ফা: সুশীল লুইস পেরেরা

শুরুর কথা: মঙ্গলময় প্রভু পরমেশ্বর তাঁর অমর বাণী আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন পবিত্র বাইবেলে। আর আমরা তাঁর বিশ্বাসী মানুষ গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধায় সেই অমৃত বাণী পাঠ-শ্রবণ করি ও তার গভীরতায় জীবনধারণ করতে বার বার ডাক ও দায়িত্ব পাই। আমরা তাই ব্যক্তি, পরিবার, দল, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও মাণ্ডলিক জীবনের নানা পরিসরে সেভাবে প্রভুর জীবণ বাণীকে সম্মান, পাঠ ও শ্রবণ করি। প্রভুর বাণী যীশু ও মানব মুক্তির এক বিশেষ সু-সংবাদ যা সবাইকে দান করে অফুরন্ত জীবন-সম্পদ। বাণী পাঠের মাধ্যমে ঈশ্বর নেমে আসেন মানুষের স্তরে এবং মানুষকে নিয়ে যেতে চান তারই কাছে। তার কাছে যাবার আমন্ত্রণ পথ ও মত ব্যক্ত হয় বাণী পাঠের মাধ্যমে। বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে বাণী ঘোষণা মঙ্গলবার্তা প্রচারের উপযুক্ত ও উৎকৃষ্ট সুযোগ করে দেয়। খ্রীষ্টান জীবন, প্রচার ও উপাসনায় পবিত্র শাস্ত্রের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। শাস্ত্রবাণীতে প্রভুই বিরাজ করেন। প্রভুর বাণী হল মানবের মাঝে, ইতিহাসে ঈশ্বরের প্রেমময় উপস্থিতি, পরিচয়। দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার উপাসনা বিষয়ক সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়: “মণ্ডলীতে যখন শাস্ত্রপাঠ করা হয় তখন খ্রীষ্ট নিজেই কথা বলেন।” এই বাণী সত্যময়, আলোকময়, আনন্দময়, গতিময়। সাধু যোহনের মঙ্গল সমাচারে প্রভু যীশু বলেছেন: “আমি যে সব কথা তোমাদের বললাম, সে সব কথা তো আত্মিক শক্তি; সে সব কথাই তো জীবন” (৬: ৬৩)। এই বাণীতে পাই মোরা জীবন, প্রেরণা, শান্তি, আশা, ভালবাসা, ক্ষমা ও মুক্তি। পবিত্র বাইবেলের বিভিন্ন স্থানে পড়তে পারা যায় যে ঐশবাণী মানুষকে বিশ্বাস, জীবন, গঠন, শক্তি, শিক্ষা, সাহস ইত্যাদি দান করে। প্রভুর বাণীর মাধ্যমে তার ভক্তেরা সৃষ্ট ও পুনঃসৃষ্ট হয়। তারা তখন তাঁর পরিকল্পনা পূর্ণ করতে, নৈবেদ্য উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত হয়। বিশ্বাসী মানুষ এ জীবনবাণী ভক্তিতে পাঠ করবে, বিশ্বাসে অন্তর গভীরে ধারণ করে তাঁর আলোতেই আনন্দে সদা পথ চলবে। গীতাবলী ১০৬ বলে: “এই বাণী এসেছে স্বর্গ হতে পাপ থেকে মুক্তি দিতে। এই বাণী মোদের হৃদয়ে রাখবো ধরে নির্ভয়ে।” আরো একটু দেখা যাক প্রভুর বাণী কীভাবে মানুষের জীবনে অর্থপূর্ণ।

প্রভুর বাণী: মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের কথা: প্রভুর বাণী হল যুগ যুগ ধরে ধর্ম ও মানব মুক্তির ইতিহাস, মানব সভ্যতার ধর্ম রূপরেখা। সৃষ্টিকর্তা পিতা ঈশ্বর উপদেশ মূলক যে কথা, আদেশ নির্দেশ, ঐতিহাসিক ঘটনা, প্রজ্ঞার ধারা, প্রবক্তা ও প্রেরিত শিষ্যদের লেখা দ্বারা মানব মুক্তির রহস্য উন্মোচন করেন, তাই প্রভুর বাণীরূপে অখ্যাত। প্রেমময় রক্ষাকর্তা মানুষকে নিজের সঙ্গে মিলিত রাখতে মানুষেরই মাধ্যমে মানবীয় উপায়ে নিজ পরিচয় দান করেন এবং মুক্তিদাতার আগমনের অর্থ, কাজ সম্বন্ধে বিস্তৃত কথা বলেন আর এগুলিই প্রভুর বাণীরূপে চিহ্নিত। যীশুর মানব জন্ম লাভের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের বাণীর পূর্ণ প্রকাশ ঘটল। প্রভুর শান্তিময় বাণী দ্বারাই পৃথিবীর সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছে। সবাই সে বাণী শুনে, সে বাণী কোনদিন ব্যর্থ হবে না, শেষ হবে না। গুরু নানক বলেন: “হে সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম তুমি, তুমিই বাণী, তুমিই সত্য, তুমিই সৌন্দর্য্য।” ঈশ্বর মানুষকে তুলে ধরার জন্য মানুষের স্তরে নেমে এলেন মানুষের মতো কথা বলেন, কাজ ও জীবনাচরণ করেন। এরূপ করার পিছনে প্রভুর বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। ঈশ্বরের কাজ, উদ্দেশ্য পবিত্র বাইবেল লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও অন্যভাবে ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশ ঘটছে আর ঘটতে পারে। এই পবিত্র শাস্ত্রের মাধ্যমে স্বগর্স্থ পিতা, স্নেহ পরবেশ হয়ে তার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেন এবং কথা বলেন। হিব্রুদের প্রতি পত্রে (৪:১২) লেখা হয় যে: “পরেমেশ্বরের বাণী সপ্রাণ ও সক্রিয়। তা যে কোন দু’ধারী খড়গের চেয়েও তীক্ষ্ণ : তা অন্তরের সেই স্থানেও ভেদ করে গিয়ে পৌঁছায়, যেখানে প্রাণ ও আত্মা এবং গ্রন্থি ও মজ্জার ভাগবিভাগ।’’ নিজেরা প্রভুর বাণী, তাই বিভিন্ন পর্যায়ে গভীর ভালবাসায়-বিশ্বাসে বার বার পড়তে হবে। শুধু তাই নয়, সাধু পৌলের কথা হল মানুষ সে বাণী না শুনলে মানুষের অন্তরে বিশ্বাস জাগবেই বা কোথা থেকে কারণ শ্রবণ থেকেই আসে বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে তাই সহজ, সরল সুন্দর ও সঠিকভাবে প্রভুর বাণী অন্যদের শুনাতে হবে যেন সে বাণী শ্রোতাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগাতে পারে। অন্যের সামনে সঠিকভাবে বাণী পাঠ করা হল মানুষের জন্য এক সুন্দর উপহার। প্রভুর বাণী যেন ভক্তদের সামনে উপযুক্তভাবে পঠিত হয় এবং তা যেন সবার জীবনে গভীর অর্থ বয়ে আনে তাই হবে ধর্মানুষ্ঠানে প্রভুর বাণী পাঠ করার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রভুর বাণীকে এমনই গুরুত্ব দিয়ে, এমনই মর্যাদা দিয়ে পড়া উচিত তা যেন সবার জীবনকে ঈশ্বরের কথায় পূর্ণ করে তোলে। পোপ ষষ্ঠ পৌল বলেছেন: “খ্রীষ্টযাগের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পুণ্য সংস্কারের অনুষ্ঠানে এবং অন্যান্য ধর্মানুষ্ঠানে যেখানে খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা সন্মিলিত হন সেখানে বাণী ঘোষণা ও ব্যাখ্যার একটা স্থানে আছে।”

