ফাদার টি. প্রেমু রোজারিও

“নিস্তার রহস্যের মধ্যে থেকেই মণ্ডলির জন্ম হয়েছিল। এই বিশেষ কারণেই খ্রিস্টযাগ, যা হলো অপূর্বভাবে নিস্তার রহস্যেরই সংস্কার যে মণ্ডলির জীবনের কেন্দ্র বিন্দুতেই অবস্থান করছে। শিষ্যচরিতে দৃষ্ট মণ্ডলির একেবারে প্রথম ছবি থেকে ইতোমধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়েছে। “তারা সকলে প্রেরিতদূতদের শিক্ষা গ্রহণে, ঐক্যবদ্ধ জীবন-যাপনে, রুটি ছেঁড়া অনুষ্ঠানে ও প্রার্থনা সভায় নিষ্ঠার সঙ্গে যোগ দিত (শিষ্যচরিত ২:৪২)।” “রুটি ছেঁড়ার অনুষ্ঠান” খ্রিস্টযাগকেই নির্দেশ করে। দু’হাজার বছর পরও আমরা মণ্ডলির সেই আদি চিত্রটিরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আসছি। প্রতিটি খ্রিস্টযাগ অনুষ্ঠানে আমরা আধ্যাত্মিকভাবে নিন্তার বা পাস্কা দিবসত্রয়েই ফিরে আসি: পুণ্য বৃহস্পতিবারের ঘটনাবলী থেকে সেই শেষ ভোজের অনুষ্ঠান এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলীতে। খ্রিস্টযাগের প্রতিষ্ঠা, সংস্কারীয়ভাবে যে সমস্ত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার পূর্বাভাস দিয়েছিল, যা শুরু হয়েছিল গেৎসেমানি বাগানের মর্মযাতনা থেকে। আমরা আবারও দেখি যে, উপরতলার ঘর ছেড়ে বের হয়ে, যিশু তাঁর শিষ্যদের সাথে কেদ্রোন উপত্যকা দিয়ে নেমে এসে জলপাইয়ের বাগানের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আজও সেই বাগানে বহু পুরানো কিছু জলপাইয়ের গাছ রয়েছে। সম্ভবতঃ সেই সন্ধ্যায় তাদের ছায়ায় যা ঘটেছিল তারা তা প্রত্যক্ষ করেছিল, যখন খ্রিস্ট প্রার্থনারত অবস্থায় নিদারুণ মর্মজ্বালায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর “ঘাম রক্তের ফোটার মত হয়ে মাটিতে পড়ছিল (লুক ২২: ৪৪)।” কিছুক্ষণ আগেই যে রক্ত তিনি খ্রিস্টযাগের সংস্কারে পরিত্রাণের পানীয় হিসেবে মণ্ডলিকে দিয়ে দিলেন তা পড়তে শুরু করেছে; আমাদের পরিত্রাণের উপায় হিসেবে যা পড়া শেষ হবে গলগথার ক্রুশের উপরে: “কিন্তু খ্রিস্ট আসন্ন মহাদানগুলির মহাযাজক রূপেই আবির্ভূত হয়ে ….. ছাগ বা বাছুরের রক্তের মধ্য দিয়েও নয়, বরং নিজেরই রক্তের মধ্য দিয়ে, একবারই চিরকালের মত, পবিত্রধামে প্রবেশ করেছেন, যেহেতু তিনি চিরকালীন মুক্তির সন্ধান পেলেন (হিব্রু ৯:১১-১২)।”

মাণ্ডলিক আইনের ৯০৪-এ বলা হয়েছে, পুরোহিতদের ‘আন্তরিক ও নিয়মিতভাবে’ এমনকি প্রতিদিনই খ্রিস্টযাগ উদযাপন করার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু এটি একটি সুপারিশ (Recommendation) মাত্র এবং এটি উদযাপন করার আদেশ নেই।

মাণ্ডলিক আইন ৯০৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন পুরোহিত একটি মাত্র খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে পারবেন এবং বিশেষ কারণ ছাড়া প্রতিদিন একটির বেশী খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করতে পারবেন না। তবে রবিবার এবং অন্য কোন বিশেষ দিনে একজন পুরোহিত দু’বার বা ততোধিক খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করতে পারেন বিশপ মহোদয়ের অনুমতি সাপেক্ষে এবং যদি সেখানে পুরোহিতের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

সত্যিকারের জরুরী পালকীয় অবস্থার জন্য, একজন বিশপ তিনটির বেশী খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করার জন্য অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন (যেমন: অসুস্থতা, যাজকদের অভাবজনিত কারণে…)।

মাণ্ডলিক আইনের ৯০৬ অনুসারে, একটি ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত একজন কাথলিক পুরোহিত যেন খ্রিস্টভক্তদের অংশগ্রহণ ছাড়া খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ না করেন।

মাণ্ডলিক আইনের ১৯৮৫ সালের কোড আমাদের বর্তমান আদর্শিক মণ্ডলির এই বিষয়গুলো নিয়ে আসে-যেমন:

মাণ্ডলিক আইন ৯৪৮ অনুসারে সাধারণভাবে একটি খ্রিস্টযাগে একটির বেশী উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। কাথলিক মণ্ডলিতে খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য অনুদান হলো পুরোহিতের কাছে খ্রিস্টভক্তদের দ্বারা প্রদত্ত একটি অনুদান যা খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করার জন্য প্রদত্ত হয়।

মাণ্ডলিক আইন ৯৪৫/১-এ যাজকদের খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, খ্রিস্টমণ্ডলির অনুমোদিত অনুশীলনের সাথে সঙ্গতি রেখে যে কোন যাজক খ্রিস্টযাগ উদযাপন করতে পারেন। তিনি খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য ও অনুদান গ্রহণ করতে পারবেন এবং সেই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করবেন।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৪৫/২ যাজকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে তারা যেন খ্রিস্টভক্তদের জন্য বিশেষত: অভাবী-অসহায় ব্যক্তিদের জন্য খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন; এমনকি তারা যদি খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য-অনুদান না-ও পায়।

মাণ্ডলিক আইনে ৯৪৬-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, খ্রিস্টভক্ত যারা খ্রিস্টযাগে অনুদান দেন তার কারণ হলো তাদের প্রদও উদ্দেশ্যে যেন উৎসর্গকৃত হয়, মণ্ডলির কল্যাণ কাজে অবদান রাখতে পারেন এবং অনুদান প্রদান করার মধ্য দিয়ে মণ্ডলির কাজে সহভাগিতা করা বিশেষত: এর সাথে যুক্ত যাজক মণ্ডলির পালকীয় কর্মকান্ডে সমর্থন দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

মাণ্ডলিক আইন ৯৪৭ ধারায় বলা হয়েছে, যে কোন ধরণের ব্যবসায়িক বা মানবতা বিরোধী বিষয় সম্পূর্ণভাবে খ্রিস্টযাগ থেকে বাদ দিতে হবে।

মাণ্ডলিক আইন ৯৪৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, যাদের জন্য খ্রিস্টযাগের একক উদ্দেশ্য দেওয়া হয়েছে এবং তা গ্রহণও করা হয়েছে; এমনকি যদিও তা ছোট উদ্দেশ্য কিন্তু তার জন্যও আলাদা খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করতে হবে।

মাণ্ডলিক আইন ৯৪৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, যিনি খ্রিস্টযাগের জন্য উদ্দেশ্য প্রদান করেন সেই উদ্দেশ্য একজন যাজক খ্রিস্টযাগ উদযাপন করতে বাধ্য; এমনকি যে উদ্দেশ্য তিনি অনুদান গ্রহণ করেছেন যদি কখনো তিনি সেই উদ্দেশ্য তিনি হারিয়ে ফেলেন!

মাণ্ডলিক আইন ৯৫০ ধারায় বলা আছে যে, কেউ যদি খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের পরিমাণ উল্লেখ ছাড়াই একটার পরিমাণ অর্থ দেন সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি যেখানে বসবাস করেন তার ভিত্তিতে খ্রিস্টযাগের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫১/১ ধারায় বলা হয়েছে- একজন পুরোহিত যিনি একই দিনে একাধিক খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন তিনি খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের জন্য একটি মাত্র খ্রিস্টযাগের অনুদান গ্রহণ করতে পারেন; খ্রিস্টযাগের অতিরিক্ত অনুদান তিনি হস্তান্তর করবেন যেভাবে স্থানীয় বিশপ বা কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো বড়দিন অর্থ্যাৎ বড়দিনের খ্রিস্টযাগের সব উদ্দেশ্যের অনুদান একজন যাজক নিতে পারেন।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫১/২ ধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, যেখানে এ আদেশ বা নীতিমালা বলবৎ নেই সেখানে প্রচলিত রীতি অনুসরণ করা হবে।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫১/৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, সন্ন্যাসব্রতী সংঘের বা সম্প্রদায়ের সদস্যরার উপরোলিখিত ৯৫১/১-২ ধারায় আদেশ মানতে বাধ্য থাকবে।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, খ্রিস্টযাগের অতিরিক্ত উদ্দেশ্য অনুদান নিতে কোন যাজককেই অনুমতি দেওয়া হয়নি, যা একজন যাজক এক বছরের সম্পাদন করতে পারবেন না।

মাণ্ডলিক আইন ৯৫৪ তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি নির্দিষ্ট গির্জায় বা চ্যাপেলে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের অনেক আবেদন বা অনুরোধ করা হয়। সেক্ষেত্রে সেখানে তা উৎসর্গ করা যেতে পারে, তবে উদ্দেশ্যদাতা যদি নির্দিষ্টভাবে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের বিষয়ে উল্লেখ না করেন সেক্ষেত্রে অন্য কোথাও তা উদযাপন করার অনুমতি রয়েছে।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫৫/১ উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন যাজক যিনি খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য অন্য যাজকদের কাছে হস্তান্তর করতে ইচ্ছা করেন, তিনি তা করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য অনুদান অর্পণ করতে হবে যাতে তারা উদ্দেশ্যদাতার সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে পারেন।

৯৫৫/৩ যারা খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য অন্য যাজককে হস্তান্তর করতে চান তারা যেন দেরী না করে তা যেন একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে: যার কাছ থেকে খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছেন এবং যার কাছে খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য হস্তান্তর করেছে এবং খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্যসমূহ।

৯৫৫/৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক যাজক যেন অবশ্যই খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন।

মাণ্ডলিক আইনের ৯৫৮/১ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ধর্মপল্লীর পালক, পরিচালক অথবা অন্য পুণ্য স্থানের পরিচালক যেখানে নিয়মিতভাবে খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য গ্রহণ করা ও খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করা হয় (তীর্থস্থান) সেখানে যেন একটি বিশেষ খাতা থাকে যেখানে সঠিকভাবে লেখা থাকবে: খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের সংখ্যা, উদ্দেশ্য, অনুদানের পরিমাণ এবং খ্রিস্টযাগ উৎসর্গকারীর নাম।

৯৫৮/২ বিশপ বা মণ্ডলির কর্তৃপক্ষ বছরে অন্তত একবার ব্যক্তিগতভাবে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তা পরিক্ষণ করতে বাধ্য থাকবেন।

খ্রিস্টযাগ হল খ্রিস্টমণ্ডলির যজ্ঞ, যে মণ্ডলি ঈশ্বরের জনগণ হিসেবে “যুগে যুগে পিতার নিকট একত্রিত হয় যেন নিষ্কলঙ্ক নৈবেদ্য অর্পণ করে “স্বয়ং প্রভু যিশু খ্রিস্ট তোমার কাছে আমাদের অর্পণ করুন, যেন তোমার উদ্দেশে নিবেদিত, এই বাণীটি উপাসনার মধ্যে নতুনত্ব বয়ে আনে: খ্রিস্টযাগের সময়ে, খ্রিস্টের সঙ্গে ও খ্রিস্টের মধ্যে, মণ্ডলি (খ্রিস্টের দেহ হিসেবে) নিজেকে উৎসর্গ করে। কিন্তু একই সময়ে মণ্ডলিও উৎসর্গীকৃত হয়। যে রুটি ও দ্রাক্ষারস বেদীর কাছে আমরা বয়ে আনি তা হল আমাদেরই চিহ্ন। প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদের দান খ্রিস্টের দেহ হয়ে ওঠে এবং একই সময়ে আমাদের যা হতে হবে সেই দান তার চিহ্নও হয়ে থাকে। খ্রিস্টপ্রসাদ আমাদেরকে নিয়ে মণ্ডলিকে গড়ে তোলে, অর্থাৎ খ্রিস্টের একই দেহ। বলির প্রকৃত দ্রব্যাদি হল আমরা নিজেরাই রুটি ও দ্রাক্ষারসের চিহ্নের মধ্যে (যোহন ৪:২১-২৪; ফিলিপ্পীয় ২:১৭; ১ তিমথি ৪:৬)। খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করা মানে নিজেদের উৎসর্গ করা, খ্রিস্টের সঙ্গে আমাদেরকে বলি করে তোলা। খ্রিস্টযাগ একটি মাত্র সংস্কারের বাস্তবতাকে মিলিত করে রাখে, যা হল খ্রিস্টের ও আমাদের বলি। খ্রিস্টমণ্ডলি হল, এক যজ্ঞবলির জনগণ; যে খ্রিস্টের কাছ থেকে আদেশ পেয়েছে যেন তাঁর স্মরণ উৎসব পালন করে।

Please follow and like us: