ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ভাটিকান সিটি থেকে ২০২৭ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব যুব দিবসের মূল শিরোনাম ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী বিশ্ব যুব দিবস অনুষ্ঠিত হবে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল শহরে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়া মহাদেশে বিশ্ব যুব দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের জুবিলি বর্ষে রোমে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত বিশ্ব যুব দিবসের শিরোনামও প্রকাশ করা হয়েছে। পোপীয় দপ্তরের পক্ষে কার্ডিনাল কেভিন ফারেল ঘোষণায় বলেছেন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব দিবসের প্রতীক- যুব ক্রুশ এবং রোমীয়দের রক্ষাকারিণী মারীয়া মূর্তি- আগামী ২৪ নভেম্বর খ্রিস্টরাজার পর্বদিনে সাধু পিতরের মহামন্দিরে খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে কোরীয় যুবকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই আইকন হস্তান্তরের মধ্যদিয়ে কোরীয় বিশ্ব যুব দিবসের আধ্যাত্মিক কার্যক্রম শুরু হবে।

মেনিলা বিশ্ব যুব সম্মেলন: এর আগে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারির ১০-১৫ তারিখে ফিলিপাইনের রাজধানী মেনিলা শহরে- এশিয়ার প্রথম বিশ্ব যুব দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। রাজধানীর লুনেতা পার্কে অনুষ্ঠিত খ্রিস্টযাগে ৫০ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন- যা পরে স্থান করে নিয়েছিলো গ্রিনিজ বিশ্ব রেকর্ড বুকে। পোপ দ্বিতীয় জন পৌলের এ ফিলিপাইন সফর আজোবধি ভক্তের উপস্থিতির দিক থেকে বিশ্ব যুব দিবস রেকর্ড হয়ে আছে। পিলিপাইন বিশ্ব যুবদিবসের শিরোনাম ছিলো “পিতা যেমন আমাকে পাঠিয়েছেন, তেমনি আমিও তোমাদের পাঠাচ্ছি” (যোহন ২০:২১)।

সাহস হারিয়ো না, আমি সংসার জয় করেছি : সাধু যোহনের মঙ্গলসমাচার থেকে আগামী কোরীয় বিশ্ব যুব দিবসের শিরোনাম নেওয়া হয়েছে- “সাহস হারিয়ো না, আমি সংসার জয় করেছি” (যোহন ১৬:৩৩, Take Courage; I Have Overcome the World)। অন্যদিকে আগামী (২০২৫) খ্রিস্টবর্ষে পালিত হবে খ্রিস্ট জুবিলি, যার মূল বাণী হলো “আলোর তীর্থ”। সে সঙ্গে রোমে সংক্ষিপ্ত আকারে বিশ্ব যুব দিবস উদযাপিত হবে ২০২৫ খ্রিস্টবর্ষের জুলাই ২৮ থেকে ৩ আগস্ট তারিখ পযর্ন্ত। এ মিনি বিশ্ব যুব দিবসের মূল বাণী বেছে নেওয়া হয়েছে সাধু যোহনের মঙ্গলসমাচার থেকে, “তখন তোমরাও সাক্ষ্য দেবে, কারণ তোমরা গোড়া থেকেই আমার সঙ্গে রয়েছো” (যোহন ১৫:২৭, You Also Are My Witnesses, Because You Have Been With Me)।

বিশ্ব যুব জয়ন্তী : ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিলো ঘোষিত মুক্তির পূণ্যবর্ষ। এই বর্ষের সমাপ্তিপর্বে, পোপ ২য় জন পৌলের আহ্বানে গোটা বিশ্ব থেকে তিন লাখ যুবক ভাটিকানে সাধু পিতর মহামন্দির চত্বরে সমবেত হয়েছিলেন- সেটাই ছিলো প্রথম বিশ্ব যুব জয়ন্তী। পোপ বিশ্ব যুব দিবসের ঘোষণা দেন ২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ এবং প্রথম বিশ্ব যুব দিবস পালিত হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে রোম নগরীতে। আর মূল বিষয় ছিলো, “বরং তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রভুর, অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্যে পেতে রাখ শ্রদ্ধার আসন। অন্তরে তোমরা যে আশা লালন করছো, সেই আশার ভিত্তিটা কি, যখন যে কেউ তা জানতে চাক না কেনো, তোমরা তার উত্তর দিতে সর্বদাই প্রস্তুত থেকো। তবে উত্তর দিয়ো সবিনয়ে, সমুচিত সম্মান দেখিয়ে” (১ পিতর ৩:১৫)। সর্বশেষ বিশ্ব যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে, ২০২৩ খ্রিস্টবর্ষে আগস্ট ১-৬ তারিখে। ১৬তম বিশ্ব যুব সম্মেলন, লিসবনের মূলভাব বেছে নেওয়া হয়েছিলো, “মারীয়া এবার বাড়ি ছেড়ে পার্বত্য অঞ্চলে যুদা প্রদেশের একটি শহরের দিকে তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন” (লুক ১:৩৯)। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব যুব দিবস স্থাপনের পর থেকে প্রতি বছর স্থানীয় ধর্মপ্রদেশ ও জাতীয়ভাবে যুব দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে সাধারণত প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর এবং ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে বিশ্ব যুব দিবস পালিত হয়ে আসছে।

কোরীয় বিশ্ব যুব দিবস প্রস্তুতি : আগামী ২০২৭ কোরীয় বিশ্ব যুব দিবস হবে ১৭তম বিশ্ব যুব দিবস। সিউলের আর্চবিশপ পিটার সোন-তাইক চুং গত সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আগামী বছর রোমে অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্ব যুব সম্মেলনে কমপক্ষে এক হাজার কোরীয় যুবক অংশ নিবেন- যেনো তারা এ তীর্থযাত্রার মধ্যদিয়ে আশা, বিশ্বাসে খ্রিস্টের সান্নিধ্য লাভ ক’রে বিশ্বে মÐলীর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। তিনি বলেন, এ প্রথম একটি অ-খ্রিস্টান দেশে বিশ্বে যুব দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মোট ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সংখ্যা ৬০ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মাত্র। কোরিয়ান রিসার্চ জার্নাল দেশের ধর্মীয় জনসংখ্যা নিয়ে এক সমীক্ষা শেষে জানিয়েছে যে, বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ধর্মকর্ম অনুশীলন থেকে বিরত রয়েছে। কোরীয় যুদ্ধের পর (১৯৫০-৫৩) দক্ষিণ কোরিয়া খুব দ্রুত এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হয়ে পড়ে। আর্থিক স্বচ্ছলতা, প্রযুক্ত ও নানা কারণে ধর্মের প্রতি অনীহার প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যা পাঁচ কোটি ১৬ লক্ষ।

শিরোনাম পর্যালোচনা : শিরোনাম ঘোষণার সময় কার্ডিনাল কেভিন ফারেল বলেন, বিশ্ব যুব দিবস কোরিয়া ২০২৭ এবং মিনি বিশ্ব যুব দিবস রোম ২০২৫, এ দুই পর্বের শিরোনাম, “সাহস হারিয়ো না, আমি সংসার জয় করেছি” এবং “তখন তোমরাও সাক্ষ্যি দেবে, কারণ তোমরা গোড়া থেকেই আমার সঙ্গে রয়েছো” যেখানে মূল ধারণা হলো “সাহস” এবং “সাক্ষ্যদান” মূলত: উৎপত্তি হয়েছে খ্রিস্টের মৃত্যু-জয়ের মধ্য থেকে। এ শিরোনাম বেছে নেওয়ার কারণ হতে পারে, বিশ্বটা দিন দিন বেশি মাত্রায় জাগতিক হয়ে পড়ছে। এতে করে যুবগোষ্ঠীর মধ্যে আশা, সাহস ও বিশ্বাসে জীবন যাপনে অনীহার সম্ভাবনা তৈরি জোরদার হচ্ছে। চার্চ মনে করে, যুব সমাজের জন্য চাক্চিক্য জীবন যাপন প্রচারের চেয়ে জীবনভিত্তিক অনুশীলন বেশি প্রয়োজন। কার্ডিনাল বলেন, যুবকদের জ্ঞানের চেয়ে সাক্ষ্যদান অধিক গুরুত্বপুর্ণ। পোপ হয়তো তাঁর বাণীর মধ্যদিয়ে যুব সমাজকে বলার চেষ্টা করবেন- যদি “সাহস” থাকে তবে বিশ্বের যতোসব সমস্যা সমাধান সম্ভব। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্যাথলিক বিশপ সম্মেলনীর বিধায়কদের বিভিন্ন মন্তব্য থেকে যেটুকু অনুমান করা যাচ্ছে যা হলো- কোরীয় বিশ্ব যুব দিবসের লক্ষ্য হবে যুবকদের অনুপ্রাণিত করা। গত লিসবন বিশ্ব যুব সম্মেলনে চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিলো- অধিক সংখ্যায় কোরীয় যুবাদের উপস্থিতি। এছাড়া আগামী বছর রোম নগরীতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মিনি বিশ্ব যুব সম্মেলনে কোরিয়া থেকে কমপক্ষে এক হাজার যুবক যুবতী অংশ নিতে যাচ্ছে। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে কোরীয় বিশ্ব যুব সম্মেলনে, সম্ভব হলে দেশের সব ক্যাথলিক যুবকদের একত্রিত করা। জাগতিকতার কারণে যুব সমাজের মধ্যে ধর্মের প্রতি অনীহা দিন দিন বাড়ছে। ক্যাথলিক চার্চ বিশ্ব যুব সম্মেলনকে কাজে লাগাতে চান যেনো তাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জেগে উঠে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যুব সম্মেলনের শিরোনাম ঘোষণা করা হয়েছে।

আর্চ বিশপ সোন তাইক বলেছেন, “সিউল বিশ্ব যুব সম্মেলন শুধু একটা বৃহৎ জনসম্মেলন হবে তা কিন্তু নয়- এটা হবে যুব সমাজের একটা অর্থবহ যাত্রা, খ্রিস্টের সঙ্গে একাত্বতা, আধুনিক সমস্যা নিয়ে অনুধ্যান এবং অন্যায্যতার মোকাবেলা করা।” আর্চবিশপ আরোও বলেন, “এটা হবে একটা মহা-উৎসব, যেখানে অংশগ্রহণকারিরা অনুধাবন করতে পারবেন- কোরীয় যুব সমাজের তৈরি সৃজনশীল ও গতিশীল সংস্কৃতি। সম্প্রতি পোপের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চল সফরে দেখা গেছে- (সেপ্টেম্বর ২-১৩, ২০২৪) পোপ, প্রথম এ অঞ্চলের জনগণ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চকে সর্বদলীয় ও সর্বধর্মীয় সংলাপের জন্য জোড়ালোভাবে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সফরে তিনি যুব সমাজকে প্রাধান্য দিয়ে সংলাপে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। পোপ মনে করেন, খ্রিস্টানগণ সংখ্যালঘু হিসেবে দেশগুলোতে “খামিরের” ভূমিকা পালন করতে পারেন।

কোরীয় ক্যাথলিক বিশপ সম্মেলনীল বক্তব্য থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে আগামী বিশ্ব যুব সম্মেলনে সংলাপের উপর জোর দেওয়া হবে। যুব সম্মেলন কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সংখ্যালঘু হিসেবে তারা যুব সমাজকে অনুপ্রাণিত করবেন যাতে তারা সংলাপের মধ্যদিয়ে মঙ্গলবার্তার শিক্ষা সহভাগিতা করতে পারেন। আর এ সংলাপ হবে “বিশ্বাস এবং আধুনিকতার” মধ্যে। যুব সমাজকে হতে হবে- “সংঘর্ষ ও আঘাতে বিভক্ত হয়ে যাওয়া বিশ্বে শান্তির বাহক।”

Please follow and like us: