রে স্পষ্ট। খ্রিস্টান সংখ্যায় নয় বরং গুণগত মানে যেন বৃদ্ধি পায় সে ইঙ্গিত প্রচ্ছন্নভাবে এই পত্রে উঠে এসেছে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের লক্ষ্য মিলন সাধনা। তাই মিলন সাধনায় অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি স্থাপনে সংলাপ, মতবিনিময়, বৈষম্য, ভেদাভেদ দূরীকরণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগ্রাগমন ও নারী নেতৃত্বকে ত্বরান্বিত করা অতীব জরুরী।