“তিনি আমাদের ভালোবেসেছেন”
ফা. সুনীল ডানিয়েল রোজারিও। বরেনদ্রদূত প্রতিনিধি
ভূমিকা: গত ২৪ অক্টোবর পোপ ফ্রান্সিস তাঁর ৪র্থ সর্বজনীন পত্র “Dilexit Nos” He Loved us “তিনি আমাদের ভালোবেসেছেন” ভাটিকান সিটি থেকে উন্মোচন করেছেন। এর আগে পোপ আরো তিনটি সর্বজনীন পত্র প্রকাশ করেছেন। Lumen Fedei (The Light of Faith). Laudato Si (On Care for Our Common Home). Fratelli Tutti (All Brothers). এ সর্বজনীন পত্রগুলোকে অনেক বিশ্লেষক বলে থাকেন Social Encyclical Letters বা সামাজিক- সর্বজনীন পত্র। কারণ এ পত্রগুলো একদিকে যেমন মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রেম, একাত্বতা, মানবতা এবং বিশ্বপরিবেশ সমর্থন করে অন্যদিকে বিশ্ব থেকে সর্বপ্রকার অন্যায্যতা, সন্ত্রাস ও বিবাদ দূরীকরণের লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি জোড়ালো আহ্বান জানায়।
“তিনি আমাদের ভালোবেসেছেন” পুরো সামাজিক-সর্বজনীন পত্রে রয়েছে মোটা পাঁচটি অধ্যায়, ১৪১ পৃষ্ঠার মধ্যে ২৮ হাজার শব্দ। পত্রটি উৎসর্গ করা হয়েছে “খ্রিস্ট যিশুর হৃদয়ের মানবিক ও ঐশ ভালোবাসা” নিমিত্তে। এ ধারণাটি নেয়া হয়েছে রোমীয়দের কাছে সাধু পৌলের পত্রের ৮: ৩৭ পদ থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, “যিনি আমাদের ভালোবেসেছেন।” পোপ বলতে চেয়েছেন যে, যিশুর হৃদয়ে বহমান রয়েছে রূপান্তরযোগ্য শক্তি, যা বিভক্ত বিশ্বকে সুস্থতা দান করতে পারেন।” তিনি অনুরোধ করছেন- যেনো “বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিকগণ যিশু খ্রিস্টের হৃদয়ের ভালোবাসা ও করুণা পুন:আবিষ্কার করতে পারেন।” সম্মানীত পাঠকদের জন্য সর্বজনীন পত্রের সার-অংশ তুলে ধরা হলো।
১ম অধ্যায় : “তিনি আমাদের ভালোবেসেছেন।” কারণ “কোনো কিছুই আমাদের প্রভু খ্রিস্ট যিশুতে নিহিত ঐশ ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না” (রোমীয় ৮:৩৮)। এব্যাপারে যিশু আরো বলেছেন, “আমি তোমাকে ভালোবেসেছি” (যোহন ১৫:৯)। খ্রিস্ট উন্মোক্ত এবং আমাদের দিকে প্রসারিত এবং খ্রিস্ট শর্তহীনভাবে অপেক্ষা করছেন আমাদের কাছে ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব বিলিয়ে দেওয়ার জন্য- এবং যিশু খ্রিস্টের কারণেই আমরা জানতে ও বিশ্বাস করতে পেরেছি যে, “আমাদের প্রতি পরমেশ্বরের যে ভালোবাসা, তা আমরা জেনেছি আর তার ওপর বিশ্বাসও করেছি” (যোহন ৪:১৬)। হৃদয়ের গুরুত্ব- হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে আমরা খ্রিস্টের প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই। এ সময়টায় প্রয়োজনের নিমিত্তে আমাদের হৃদয়কে পুর্নবার আবিষ্কার করতে হবে-
তাহলে আমরা হৃদয় বলতে কী বুঝি? ন্ধদয় শুধু দেহের কেন্দ্রবিন্দু নয়- আমাদের আত্মা-প্রাণ, যার মাধ্যমে আমরা অন্যের সঙ্গে জড়িত হই। পোপ বলেন, মানুষ শুধু নানাকর্ম সমন্বিত করার জন্য পারদর্শী নয়- কিন্তু দেহ ও আত্মার সমন্বয় মানুষকে তার অভিজ্ঞতার আলোকে পরিচালিত করে। হৃদয় বলতে আমরা কি বুঝি? হৃদয় হলো আমার অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু- যা দেহ কাঠামোর অন্তরালে বিরাজমান- এবং ক্রিয়াশীল। “পথে তিনি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ও শাস্ত্রের অর্থ অমন বিশদভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন অন্তরে কি একটা আগুন জ্বলছিলো” (লুক ২৪:৩২)। পোপ বলেন, আমাদের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা আসে হৃদয় থেকে, “সেই বাণী হৃদয়ের বাসনা ও ভাবচিন্তাও বিচার করে” (হিব্রু ৪:১২)। হৃদয় সবকিছুর উর্ধ্বে, রোগ অপ্রতিকার্য, কে তা জানতে পারে (জের ১৭:৯)। হৃদয় সর্বদা জাগ্রত- যেখান থেকে প্রবাহিত হয় জীবনের বসন্ত এবং দূরে রাখে যতোসব মন্দ বাক্য। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, আমি কীভাবে বলতে পারি যে “আমি তোমাদের ভালোবাসি- যদি আমার মধ্যে হৃদয় না থাকে।” হৃদয়ের কাছে ফিরে যাওয়া- এ টলমল বিশ্বে, যেখানে সব মানুষ, সব জাতিগোষ্ঠী, পরিবেশ একত্রে বিদ্যমান- সেখানে আমাদের মোকাবেলা করতে হয় শক্তির মৌলিক উৎস, আবেগ ও সিদ্ধান্তকে। আমাদের সমস্ত কর্মকান্ড ন্যস্ত করতে হয় হৃদয়ের শাসনের কাছে- যেনো মন্দ শক্তিগুলো পরাজিত হয়ে উত্তম শক্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। হৃদয় বিচ্ছিন্নতাকে একত্রে আনে- এবং একমাত্র হৃদয়ই ব্যক্তির তৈরি বিচ্ছিন্নতাকে আবার একত্রে আনতে পারে। পোপ বলেন, আত্মকর্ম এবং আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে সমাজ হৃদয়হীন হয়ে পড়ছে এবং “ইচ্ছাশূন্য” হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা নিজেরাই নিজেদের তৈরি ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি। এমতাবস্থায় একমাত্র হৃদয়ই ফাঁদ থেকে বের করে ঈশ্বরের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে। হৃদয় দিয়েই বিশ্বের পরিবর্তন শুরু করতে হবে। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “পুনর্মিলন এবং শান্তির জন্মস্থান হলো হৃদয়।” খ্রিস্টের হৃদয় হলো আমাদের জন্য দান, মিলন- এবং এখান থেকেই আমরা শিখতে পারি- সুন্দর যাত্রাপথ এবং ঈশ্বরের রাজ্যকে করতে পারি ভালোবাসা ও ন্যায্যতার আবাস। দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা বলে, “আমাদের প্রত্যেককেই হৃদয়ে পরিবর্তন দরকার, আমাদের দৃষ্টি থাকতে হবে বিশ্বজুড়ে- যেনো মানবতার জন্য ভালো কাজগুলো একসঙ্গে করতে পারি” (বর্তমান জগতে খ্রিস্ট মণ্ডলী ২০)। কারণ, বিশ্বে যে “অসমতা” তা- শেকড় গেড়ে আছে হৃদয়ে। পোপ ১ম অধ্যায়ের শেষে বলেন, “খ্রিস্ট হলেন বিশ্বের হৃদয় এবং তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান রহস্য হলো ইতিহাসের কেন্দ্র এবং মুক্তির ইতিহাস।”
২য় অধ্যায় : ভালোবাসার কর্ম ও বাণী। খ্রিস্টের হৃদয়ের আদর্শ হলো গভীরতা এবং ব্যক্তিগত ভালোবাসার উৎস। এটা হলো মঙ্গলসমাচারের বাণী এবং বিশ্বাসের ভিত্তি। খ্রিস্ট তাঁর ভালোবাসা দীর্ঘ বাণীর মধ্যদিয়ে প্রকাশ না করে সঠিক কাজের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করেছেন। তিনি পথে প্রান্তরে পাপী-তাপী, অসুস্থ ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়াতেন ( যোহন ৪:৫-৭; ৩:১-২; লুক ৭: ৩৬-৫০; যোহন ৮:১১)। তাদের তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ঈশ্বর সঙ্গে রয়েছেন, আমাদের জন্য তাঁর আবেগ এবং তিনি যত্ন দেখাতে প্রস্তুত। একইভাবে ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকেও তাই চান। অন্যকে বিশ্বাস করতে যদি আমাদের কষ্ট হয়- তাহালে বুঝতে হবে আমার হৃদয় মিথ্যা, আঘাত ও অসন্তেুাষ দ্বারা আহত। আর যিশু তখন কানে কানে বলেন, “বৎস আর ভেবো না” (মথি ৯:২), “মা আর ভেবো না” (মথি ৯:২২)। যিশু সব সময় আমাদের জীবনে থাকতে চান, “আমি তোমাদের অনাথ অবস্থায় ফেলে রাখবো না, তোমাদের কাছে আবার ফিরে আসবো আমি। আর অল্প সময় মাত্র বাকি আছে তারপর সংসার আমাকে আর দেখতে পাবে না। তোমরা কিন্তু আমাকে দেখতে পাবে। আমি জীবিত আছি বলেই দেখতে পাবে, আর তোমরাও তখন তেমনি জীবিত থাকবে। যিশুর দৃষ্টি- সব সময় মানুষের সমস্যা এবং প্রয়োজন ঘিরে। তিনি কথার আগে এগিয়ে গেছেন মানুষের প্রয়োজনে। তিনি পথ চলতে চলতে এগিয়ে গেছেন অন্ধের দিকে, তুলে ধরেছেন খোঁড়াকে, নগরের বাইরে গিয়েছেন ১০জন কুষ্ঠরোগীর সন্ধানে। খ্রিস্টের বাক্য চিরকালীন ও সমকালীন- তার পরেও খ্রিস্ট আমাদের নিরবে ডাকেন আত্মায় বিশ্রামের জন্য। “যারা শ্রান্ত এবং বোঝার ভারে ক্লান্ত তারা আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের প্রাণের আরাম দেবো” (মথি ১১:২৮)।
৩য় অধ্যায় : এই হলো সেই হৃদয়- যেখানে গভীর ভালোবাসা বিদ্যমান। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, খ্রিস্ট একজন ব্যক্তি হিসেবে আমাদের বন্ধুত্ব ও অর্চনা তাঁর হৃদয়কে ঘিরে- যে হৃদয় পিতা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এ হৃদয় যেমন ঐশ্বরিক তেমনি মানবিক। আমরা একজন ব্যক্তির হৃদয়কে নয় কিন্তু পুনরুত্থিত পুত্রের হৃদয়কে গ্রহণ করি। এ হৃদয় হলো অশেষ ও বিনাশহীন- এ বিষয়ে পোপ বলেন, “খ্রিস্ট জীবনের শেষ মুহুর্তেও আমাদের উদ্দেশ্যে নিজের বাহু প্রসারিত করেছেন এবং মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হয়ে এখন আমাদের মধ্যে বসবাস করছেন।” খ্রিস্টের প্রতিরূপ আরাধনা প্রসঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “ খ্রিস্টের প্রতিরূপ ও তাঁর হৃদয়কে আমরা শুধু কিছু বস্তু হিসেবে পূজা-অর্চনা করি না বা অন্য আরো কিছু প্রতিকৃতির মতো পূজা-অর্চনা করি না, এটা কারো শিল্পীর হাতে সৃষ্টি নয়, এ প্রতিকৃতি কল্পনার নয়, কিন্তু বাস্তব এবং গোটা মানবতার মুক্তিকেন্দ্রিক উৎস।” পোপ বলেন, ভালোবাসা যা বোধগম্য হয়, অন্যদিকে “ভালোবাসা ও মানুষের হৃদয় অনেক সময় এক সঙ্গে যায় না- থাকে ঘৃণা, বিভাজ্যতা, আত্মকেন্দ্রিকতা।” আমরা কখনো মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারবো না- যদি অন্যের দিকে আমাদের হৃদয় প্রসারিত না করি। ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসার জন্য- এবং তখনই ঈশ্বরের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করি যখন আমরা ভালোবাসতে শিখি। আমাদের হৃদয় হলো ভালোবাসার উৎস। খ্রিস্টের ভালোবাসা হলো ত্রি-মাত্রিক। ১. আমরা তারঁ অশেষ ঐশ্বরিক ভালোবাসা ধ্যান করি, ২. আমাদের চিন্তা-ভাবনার আধ্যাত্মিকতা মানবতার দিকে প্রসারিত হয়- যেখানে আকুল হৃদয় তাঁর দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে মানবিক ইচ্ছায় পরিপূর্ণ হয় এবং ৩. এসব তাঁর হৃদয়ের সংবেদনশীল ভালোবাসা। পোপ বলেন, এই ত্রি-মাত্রিক ভালোবাসা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা নয়- কিন্তু একত্রে গভীরভাবে পরিপূর্ণতা প্রকাশ করে। খ্রিস্টের ভালোবাসা ত্রি-ব্যক্তিক। এখানে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে তিনি নিজের সম্পর্কে কি বলেছেন, “আমিই পথ, আমিই সত্য, আমিই জীবন- আমাকে পথ করে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না” (যোহন ১৪:৬)। যিশু আমাদের পিতার কাছে নিতে চান। সে জন্য আদিকাল থেকেই মণ্ডলীর শিক্ষা দিয়ে আসছে যে, খ্রিস্টের মধ্যদিয়েই প্রচার শেষ নয়- সব কিছুর সমাপ্তি হলেন পিতা ঈশ্বর- যিনিই মহিমান্বিত। পোপ ফ্রান্সিস, তাঁর পূর্বেকার মণ্ডলীর পিতৃগণের বিভিন্ন উদৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, “খ্রিস্টের হৃদয় বিরামহীনরূপে খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে বিরাজমান।” খ্রিস্টের হৃদয়ের ভালোবাসা পবিত্র আত্মার মধ্যদিয়ে আমরা অধিকার হিসেবে পেয়েছি। তবে আমাদের হৃদয়কে সমসাময়িকযোগ্য করে রাখতে হবে। তা করতে হবে ধ্যান, বাইবেল পাঠ এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মধ্যদিয়ে।
৪র্থ অধ্যায়: এ ভালোবাসা হলো তৃষ্ণা নিবারণ। এ বিষয়ে বাইবেলের প্রাচীন নিয়ম থেকে পোপ ফ্রান্সিস কিছু উদ্বৃতি তুলে ধরেন। “আনন্দের সঙ্গে তোমরা মুক্তির কূয়ো থেকে জল উত্তোলন করবে” (ইসা. ১২:৩)। এ প্রসঙ্গে প্রাবক্তিক বাণী হলো, “আর আমি তোমাদের উপরে শুদ্ধজল প্রক্ষেপ করবো তাতে তোমরা শুচি হবে… আমি তোমাদের নতুন হৃদয় দিবো” (এজে. ৩৬:২৫-২৬)। প্রবক্তা এজেকিয়েল এ বিষয়ে আরো বলেন, “সেই নদীর তীরে এপার ওপার অনেক বৃক্ষ ছিলো। এই জল পূর্ব অঞ্চলে বইছে এবং অরাবা তলভূমিতে নেমে যাবে ও সমুদ্রের দিকে যাবে। যে জল বের করা হয়েছে তা সমুদ্রে নেমে যাবে এবং সমুদ্রের জল উত্তম হবে” (৪৭:৭-৯)। কিন্তু যিশুর হৃদয় থেকেও জল প্রবাহিত হয়েছে। খ্রিস্টানদের স্পষ্টভাবেই হৃদয়ের পাশ থেকে প্রবাহিত জলধারা দিয়ে তাদের কাছে অঙ্গীকার পূরণ করা হয়েছে। তাতে করে শাস্ত্রবাণীও পূর্ণ হয়েছে,“যাকে তারা বিদ্ধ করেছে, তাঁর দিকে চেয়ে থাকবে তারা” (যোহন ১৯:৩৭)। যোহন আরো বললেন, “কেউ যদি তৃষ্ণার্ত হয় তবে সে আমার কাছে আসুক, যে আমাকে বিশ্বাস করে সে আসুক পান করুক। জীবনময় জল তাঁর অন্তর থেকে শতধারায় প্রবাহিত হবে” (৭:৩৭-৩৮)। যিশু বলেছিলেন, আমার সময় এখনো আসেনি। “যিশু তখনো মানিমান্বিত হননি” (যোহন ৭:৩৯)। তিনি মহিমান্বিত হয়েছেন- যখন তাঁর হৃদয় থেকে প্রবাহিত হলো জলধারা। যিশুর হৃদয়ের ক্ষত হলো ভালোবাসার উৎস- যা ঈশ্বর তাঁর জনগণকে গণনাসাধ্যের উর্ধ্বে দেখাতে চাইলেন। এ প্রসঙ্গে প্রত্যাদেশ গ্রন্থ বলে, “যাঁকে দেখতে পাবে প্রতিটি চোখ, দেখতে পাবে তারা, যারা তাঁকে বিদ্ধ করেছে” (১:৭)। যারা খ্রিস্টলাভের জন্য তৃষ্ণার্ত, তাদের বিষয়ে প্রত্যাদেশ ২২:১৭ পদে বলা হয়েছে, “এসো, যারাই তৃষ্ণার্ত, এগিয়ে আসুক তারা, যারাই জীবনজল পেতে চায়, অঞ্জলিভরে গ্রহণ করুক তারা- কোনো মূল্যই দিতে হবে না।” এই বাক্য কিন্তু ইতিহাস জুড়েই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ইতিহাসের সাধুব্যক্তিগণ বলেছেন, খ্রিস্টের হৃদয় থেকে প্রবাহিত রক্ত ও জলধারা যুগ যুগ ধরে বিশ্বাসীদের জীবন বিসর্জন দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। সাধু আগস্টিন এটাকে our intimate union with Christ, খ্রিস্টের সঙ্গে আমাদের একান্ত ঘনিষ্টতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এভাবে খ্রিস্ট হৃদয়ের প্রতি মানুষের অর্চনা- আরাধনা প্রথমে আশ্রম জীবন এবং বাণী প্রচারকদের আধ্যাত্মিকতা পুরিপূষ্ট ক’রে, ধীরে ধীরে ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমৃদ্ধ ক’রে, তাদেরকে উৎসাহিত করেছে খ্রিস্টের হৃদয়ের আহ্বান বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে দিতে।
৫ম অধ্যায় : ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা। যিশুর ভালোবাসার তৃষ্ণা আমাদের বলতে চায় যে, আমরা যেভাবে এ ভালোবাসার উত্তর দেই আসলে তাঁর তৃষ্ণা সেরূপ নয়। আমাদের কাছে তাঁর তৃষ্ণা হলো এবং তিনি চান, সাক্রামেন্তের মতো তাকে হৃদয়ে গ্রহণ করি- এবং তৃষ্ণা নিবারণ করি। খ্রিস্টের ভালোবাসা আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে বিস্তৃত। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “খ্রিস্ট হৃদয়ের ভালোবাসার প্রতি আমাদের উপযুক্ত উত্তর হলো- ভাই-বোনদের প্রতি ভালোবাসা এবং এ ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে ফিরে যাওয়া বৃহৎ কোনো ভালোবাসা নয়।” সাধু পৌল বলেন, “কারণ, সমগ্র ঐশ বিধানের সারকথা এই একটি আদেশের মধ্যে ব্যক্ত, তোমরা প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসবে” (গালা ৫:১৪)। যিশুর হৃদয়ের ভালোবাসা এক স্থানে বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আমার এই তুচ্ছতম ভাইদের একজনেরও জন্যে তোমরা যা কিছু করেছো, তা আমার জন্যেই করেছো” (মথি ২৫:৪০)। যোহনের প্রথম পত্রে বলা হয়েছে,“কেউ যদি বলে সে পরমেশ্বরকে ভালোবাসে, আর তবুও সে যদি নিজের ভাইকে ঘৃণা করে তবে সে মিথ্যাবাদী। কারণ যাকে সে দেখতে পায়, তার সেই ভাইকে সে যখন ভালোবাসে না, তখন যে পরমেশ্বরকে সে দেখতে পায় না, তাঁকে সে তো ভালোবাসতেই পারে না” (৪:২০)। খ্রিস্ট- সমাজের সবার মধ্যে সমান মর্যাদা আনতে চেয়েছেন। বিশেষ করে যারা অপ্রয়োজনীয়- তেমন প্রত্যেকজনকে তিনি “প্রয়োজনীয়” হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। খ্রিস্টের সঙ্গে আমাদের একাত্বতা শুধু মাত্র আমাদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নয়- কিন্তু তৃষ্ণা নিবারণের এই জীবন্ত জলধারা যেনো বইতে পারে সবদিকে। পোপ ফ্রান্সিস গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি বলতে চান, তা হলো- ঘৃণা, বিবাদ, অমানবিক কর্মকান্ডের কারণে বিশ্বের ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয়কে এখন জোড়া লাগানোর সময়- এবং এ তৃষ্ণা নিবারণের জন্য খ্রিস্টের হৃদয় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছেন। আমাদের এখন বিশ্বের সর্বত্রই খ্রিস্টের হৃদয় ও ভালোবাসা বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়।
উপসংহার: খ্রিস্ট মণ্ডলীতে এখন এ ভালোবাসার অতি প্রয়োজন। আমাদের বাদ দিতে হবে সমাজের প্রতি মেয়াদোত্তীর্ণ ধারণা, বাদ দিতে হবে নিজের বলে সব আয়ত্বে রাখা, বেরিয়ে আসতে হবে নিজের মতামত বহাল রাখা থেকে, নানা রকমের গোঁড়ামী পরিত্যাগ করে হৃদয়ে আনতে হবে আনন্দ এবং তৈরি করতে হবে নবীন সমাজ- আর সবাইকে ভালোবাসতে হবে, ভালোবাসা-সর্বজনীন ভালোবাস- কারণ তিনি আমাদের ভালোবেসেছেন।
(পোপ ফ্রান্সিস- ভাটিকান সিটি, অক্টোবর ২৪/ ২০২৪)