নিজেদের ভালবাসা- বিশ্বাসে বাইবেল-সংস্পর্শ ও তা পাঠ: ঈশ্বর নিজে উদ্যোগ নিয়ে ভক্তদের নিকট প্রথম কথা বলেন, তাদের আত্মা পরিপুষ্ট করেন। অন্যদিকে ভক্তরা ভক্তিতে তা শ্রবণ ক’রে তাঁকে শ্রদ্ধা দেখান। প্রত্যেক ভক্তের ব্যক্তিজীবনে পবিত্র বাইবেল সম্মান করা, ধরা ও পড়া এক বড় বিষয়। অনেকবার ধর্মের সম্মানিত এ বইটি সবার অগোচরে, অযত্নে, অবহেলায় গুমড়ে কাঁদে। অনেকবার খুঁজেও সহজে পাওয়া যায় না। পরিবারে তাই সসম্মানে পারিবাবিক বেদীতে এ পূত গ্রন্থ স্থাপন, নানা আরতি প্রদান, বাতি প্রজ্জ্বলন, উপযুক্ত ভক্তিতে একা ও পারিবারিকভাবে তা বার বার পাঠ এক খ্রীষ্টান দায়িত্ব। অনুরূপভাবে দল ও সমাজে এটি ভক্তি যত্নে রাখা ও উপযুক্ত সময়ে দলীয়ভাবে বার বা তা পাঠ এক বিশেষ কাজ। মাণ্ডলীকভাবেও আমাদের ধর্মগ্রন্থ সম্মান করা, যথাযথ মর্যাদায় উপাসনায় তা ঘন ঘন ব্যবহার করা আমাদের এক খ্রীষ্টিয় কর্তব্য ও পরিচয়। কারণ অনেকেই প্রস্তুতিসহ ধীরস্থিরভারে পুণ্য বাণীগ্রন্থ ধরেন না বা খুলেন না, যেমন তেমনভাবে ধরেন, কয়েকবার অসস্মানে, অবিশ্বাসে, খোলেন ঘষে ঘষে শব্দ ক’রে বা গুরুত্বহীনভাবে। কয়েকবার রাখার সময়েও অনেকে বিকট শব্দ ক’রে পবিত্র বই রাখেন। অনেকবার বেশ হতাশা ও দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, বেশ কিছু মানুষ পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নির্দ্বিধায় পায়ের পাশে বা কাছে রাখেন যা সহজেই পায়ের স্পর্শ পেতে পারে। অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিও চেয়ারে বসে খুব সহজেই অদূরদর্শী একই আচরণ করেন বা করে থাকেন। তারা বেশ কিছুবার অনায়াশেই পবিত্র বইগুলি ভক্তিহীনভাবে নীচে পায়ের কাছে রাখেন আর উপাসনায় অংশ নেন। একদিন উপাসনার সময় লক্ষ্য করছিলাম এক যাজক চেয়ারে বসা, তার পায়ের নীচে মণ্ডলীর অফিস প্রার্থনার বই আর তার উপরে তার পা দোলা খাচ্ছে। হতে পারে তিনি অসচেতনভাবেই তা করছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তা সত্য, আমাদের দেশে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি ঘিরে এ জাতীয় দৃশ্য অনেকবারই দেখা যায়। একইরূপ ব্যথাতুর বিষয়, বেশ কিছুবার অনেকে কোন অনুভূতি ছাড়াই পবিত্র বইগুলি নীচে রেখে পা দিয়ে ডিঙ্গিয়ে বা লাফিয়ে চলে যান। ভাব যেন, সেগুলি পায়ে লাগলেও বা সেভাবে গেলেও কিছু যায় আসে না। সেসব স্থানে পবিত্র বইগুলি যেমন-তেমনভাবে রাখা ও স্থানান্তর করার দৃশ্যও কম নজরে আসে না। এরূপ বাস্তবতা আমাদের দেশীয় ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। এ দৃশ্যগুলি দেখে বার বার অন্তরে কঠিন আঘাত লাগে। স্বদেশের অন্য ধর্মে ভাইবোনেরা কত যত্নে ও ভক্তিতে অমূল্য ধর্মগ্রন্থগুলি রাখেন, ধরেন, ব্যবহার করেন, আর আমরা? হ্যাঁ, ভক্তরা পূর্বে ভালভাবে মন প্রস্তুত ক’রে নিজেরা যত্নের সঙ্গে বই ধরবে ও খুলবে, ভক্তি – ভালবাসায় পড়বে ও রাখবে, বিশ্বাস ও মনোযোগের সঙ্গে তা শুনবে। তাহলে সে বাণী অন্তরে প্রবেশ করবে, চলার দিশা দিবে।

বাণী পাঠে প্রভুর সান্নিধ্যে থাকি: এই সেই বাণী যার দ্বারা মুক্তিদাতা যীশু ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন, আর ভক্তেরা সৃষ্ট ও পূষ্ট হয়। প্রভুর বাণীর মাধ্যমে আমরা আমাদের মাঝখানে প্রভুর আগমন উদযাপন করি তাই পাঠের সময় পবিত্র বাইবেলকে শ্রদ্ধা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ফুল, ধুপ, বাতি, আরতি, শোভাযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রভুর বাণীর উৎসব করা যেতে পারে এবং এভাবে অনেকের ভক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই পাঠ এমন হওয়া প্রয়োজন যেন প্রভুর বাণী পাঠকালে সর্বত্র ও সর্বদা শ্রোতারা তাঁর কথাই শুনতে পারেন। পাঠক/পাঠিকা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেয়ে সঠিক প্রস্তুতিসহ বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও নম্রতা নিয়ে এ বাণী অন্যদের সামনে পড়বে। বই ও পাঠ ঠিক আছে কিনা পাঠক পাঠের আগে তা দেখে নেবেন। যিনি জনসমক্ষে প্রভুর বাণী পাঠ করবেন, তিনি শালীন ও রুচিশীল সাজে ভক্তিপূষ্ট পদে বাণী মঞ্চে যাবেন, দাঁড়াবেন, অতঃপর ধীর স্থীর ভাবে সসম্মানে পবিত্র বই খানি খুলে সামান্য বিরতি নিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্পষ্ট ও অর্থপূর্ণভাবে প্রভুর বাণী ঘোষণা করবেন। পাঠের সময় তার নড়াচড়া, বই বন্ধ করা, রাখা প্রভৃতি ভক্তিযুক্ত হওয়া উচিত। তার প্রেমপূর্ণ, সঠিক ও মধুর পাঠের মাধ্যমেই প্রভুর বাণী ভক্তদের কাছে জীবন্ত ছবির মত ফুটে উঠবে, সবার নিকট আনন্দ ও অর্থদায়ক ঘোষণা হবে। তা যেন তার স্বরে, মুখের চেহারার, ভাবে যথাযথরূপে ফুটে উঠে ও মানুষের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। পাঠের সময় পাঠক/পাঠিকা ভক্তদের দিকে তাকিয়ে তাদের সঙ্গে একটু যোগাযোগ রেখে পাঠ পড়বে কারণ সে মানুষের জন্যই প্রভুর বাণী ঘোষণা করছে। এভাবে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে শব্দের উঠা নামা দেখে বাণী ঘোষণা করলে তা সবার জন্যই তা অর্থপূর্ণ হতে পারে। পাঠক খুব মনোযোগের সঙ্গে গাম্ভীর্যের ভাব রেখে তা পাঠ করবে। তাছাড়া বলতে হয়, সব কিছু বিবেচনা করে সময়, বয়স, উপলক্ষ, স্থান, বোধশক্তি অনুসারে স্পষ্ট সহজ, শুদ্ধ ও হৃদয়গ্রাহীভাবে পাঠ করতে হবে, যেন তা যুগোপযোগী সার্থকতা লাভ করে। পাঠক শেষে কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে এ বাণীকে নিজ জীবন বাস্তবায়িত করবেন। তাদের মনে রাখতে হবে, যারা জনসমক্ষে পবিত্র বাইবেল পাঠ করে তাদের জীবন ও বিশ্বাসের দ্বারাই প্রভুর বাণীর সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। বাইবেল সবার সামনে পড়া হলে ভক্তদের তা শুনে নিজেদের পূর্ণ নিয়োজিত ক’রে সে অনুসারে জীবন-যাপন করতে হবে।

বাণী শ্রবণে ঐশ জ্ঞান: শব্দ সভ্যতার এ যুগে আমাদের আশেপাশে সর্বত্র বহু হৈ চৈ গোলমাল, মারামারি, রাগারাগি, হিংসা, গালাগালি ইত্যাদি। অনেক মানুষ আজ শব্দ শুনতে শুনতে ক্লান্ত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে শব্দগুলি শুধু শাব্দিক অবস্থিতি ছাড়া কোন তাৎপর্য ও বাস্তবতা প্রকাশ করে না। এমনকি সেসবের গভীরে কী অর্থ ও আহ্বান রয়েছে তা মানুষের জন্য স্পষ্ট ও জরুরী না। সভ্য সমাজে এমন অনেক শব্দ ও কথা রয়েছে যা শুধু বক্তাদেরই কথা কারো সেসব শোনাবার ও বাস্তবায়িত করবার প্রশ্নই নেই। “সব মানুষেরই কান আছে কিন্তু সবাই সুষ্ঠভাবে শুনতে পারে না। তার ফলেই পৃথিবীতে এত অশান্তি”, বলেছেন সিসরো। সত্যিই মানুষ দু’টি কান দিয়ে শোনার চেয়ে একটি মুখ দিয়ে বলে কত বেশী। দু’টি কান দিয়ে আমাদের আরো বেশী শুনতে হবে। শ্রবণ ক্রিয়ার জন্য থাকে দু’পক্ষ অর্থাৎ একজনকে বলতে হবে ও অন্যজনকে তা শুনতে হবে। এরূপ যুগেও খ্রীষ্টভক্তদের উচিত জীবনময় ঈশ্বরের স্বকীয় ও শক্তিশালী বাণী নিরবে হৃদ গোহায় শ্রবণ করবার পূর্বে নিজেদের উন্মুক্ততা প্রকাশ করবে: “বল প্রভু তোমার সেবক শুনছে।” আমাদের নীরবতায় প্রভুর সক্রিয় বাণী আরো জোরে কথা বলবে। যীশু জন্মের মাধ্যমেই এ বাণীর পরম প্রকাশ ঘটে। প্রেমময় ঈশ্বর তাঁর বাণীর মাধ্যমে সন্তানদের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেন, প্রেমপূর্ণ কথা বলেন। প্রভুর বাণী শান্তি, আলো, মানবমুক্তি প্রভৃতির সুসংবাদ বহন করে তা হয় মুক্তিদায়ী উপস্থিতি।

বাণী শ্রবণের কাজ: আজও প্রভুর বাণী মণ্ডলীর কেন্দ্রে থেকে ভক্তদের বিশ্বাস শক্তি, সমর্থন সাহস, পথ নির্দেশ ও সমস্ত অনুভূতি দান করেন। উপাসনায় ভক্তরা এক প্রভুর বাণী শুনে এক সমাজরূপে নিজেদের বিশ্বাস উদযাপন করেন এবং তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন-যাপন করতে চেষ্টা করেন। ঈশ্বর সকল উপাসনায় প্রবেশ করে বাণী পাঠের মাধ্যমে নিজেকে উজার করে প্রকাশ করেন আর মানুষকে তার দেখানো পথে চলতে নির্দেশ দেন। কিন্তু আজকাল ঈশ্বরের উদ্যোগের উত্তরে আমরা আর তার কথা শুনতে চাই না, তার বাধ্য হয়ে চলতে চাই না। বাণী যখন পাঠ করা হয় তখন পঠিত কথাগুলি শুনতে শুনতে তা পরিষ্কার থেকে পরিষ্কারতর হতে থাকে এবং সেসব মানুষের কাছে অনেক কিছু দাবী করে, ঈশ্বর প্রথম উদ্যোগ নিয়ে তার উপদেশ পূর্ণ কথার মাধ্যমে অমৃতময় বাণী মানুষের জন্য প্রকাশ করেন আর তার ভক্তসন্তানগণ পবিত্র বাইবেল পাঠের সময়ে সক্রিয় নীরবতায় আন্তরিকতাসহ তা শ্রবণ করেন। মানুষ যত ভক্তি ও উন্মুুুক্ততাসহ তা শ্রবণ করবেন তা তত অর্থপূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হবে এবং মানুষের নিকট হতে সেরূপ কতর্ব্য দাবী করবে। খ্রীষ্টানের জীবন হল নীরব শ্রবণ ও সে অনুসারে কাজ করার জীবন। তাই শ্রবণ ক্রিয়া খ্রীষ্টানের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়।

শ্রবণের পথ: আমরা আজ ব্যস্ততার মহাশীর্ষে, উত্তেজেনায় হাবুডুবু খাই, কথায় ভেসে যাই। ফলে, ঈশ্বর অবিরত, বিশেষ উপাসনায় বাণী পাঠের মাধ্যমে কথা বললেও, আমরা শারীরিকভাবে সেখানে উপস্থিত থাকলেও কান, হৃদয়, চিন্তা, চেতনা, মন থাকে ক্লান্ত, ব্যস্ত, ফলে ঈশ্বরের বাণী আর গুরুত্ব সহকারে শোনা হয়ে উঠে না। উপাসনায় চোখ, কান, হৃদয়, মন, অনুভূতি ও ভালবাসা দিয়ে প্রভুর বাণী না শুনলে কি করে নিজেকে ঈশ্বরে নিবেদন করে উত্তর দেব “আমেন” (তাই হোক)? মাতা মারীয়া পূর্ণ অন্তরে ঈশ্বরের কথা শুনে সর্বপ্রথম আমেন উত্তর দিয়েছিলেন। পবিত্র বাইবেলে বারে বারে আছে: কথা শুন ও সে অনুসারে কাজ কর। সুতরাং মানুষকে অহংবোধ ও আমিত্বের সকল বন্ধন ছিন্ন করে বাইরের সকল কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বাস, ভালবাসা, উদারতা, পবিত্রতা, ভক্তি, নীরবতা, নিয়ে প্রভুর বাণী শুনতে হবে। তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মত গভীর যোগ রেখে তাঁর কথাগুলিকে হৃদয়ে দাগ কাটতে দিতে হবে, জীবনকে প্রভাবিত করতে দিতে হবে।

শ্রবণের ফল: মণ্ডলী সত্য বাণীর “রক্ষক, ঘোষক ও সেবক।” প্রভুর বাণীকে কেন্দ্র ক’রে উপাসনা পরিচালিত হয়। সকল উপাসনালয়ে সুন্দর, অর্থপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সহজ ক’রে প্রভুর বাণী পাঠ করা উচিৎ। উপস্থিত ভক্ত মণ্ডলী সমস্ত বন্ধন মুক্ত হয়ে খোলা মনে নীরবে প্রভুর অমৃত বাণী শুনবেন। কারণ “কানে শোনা পরম শব্দই বিশ্বাসের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।” অর্থাৎ শ্রবণ থেকে বাণীকে বাধ্যতা সহকারে গ্রহণ করতে হবে। বাণী পাঠের ক্ষেত্রে মানুষের প্রথম করণীয় হল তা শ্রবণ করা অর্থাৎ সে বাণীর প্রতি উন্মুক্ত থাকা ও সে অনুসারে জীবন-যাপন করা। বাণী নীরবে শুনে ধ্যান করে, গান ও সাম সঙ্গীতের মাধ্যমে তা গ্রহণের ভাব ও বিশ্বাস প্রকাশ করা হয়ে থাকে। অতঃপর আসে প্রার্থনার মাধ্যমে ভক্তদের কথা বলার পালা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে- শিশুরা যেমন কথা শুনে কথা বলতে শিখে তেমনি ঈশ্বরের বাণী শুনে তার সঙ্গে কথা বলতে শেখা হয়। শিষ্যদের সময়ও বাণীর সহায়তায় তারা একমন, একপ্রাণ হয়ে থাকতেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেন ও পৃথিবীতে মুক্তি ও প্রচার কাজে অংশ নিতেন। প্রভুর বাণী চিরকালেই মানব মুক্তির ও পৃথিবীর ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। যারা তার বাণী শুনে সে অনুসারে কাজ করেছে তারা তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সেই বাণীর দ্বারা আবৃত হয়ে মুক্তি পথে এগিয়ে চলেছে।

শেষের কথা: পবিত্রাত্মায় পূর্ণ হয়ে মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে অর্থাৎ প্রার্থনা করতে শিখতে হবে। সাধু আম্ব্রোজ বলেন: “যখন আমরা ঐশবাণী পাঠ করি তখন ঈশ্বরের কথা শুনি এবং যখন আমরা প্রার্থনা করি তখন তার সঙ্গে কথা বলি।” তাই বর্তমান শব্দ সভ্যতার এ যুগে প্রত্যেক খ্রীষ্টভক্তকেই বাণী পাঠকালে সব বন্ধন মুক্ত হয়ে বিশ্বাস, আশা, গুরুত্ব, নম্রতা, উদারতা ও ভালবাসা নিয়ে প্রভুর বাণী শুনতে হবে। যেন এভাবেই যীশুকে আরো গভীরভাবে জানতে, বুঝতে, চিনতে ও ভালবাসতে পারা যায় এবং তার ইচ্ছাকে; তার লাখ কথার এক কথা ভালবাসাকে বাস্তব জীবনে ফুটিয়ে তোলা যায়। “তোমার সেবক তোমার বাণীতে দীক্ষিত, হে প্রভু, তোমার আদেশ পালনে আমার পরম লাভ” গীতাবলী ১১৯১। যীশুর বাণী ঠিকভাবে শুনলে জীবনে পরির্বতন আসবে, মন নতুনভাবে গড়ে উঠবে, প্রার্থনা করা সম্ভব হবে, জীবনে শক্তি, সাহস ও জ্ঞান নিয়ে পথ চলা যাবে। সাধু পলের কথামত: বাণী শ্রবণ মানে হল তা মান্য করা (রোমিও ১:৫)। সকল ব্যক্তিকে কান দিয়ে, মন দিয়ে, অনুভূতি, বিবেক, ভালবাসা ও হৃদয় দিয়ে শুনতে হবে। নীরবতায়, প্রার্থনার কাজে ও শব্দে আমাদের প্রভুর বাণী শুনতে হবে। ধ্যান আমাদের ঈশ্বরের জ্ঞান দিবে। ঈশ্বরের সৃষ্ট পৃথিবী তার কথা বলে। তাই পবিত্র বাইবেল শোনার সাথে সাথে আজকের পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনায়, কথায়, পরিস্থিতিতে, জীবনে, ইতিহাসে, তাঁর কাজ, বাণী ও উপস্থিতি আবিষ্কার করি। প্রতিক্ষণে ধীর স্থিরভাবে শু’নে, উপলব্ধি ক’রে পূর্ণ মনেপ্রাণে তাঁকে উত্তর দিই। এভাবে সর্বত্র সবার চেষ্টার ফলেই প্রভুর বাণী ফলশালী হয়ে উঠবে। পিতার ইচ্ছায় এবং সবার কাজে সকলে এক পিতার সন্তানরূপে সুখ ও শান্তির রাজ্যে সসম্মানে বসবাস করতে পারবেন। আর শত কথা ও শব্দ-ব্যস্ততার মাঝেও প্রভুর বাণী যত ভাল করে শুনতে থাকবো তা তত অর্থপূর্ণ, ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক হবে। আমাদের এ শোনা ও উপলব্ধি করা কোনদিন যথেষ্ট হবে না, শেষ হবে না। শব্দ সংস্কৃতির এ যুগে আমরা তাই সর্বাবস্থায় প্রভুর বাণী পাঠ, শ্রবণ ও যাপনে পূর্ণ নিরত থাকি ও অন্যকে শিখাই। প্রভুর বাণী আমাদের পথের দিশা ও সাথী হোক।

Please follow and like us: