গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বিকালে ডিকন বিনেশ মার্টিন তিগ্যা’র মঙ্গল কামনা করে আশির্বাদের অনুষ্ঠান পবিত্র ঘন্টা করা হয়। এই আশির্বাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ও লক্ষণপুর ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার সমর সেবাস্টিয়ান দাংগ অন্যান্য ফাদার-সিস্টারগণ ও ধর্মপল্লীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত খ্রিস্টভক্তগণ।
২২ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ডিকন বিনেশ যাজকপদে অভিষিক্ত হন। অভিষেক অনুষ্ঠানের পবিত্র খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরহিত্য করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও। পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে আগত ৩৭ জন ফাদার, ২ জন ডিকন, ১৫ জন সিস্টার ও প্রায় ১০০০ এর মতো খ্রিস্টভক্ত।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও উপদেশ বাণীতে বলেন- লক্ষণপুর “সাধু ইউজিন” ধর্মপল্লীর অন্তর্গত শিহাড়া গ্রামের সন্তান ডিকন বিনেশ মার্টিন তিগ্যা ২২ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টবর্ষে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের লক্ষণপুর ধর্মপল্লীতে যাজকরূপে অভিষিক্ত হন। এই দিনটি শুধুমাত্র নব অভিষিক্ত যাজক বিনেশ মার্টিন তিগ্যার জন্য মহাআনন্দের নয়, আনন্দ তার পরিবারের, আত্মীয়স্বজন ও ধর্মপল্লীবাসী সকলের। ধর্মপ্রদেশের বিশপ হিসেবে আমার জন্যও অতি আনন্দের এবং আমি সকলের আনন্দের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করি। যাজক হচ্ছেন মঙ্গলবাণীর একজন সেবক, ঘোষক, শিক্ষক ও প্রেরিতদূত। সে প্রতিটি মুহুর্তে নিজেকে এই পবিত্র কাজের জন্য যোগ্য করার লক্ষ্যে মহাযাজক প্রভু যিশুর আদর্শ ও জীবনকে অনুসরণ করে। যাজকীয় জীবনে নিজে পবিত্র থেকে ও অন্যদের পবিত্র করে, মঙ্গলবাণী নিজে পালন করে ও তা প্রচার করে, খ্রিস্টের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ও সেই নেতৃত্বের সেবা দিয়ে যাজক মঙ্গলবাণীর সেবা করে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান জগতে যাজকীয় জীবন ও সেবাকাজ অনেক বেশী চ্যালেঞ্জপূর্ণ। যাজকীয় জীবনে জগতের প্রভাব অনেক বেশী। জাগতিকতার মধ্যে বাস করেও জাগতিকতার উর্ধ্বে থাকতে হয়। তাই এই চ্যালেঞ্জকে জয় করার জন্য যাজককে যিশুর সাথে গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ভক্তি ও ভালবাসা, যিশুর প্রতি গভীর আনুগত্য ও বাধ্যতা এবং মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ততা রাখতে হয়।
নব অভিষিক্ত ফাদার বিনেশ মার্টিন তিগ্যা তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন– খ্রিস্টেতে শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রিয়জনেরা, আজ আমার জীবনের জন্য এক অতি আনন্দের দিন। এই মিলনযজ্ঞে আমি মঙ্গলময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই কারণ তাঁর ঐশ পরিকল্পনায় আমি এই পৃথিবীতে এসেছি। পুণ্যবেদীতে তাঁর পুত্রের মহাযাজকত্বে অংশী হতে তিনি আমাকে আহ্বান করেছেন, যেন পুণ্য যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারি। ধন্যবাদ জানাই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও’কে; যিনি আমাকে তার সহকর্মী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমার যাজকীয় জীবনের পথ চলায় যারা আমাকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করে আসছে তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি। আজ আমি সত্যিই আনন্দিত যে, আমি প্রভুর দ্রাক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি অযোগ্য হওয়া সত্বেও ঈশ্বর আমাকে তার কাজে মনোনীত করেছেন। এই জীবনে আসার জন্য যাদের অকৃত্রিম ভালবাসা, সেবা যত্ন, শাসন, সুশিক্ষা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা, যথেষ্ট ত্যাগ-স্বীকার এবং অনবরত প্রার্থনায় আমি আজ যাজক হিসেবে বেদীতে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার স্বর্গীয় বাবার কথা স্মরণ করি। আমার বাবা আমাকে সেমিনারীতে প্রবেশের পরপরই বলত। আমার একজন ছেলে ফাদার হয়ে গেছে। আমি যখন বাবার মুখে এই কথা শুনি তখন আমার মনে দাগকাটে এবং আমি ফাদার হওয়ার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। যদিও বাবা আজ পাশে নেই কিন্তু বিশ্বাস করি বাবা আমাকে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ করছে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ফাদার সিস্টার এবং গ্রামের প্রার্থনা পরিচালক, ভালবাসা, সহযোগিতা ও দিক নির্দেশনা যা যাজক হওয়ার গভীর আগ্রহে রূপায়িত করেছে। পরিশেষে আবারও সৃষ্টিকর্তা, সকল খ্রিস্টভক্ত এবং পরম শ্রদ্ধয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও কে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজকের এই দিনে সবাইকে আমার অন্তরের ভালাবাসা ও কৃতজ্ঞতা এবং সকলকে আশীর্বাদ করি। যাতে আমরা সকলে এক সাথে খ্রিস্টের দেখানো পথে পথ চলতে পারি। সবাইকে যাজকীয় অভিষেকের শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানাই।
নব অভিষিক্ত যাজকের মা তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, যখন বিনেশ বলে যে সে ফাদার হবে তখন আমার খুব চিন্তা লাগত। এখন আনন্দ লাগছে। ছোট থেকে বিনেশ খুব রসিক ছিল। এমন এমন কথা বলতো যে খুব হাসি পেত। বিনেশের ছোট বাবা মানে মহীলাল তিগ্যা বলতো, আমি তো আমার ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারলাম না তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে অবশ্যই একজনকে ফাদার বানাবে।
লক্ষণপুর গ্রাম প্রধান মি: যুগোল এক্কা তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, নিঃসন্দেহে ফাদার বিনেশের উদ্যোগটা অতি মহৎ। কারণ ফাদার তো যেমন তেমন লোক হতে পারে না, এটা তো সাধনার ব্যাপার। আর এই বিষয় নিয়ে তো পড়াশুনাও করতে হয়। এটা আমাদের জাতি হিসেবেও গর্বের বিষয়।
লক্ষণপুর ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার সমর সেবাস্টিয়ান দাংগ বলেন, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ডিকন বিনেশ মার্টিন তিগ্যা এর যাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠান এবং এই অভিষেকের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রভুর দ্রাক্ষাক্ষেত্রে চিরকালীন যাজক ও সেবাকর্মী হিসাবে আত্ম নিবেদন করেন। ডিকন বিনেশ মার্টিন তিগ্যা এক সময় ঈশ্বরের ডাক “তোমরা আমার সঙ্গে চল! আমি তোমাদের করে তুলব মানুষ-ধরা জেলে” (মথি ৪: ১৯ পদ) শুনেছেন এবং এই ডাকে ধীরে ধীরে সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরের জ্ঞানে, বুদ্ধিতে ও প্রজ্ঞায় পরিপক্কতা লাভ করেছেন। তার পরিপক্কতা লাভে এবং জীবনের এই মুহুর্ত পর্যন্ত পৌঁছতে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক শিক্ষক শিক্ষিকার ও অসংখ্য শুভাকাঙ্খী মানুষের ভালবাসার ও ত্যাগের অবদান আছে। তাই তো তিনি আজ একজন অভিষিক্ত যাজক হিসেবে এই জগতে ঈশ্বরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং ঐশ জনগণের সেবাতে নিজেকে নিবেদন করেছেন। তিনি যেহেতু বর্তমানে সাধু ইউজিন ধর্মপল্লীর অন্তর্গত শিহাড়া গ্রামের সন্তান, তাই ধর্মপল্লীর সকল খ্রিস্টভক্তদের জন্য এটি একটি আনন্দ ও আশীর্বাদ এবং মণ্ডলীর জন্যেও বড় আনন্দ। আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই তিনি ডিকন বিনেশ মার্টিন তিগ্যাকে আমাদের জন্য মণ্ডলীতে একজন যাজক হিসেবে দান করেছেন এবং যাজক বিনেশ মার্টিন তিগ্যাকে জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি তার এই যাজকীয় জীবনে সকল বাধা ও প্রলোভনকে জয় করে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল হয়ে তার সেবার কাজ করে যেতে পারবেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার