পোপ ফ্রান্সিসের নির্দেশাবলী ‘সিনোডাল মণ্ডলী’ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই বছর রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে আমরা “মিলন সাধনা: অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি” মূলভাবের ওপর ধ্যান-প্রার্থনা ও আলাপ-আলোচনা করছি। আমরা যেন যিশুর শেখানো ‘ঐক্য’ বা ‘একতা’ ও ‘মিলন’ গড়ে তুলে আদিমণ্ডলীর খ্রিস্টভক্তদের মত হতে পারি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিশপ জের্ভাস রোজারিও। ১১ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে অনুষ্ঠিত দ্বাবিংশ পালকীয় কর্মশালার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তি’ ও ‘সংহতি’ ছাড়া প্রকৃত মিলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়; এই মিলনের ভিত্তি হলো যিশুর ভালবাসা: জীবনদানের ভালবাসা, মুক্ত ও যুক্ত করার ভালবাসা।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় কর্মশালায় বিশপ, ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার এবং খ্রিস্টভক্তসহ ২১৩ জন অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার শুভেচ্ছা বক্তব্যে ধর্মপ্রদেশের পালকীয় সেবাদলের আহ্বায়ক ফাদার বাবলু কোড়াইয়া বলেন, আমরা প্রতিবছর যে পালকীয় কর্মশালা করে থাকি, তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বমণ্ডলীর সাথে একাত্ম হয়ে পথচলা। আর সেই লক্ষ্য পূরণে সর্বজনীন মণ্ডলীর সাথে একাত্ম হয়ে আমাদের ধর্মপ্রদেশে সকলে মিলে একসাথে বসি, আলাপ-আলোচনা করি এবং সিদ্ধান্ত নিই যেন ধর্মপল্লীতে ফিরে গিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারি।

বিশপ মহোদয়ের পালকীয় পত্র “মিলন সাধনা: অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি” মূলভাবের ওপর তিনটি প্রশ্নের আলোকে ধর্মপল্লী থেকে প্রদত্ত উত্তরের সারমর্ম উপস্থাপন করা হয়। সারমর্মের উপস্থাপনে ধর্মপল্লীতে মিলন সাধনা, অন্তর্ভুক্তি, সংহতি স্থাপনের সমস্যা এবং কিভাবে জনগণের অংশগ্রহণে স্থাপন করা যায় তা উঠে আসে। বিশপ মহোদয়ের পালকীয় পত্রের আলোকে ‘অন্তর্ভুক্তি’ বিষয়ে আলোচনা করেন অসীম ক্রুশ, কর্মসূচী কর্মকর্তা, কারিতাস ঢাকা অঞ্চল। তিনি বলেন, বর্তমানে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ধারণায় বলা হচ্ছে- কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরং সকলকে নিয়েই উন্নয়ন পরিকল্পনায় অংশীদারিত্ব হতে হবে। কাথলিক মণ্ডলীর সামাজিক শিক্ষায়ও বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। সুতরাং স্থানীয় মণ্ডলী শক্তিশালীকরণে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী।

‘সংহতি’ বিষয়ে সিস্টার দিপালী মনিকা আরেং, এসএসএমআই বলেন, সাধারণ অর্থে সংহতি হলো মিলন, ঐক্য, সংঘবদ্ধতা, নিবিড় সংযোগ, সমন্বয়, জমাট বা ঘনীভূত হওয়া। অন্য কথায় সংহতি হল বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা, একতার সম্মতি, সন্ধি বা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমর্থন। ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে ন্যায় বিচার, শান্তি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঁধা, অসুবিধা বা হুমকি একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করার সমন্বিত উদ্যোগ ও কর্ম। সংহতির মূলে আছে, ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্য সাধনা।

ফাদার দিলীপ এস. কস্তা ‘মিলন সাধনা’ বিষয়ে বলেন, পালকীয় পত্রের আহ্বান হলো ‘সিনোডাল মণ্ডলী’ হয়ে উঠা অর্থাৎ মিলন (Communion), অংশগ্রহণ (Participation) ও প্রেরণকার্যে (Mission) আরো সক্রিয়, সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠা। ‘মিলন সাধনা’ একটি চলমান প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টা; যার মধ্যে দিয়ে পারস্পারিক মিলন বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব। খ্রিস্টবিশ্বাসীদের নিকট মিলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো জীবন
স্রষ্টা ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া, তাঁর নির্দেশনায় পথচলা, কৃপা, অনুগ্রহ ও আশির্বাদ লাভ করা। মিলন সাধনা ছাড়া অন্তর্ভূক্তি (Inclusivity) ও সংহতিপূর্ণ (Solidarity) সমাজ ও মণ্ডলী গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

বিশপের পালকীয় পত্রের আলোকে আদিবাসীদের মধ্যে একই পদবীতে বিবাহের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলে বিশপ বলেন, আদিবাসীদের মধ্যে একই পদবীতে বিবাহ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় তবে যদি দূর্ঘটনা ঘটে তাহলে তা সংশোধনের জন্য কাজ করতে হবে। তবে পরিবার ও সমাজে ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষা আগে প্রদান করতে হবে।

ফাদার লুইস পেরেরা বলেন, পালকীয় কর্মশালা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছরই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে বাস্তবায়ন করবে ও কিভাবে করবে। তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, ধর্মপল্লীর যাজকদেরই সব সময় মাথাব্যথা। জনগণ একেবারেই পিছিয়ে থাকে। পুরুষদের অংশগ্রহণ একেবারেই কম। জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে যে, জনগণের অনেক দায়িত্ব রয়েছে।

ফাদার প্যাট্রিক গমেজ বলেন, আমাদের প্রত্যেকের মূলশিকড় হলো অন্তরের অন্তস্থলে মিলন সাধনা। আর এই মিলন চর্চা সহজ বিষয় নয়। আমাদের প্রত্যেকের অন্তর মিলনের অন্তর হয়ে উঠুক।

সুলেখা রোজারিও বলেন, অনেক এলাকায় পারিবারিক প্রার্থনা ও অন্যান্য প্রার্থনানুষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। তাই নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার।

আলাপ-আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের পর রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় কর্মশালার ‘প্রেরণ বিবৃতি’ উপস্থাপন করা হয়। প্রেরণ বিবৃতির দর্শন ‘মিলন সাধনা: অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি’ এ মূলনীতির আলোকে সক্রিয় ও স্বাবলম্বী স্থানীয় মণ্ডলী গড়ে তোলা’ এবং প্রেরণ হিসাবে নেওয়া হয় ‘রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের সকল খ্রিস্টভক্তের অংশগ্রহণে মিলন সমাজ গঠন’।

পালকীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী বোর্ণী ধর্মপল্লীর রনি রোজারিও অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, সংহতি ও অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে আলোচনা ভালো ছিলো। কর্মশালায় সবাই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। মণ্ডলীর কাজে আমরা যেন কাউকে অবহেলা ও বাদ না দিই। আর তা করতে পারলে পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলী সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

মহিপাড়া থেকে আগত গোলাপী সরেন প্রথমবারের মতো পালকীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ধর্মপ্রদেশের উন্নতিকল্পে যে এত সুন্দর ও ফলপ্রসু কর্মশালার আয়োজন করা হয় তা আমার জানা ছিলো না। এই কর্মশালা থেকে আমি নতুন আলো ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছি। আমাদের ধর্মপল্লীর জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি তা বাস্তবায়নে অবশ্যই নিজ উদ্যোগে কাজ করবো।

সিস্টার ইমেল্ডা রোজারিও বলেন, মিলন সাধনায় সবাইকে নিয়ে বিশ্বাসের যাত্রাপথে একসাথে চলবো। পিছিয়ে পড়া জনগণ কাউকে বাদ দিবো না। সবাইকে সন্মান ও ভালবাসবো।

সংবাদ প্রদানে: পালকীয় কর্মশালা প্রতিবেদন কমিটি

Please follow and like us: