ফাদার সাগর কোড়াইয়া
বোর্ণী ধর্মপল্লীর ইতিহাস লিখতে গেলে পলু শিকারীর (পল গমেজ) নাম চলে আসবেই। পলু শিকারী উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল অভিবাসিত খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি। দীর্ঘ সময় ধরে খ্রিস্টবিশ্বাসের আলো প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছিলেন মথুরাপুর, বোর্ণী ও বনপাড়া অঞ্চলে। পরবর্তীতে তারই দেখানো পথে আরো অনেকে ভাগ্যান্বেষণে অজানার উদ্দেশ্যে অত্র এলাকায় চলে আসেন। পলু শিকারীর জীবনটা ছিলো বহুরূপী। শেকারের নেশায় উন্মত্ত হলেও তিনি খ্রিস্টবিশ্বাস ধরে রাখার অদম্য নেশা জীবনভর ধরে রেখেছেন। তাই অত্র এলাকার খ্রিস্টানদের অগ্রপথিক হচ্ছেন পলু শিকারীকে।
গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলের নাগরী মিশনের বাগদী গ্রামের পল গমেজ যাকে সবাই ‘পলু শিকারী’ নামে চিনতো। পলু শিকারীর জন্ম আনুমানিক ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। আর এই পল গমেজকেই (পলু শিকারী) অত্র এলাকায় ভাওয়াল খ্রিস্টানদের অগ্রপথিক হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। পলু শিকারীর নামের মধ্য দিয়েই তাঁর পরিচয় ব্যক্ত হয়। তিনি শিকার করতে পছন্দ করতেন। আর তৎকালীন সময়ে যেহেতু ভাওয়াল এলাকা বনজঙ্গলে ভরপুর ছিলো তাই তিনি তাঁর বন্দুক দিয়ে বাঘ, শুকর ও অন্যান্য পশুপাখি শিকার করতেন। তাই পলু শিকারীর উপর জনগণের আস্থা ছিলো বলা চলে। পলু শিকারী নাগরীর বাগদী গ্রামে থাকাকালীন শিকারে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। আনুমানিক ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যখন চাটমোহরের জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও হিংস্র বন্য শুকরের অভয়াশ্রম চাটমোহর এলাকার উত্থলী গ্রামের ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানরা ভীত অবস্থায় বসবাস করতে থাকেন তখন ব্যাপ্টিস্ট পালক বন্য শুকরের মুখোমুখি হয়ে ভয় পান। তিনি শর্ত দেন যদি শুকরগুলোকে ধ্বংস না করেন তাহলে তিনি আর এই এলাকায় আসবেন না। তাই খ্রিস্টভক্তগণ পালকের বাবুর্চীর কথানুসারে বাবুর্চীর বন্ধু পল গমেজকে অনুরোধ করলে তিনি তা আনন্দে গ্রহণ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১৯২০ বা ২১ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে বর্তমানের চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুরে একাকী আসেন। এমনিতেই বিদেশবিভূঁইয়ে অপরিচিত এলাকা। অত্র এলাকায় আসার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শিকার করা। স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্য কোনভাবেই ছিলো না। তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আসাটা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত না। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পলু শিকারী প্রথমবার একাকী অথবা উত্থলী থেকে ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানরা যারা পলু শিকারীকে খবর দিতে গিয়েছিলেন তাদের সাথে তিনি চাটমোহরের মথুরাপুরে আসেন। আবার এ থেকে এও প্রমাণিত হয় যে, সে সময় উত্থলীর ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের পালকের বাবুর্চীর কল্যাণে ভাওয়ালের খ্রিস্টানদের সাথে অত্র এলাকার যোগাযোগ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো।
ব্যাপ্টিস্ট পালকের বন্য শুকরের ভয় দূর করার পাশাপাশি পলু শিকারী আশেপাশের চাটমোহর ও বড়াইগ্রামের জোনাইল, বনপাড়া, মুলাডুলি এলাকায় বাঘ ও শুকর শিকার করতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিকারের সুবিধা এবং শুকরের লেজের বিনিময়ে তিনি জমিদারের নিকট থেকে জমি লাভ করেন। ভালোবেসে ফেলেন অত্র এলাকার বন্য পরিবেশ। শিকারের সুব্যবস্থা, জমিদার ও মানুষের সহযোগিতা এবং অঢেল জমির হাতছানির কারণে তিনি বসতির ব্যবস্থা করে আবার ভাওয়াল এলাকায় ফিরে যান। এরপর তিনি স্ত্রী ও পুত্র যোসেফ গমেজ এবং মেয়ে ক্লারা গমেজকে নিয়ে প্রসিদ্ধ তেনাছেঁড়া বটগাছের পশ্চিম পার্শে চিকনাই নদীর পশ্চিম পাড়ে মথুরাপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এটাই ছিলো মূলত এই এলাকায় ভাওয়াল কাথলিক খ্রিস্টানদের আগমনের সূচনা।
তেনাছেঁড়া বটগাছের বিষয়ে কিছু বলা দরকার। চাটমোহর রেলস্টেশন ও থানার সংযোগ স্থাপনকারী সড়কের মাঝামাঝি মথুরাপুরে তেনছেঁড়া বটগাছের অবস্থান ছিলো। তেনাছেঁড়া নামের কারণে মোড়টি আজও পর্যন্ত তেনাছেঁড়া নামেই পরিচিত। এলাকায় জনশ্রুতি ছিলো যে, যদি কেউ কোন মানত করে উক্ত বটগাছে এক টুকরো কাপড় বা খড়কুটো ঝুলাতো তবে তার মনের আশা বা মানত পূর্ণ হবে। বটগাছটি ছিলো বিরাটাকার ঝাঁকড়ানো। বটগাছে এতই তেনা ও খরকুটো বাঁধা থাকতো যে দিনের বেলায় গাছের তলা দিয়ে যেতে অনেকে ভয় পেতো।
পলু শিকারী আসার পর পরই কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ভাই ডেঙ্গুরী গমেজ (মিস্ত্রি), মালান কস্তা, আগষ্টিন কস্তা, মানিক কস্তা লাউতিয়া গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন। ভাওয়াল থেকে আগমনের পরে ভাওয়ালবাসী খ্রিস্টানগণ খ্রিস্টধর্ম চর্চা ভুলে যাননি। বরং এই বিদেশবিভুঁইয়ে এসেও খ্রিস্টবিশ্বাস চর্চার বিষয়টা অক্ষুন্ন রেখেছেন। পালকীয় সেবা পাবার জন্য তাঁরা বারবার ঢাকার আর্চবিশপের নিকট চিঠি লিখতে শুরু করেন। অবশেষে কোন প্রকার সাড়া না পাওয়ায় সর্বশেষ চিঠিতে তাঁরা লিখেন, ‘আপনারা যদি হারানো মেষদের খুঁজে না নেন তাহলে আমরা ব্যাপ্টিস্ট হয়ে যেতে বাধ্য হবো’। অবশেষে এই চিঠিতে কাজ হলো। ‘হলিক্রশ ফাদার তিমথি জন ক্রাউলী ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন প্রথমবারের মতো পালকীয় যত্নের জন্য মথুরাপুরে পলু শিকারীর বাড়িতে আগমন করেন। সেখানেই ফাদারের থাকা-খাওয়া ও অত্র এলাকায় পালকীয় যত্ন নেবার ব্যবস্থা করা হয়। এরই মধ্যে পলু শিকারী লাউতিয়া গ্রামে এসে বসতি গড়ে তোলেন। এলাকায় খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফাদার ক্রাউলী মিশন গড়ার জন্য পলু শিকারীর নিকট জমি চাইলে লাউতিয়াতে ডেঙ্গুরী গমেজ ও আগষ্টিন কস্তা মিলে দুই খণ্ড জমি দান করেন। এভাবেই ১৯২৫/২৬ খ্রিস্টাব্দে লাউতিয়াতে মথুরাপুর মিশনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
রবিবাসরীয় দিনে যাজকের অনুপস্থিতিতে পলু শিকারী প্রার্থনা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। এছাড়াও সামান্য অক্ষরজ্ঞান জানা পলু শিকারী গ্রামের ছেলেমেয়েদের অক্ষর শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। সন্তানদের শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে পলু শিকারী ও গ্রামবাসী তুমিলিয়া মিশনের পিপড়াশৈড় গ্রামের ভিনসেন্ট ছেরাওকে শিক্ষক হিসাবে (বিছান্তি মাষ্টার) নিয়ে আসেন। এখানে এসে এলাকা পছন্দ হয়ে যাওয়ায় তিনি জমিজমা ক্রয় করে লাউতিয়াতে বসতি স্থাপন করেন। ফাদার তিমথি ক্রাউলী ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের বিশপ নিযুক্ত হলে পরবর্তীতে আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীর ফাদার পিটার কার্নেভালেকে বনপাড়া থেকে মথুরাপুরে পালকীয় সেবাদায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানান। আন্ধারকোঠায় সংরক্ষিত দীক্ষা রেজিষ্টারে ২৯ এপ্রিল ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মথুরাপুরের লাউতিয়া গ্রামের কার্লো কাঞ্চন (পিতার নাম স্পষ্ট নয়। মাতার নাম আন্তনী আলমিদা) নামক একজনের প্রথম দীক্ষার রেকর্ড রয়েছে।
ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মথুরাপুর ধর্মপল্লী হিসাবে উন্নীত হলে তা আবারো ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৬/৪৮ খ্রিস্টাব্দে লাউতিয়া থেকে মথুরাপুরের বর্তমান স্থানে মিশন স্থানান্তর করা হয়। ঢাকার গোল্লা ধর্মপল্লীর সন্তান ফাদার ডমিনিক রোজারিও মথুরাপুরের প্রথম পাল-পুরোহিত (১৯৪৮-১৯৫৬) নিযুক্ত হন। পলু শিকারী লাউতিয়ায় ১০ বা ১২ বছর অতিবাহিত করার পর বড়াইগ্রামের মানগাছায় গিয়ে বসতি গড়ে তোলেন। এখানে শুকরের কামড়ে তিনি আহত হন। পরবর্তীতে তিনি আবার চাটমোহরের বর্তমান হরিপুর ইউনিয়নের কাতুলী গ্রামে এসে বাস করতে থাকেন।
ইতিমধ্যে পলু শিকারীর স্ত্রী মারা গেলে তিনি মথুরাপুর গ্রামের খাডাস বাড়িতে দ্বিতীয় বিয়ে (পিতর রোজারিও’র পিসি) করেন। পলু শিকারীর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে পরশী গমেজ নামে একজন সৎমেয়ে ছিলো। কাতুলী গ্রামেই আনুমানিক ৮০ বছর বয়সে ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে চাটমোহর ও বড়াইগ্রাম এলাকায় খ্রিস্টধর্মের অগ্রপথিক পলু শিকারী (পল গমেজ) মৃত্যুবরণ করেন। মথুরাপুর মিশনের ফাদার বাড়ির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে যে কবরস্থান ছিলো সেখানে পল গমেজকে (পলু শিকারী) কবরস্থ করা হয়।
স্বর্গীয় বার্ণার্ড গমেজ (বারো) পল গমেজ ওরফে পলু শিকারীর ছেলের ঘরের বড় নাতি। বার্ণার্ড গমেজ দাদুর সান্নিধ্যে থেকে দাদুর বিষয়ে অভিজ্ঞতা করেছেন বিস্তর। মথুরাপুর মিশনে অনুষ্ঠিত ভাওয়াল খ্রিস্টানদের অত্র এলাকায় এসে বসতি গড়ার শতবর্ষ স্মরণিকায় পলু শিকারীর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, “দাদু (পলু শিকারী) আমাকে দাদু বলে ডাকতেন। দাদু ৫/৬ মাস শিক্ষকতাও করেছেন প্রাইমারী স্কুলে। তিনি চাউল গুড়া দিয়ে চা খেতে ভালবাসতেন। প্রচণ্ড ঝালও খেতেন। আর সে কারণে পেটে আলসার রোগ ধরা পড়ে। আমি ঢাকায় চাকুরী করার সময় দাদুকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসাও করিয়েও ছিলাম। দাদুর পছন্দ করা মেয়েকেই আমি বিয়ে করি। দাদু আমার স্ত্রী ও আমাকে অনেক আদর করতেন।
মনে পড়ে দাদুর সাথে বেশ কয়েকবার নাগরীর বাগদী গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দাদু আনারস কেঁটে দিতেন। বৃদ্ধ বয়সেও দাদুকে বেশ সাহসী দেখেছি। আমার বাবা যোসেফ গমেজকে একবার শুকর আক্রমণ করলে দাদু তাকে বাঁচান। দাদু বেশ পরোপকারী মানুষ ছিলেন। ছেলেমেয়েদের আদর করতেন খুব। মাঠে খেলা হলে দাদু সব সময় খেলা দেখতে যেতেন এবং নিজেও খেলতে পছন্দ করতেন। কাতুলী গ্রামের ছুলু চার্লির সাথে ঠাকুরের গীতে দাদু দোয়াড় টানতেন। পলু শিকারীর নাতি হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি”।
পলু শিকারীর আরেকজন নাতি যোয়াকিম গমেজ কৈশোরকালীন অবস্থায় দাদুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। পলু শিকারীর মৃত্যুর স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, দাদু মৃত্যুর আগের দিন সকালে ছেলে যোসেফ গমেজকে (যোয়াকিম গমেজের বাবা) ডেকে আঙ্গুর ও কমলা খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ছেলে যোসেফ গমেজ সকালবেলা কমলা ও আঙ্গুর ক্রয় করতে ঈশ্বরদীতে যান। যোসেফ গমেজ রাত দশটায় ফিরে এলে পলু শিকারী ছেলেকে আঙ্গুর ও কমলা দিতে বলেন। যোসেফ গমেজ বাবাকে বলেন যে শুধু কমলা পাওয়া গিয়েছে। ঈশ্বরদী ও পাবনা কোথাও আঙ্গুর পাওয়া যায়নি। পলু শিকারী তৃপ্তি সহকারে কমলা খান।
রাতের বেলায় পলু গমেজ নাতি যোয়াকিম গমেজকে ডেকে বলেন যেন পরদিন ছেলে যোসেফ গমেজ কোথাও না যান। পরদিন ভোর হওয়ার সাথে সাথে যোয়াকিম গমেজ দাদুকে ভোর হওয়া এবং পূর্বাকাশ লাল হওয়ার কথা বলেন। পলু শিকারী নাতি যোয়াকিম ও নাতি বউ শেলিন গমেজকে (বার্ণার্ড গমেজের স্ত্রী) বলেন, যেন উঁনাকে ঘরের বাহিরে নিয়ে পূর্বদিকে মুখ করিয়ে বসানো হয়। নাতি ও নাতি বউ পশ্চিম ঘরের উঠানে পাটি বিছিয়ে পলু শিকারীকে পূর্বমুখ করে বসান। পলু শিকারী সূর্যের দিকে চোখ মেলে তাকান। এরপর ছেলে যোসেফ গমেজের গালে হাত বুলিয়ে আদর করে ছেলের নিকট পানি পান করতে চান। ছেলে যোসেফ গমেজ ও ছেলে বউ মার্টিনা গমেজের নিকট থেকে পানি পান করে পলু শিকারী (পল গমেজ) মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে ছেলে যোসেফ গমেজ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কোনদিন আঙ্গুর ফল খাননি।