“মাতৃগর্ভে তোমাকে গড়ার আগেই আমি তোমাকে জানতাম; তুমি জন্ম নেবার আগেই আমি তোমাকে আমার উদ্দেশে পবিত্রীকৃত করে রেখেছি। আমি তোমাকে দেশগুলোর কাছে নবীরূপে নিযুক্ত করেছি” (যেরেমিয়া ১:৫)। বাইবেলে বর্ণিত প্রবক্তা যেরেমিয়ার গ্রন্থের এই উক্তিটি যেন নব অভিষিক্ত ফাদার জেমস্ তপ্নের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মাতৃ গর্ভে আমার বয়স যখন সাত মাস তখনই মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে মার প্রসবের কোন গতি না হওয়ায় বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মাকে দিনাজপুর সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। তখন বেনীদুয়ার মিশনের পাল-পুরোহিত ছিলেন প্রয়াত ফাদার হারুন হেম্ব্রম। বাবা মাকে হাসপাতালের নেওয়ার জন্য ফাদারের কাছ থেকে চিঠি আনলেন। ফাদার চিঠি দিলেন কিন্তু তাড়াহুড়ো করে ডিঙ্গাডুবা হাসপাতালের চিঠির খামে তা দিয়ে দিলেন। পরে অবশ্য এই চিঠি দেখে সহজে দিনাজপুর সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে মা’কে গ্রহণ করতে চায়নি। পরে অবশ্য ফাদারের পুনরায় চিঠিতে মাকে হাসপাতালে গ্রহণ করে নেয়। সেখানে গিয়ে মাকে জরুরী অবস্থায় রাখা হয়। বাবাকে জানানো হয় যে কোন একজনকে বাঁচানো যেতে পারে। হয় মা বাঁচবে নয়তো বাচ্চা। যাই হোক নার্স, ডাক্তারদের চেষ্টা ও পরমেশ্বরের পরম পরিকল্পনা পূরণের আশির্বাদে আমি আজও বেঁচে আছি। আমি সাত মাসের সন্তান। আমি নাকি জন্মের সময় অনেকটাই ছোট ছিলাম। সপ্তাহ খানেক আমাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। না হয় বাঁচাতে পারতো না। ছোটবেলায় মায়ের দুধ না পাওয়াতে ভাতের মাড় খাওয়ায়েই বাঁচিয়ে রাখা হয় আমাকে।
গত ২৮ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বিকালে ডিকন সাগর জেমস্ তপ্ন’র মঙ্গল কামনা করে আশির্বাদের অনুষ্ঠান পবিত্র ঘন্টা করা হয়। এই আশির্বাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ও বনপাড়া ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার মাইকেল কোড়াইয়াসহ অন্যান্য ফাদার-সিস্টারগণ ও ধর্মপল্লীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত খ্রিস্টভক্তগণ।
২৯ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ডিকন সাগর তপ্ন যাজকপদে অভিষিক্ত হন। অভিষেক অনুষ্ঠানের পবিত্র খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরহিত্য করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও। পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লী থেকে আগত ৫০ জন ফাদার, ২ জন ডিকন, ২৭ জন সিস্টার ও প্রায় ১২০০ এর অধিক খ্রিস্টভক্ত।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও উপদেশ বাণীতে বলেন- যিশুর পবিত্র হৃদয় ধর্মপল্লী, বেনীদুয়ার মিশনের কৃতি সন্তান ডিকন সাগর তপ্ন’র পূণ্য যাজকীয় অভিষেক উপলক্ষে আমি তাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। সাধু পৌল এফেসীয়দের কাছে লিখেন -“আমি তোমাদের কাছে একান্ত আবেদন জানাচ্ছি; পরমেশ্বর যে আহ্বান তোমাদের জানিয়েছেন, তারই উপযুক্ত হোক তোমাদের আচরণ: সব সময় তোমরা নম্র, কোমল প্রাণ ও সহিষ্ণু হয়ে থেকো; গভীর ভালবাসায় পরমেশ্বরের প্রতি ধৈর্য্যশীল হও তোমরা। পবিত্র আত্মা তোমাদের মধ্যে যে ঐক্য এনে দিয়েছেন, তোমরা শান্তি বন্ধনেই সেই ঐক্যজোট রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা কর। তোমাদের সকলেরই সামনে যে আশা তুলে ধরেছেন, সেই আশা যেমন এক খ্রিস্টের, সেই দেহটি এক আর পবিত্র আত্মাও এক; প্রভু এক; খ্রিস্ট বিশ্বাসও এক; দীক্ষাস্নান এক, সকলের ঈশ্বর ও পিতা সবার উর্ধ্বে আছেন যিনি, যিনি সবার মধ্যে সক্রিয়. সবার মধ্যেই বিদ্যমান, তিনিও এক” (এফেসীয় ৪:১-৬)। বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীর ভক্ত ভাজনগণকে অনুরোধ করি, তারা যেন আমাদের এই অভিষিক্ত যাজকের জন্য প্রার্থনা করেন, সে যেন একজন আদর্শ যাজক হিসেবে জীবনের শেষ পর্যন্ত বিশস্থ থাকতে পারেন। এই অভিষেক উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হচ্ছে বলে আমি সত্যিই খুশি ও আনন্দিত।
তিনি আরো বলেন, দীক্ষাস্নানের গুণে আমরা সবাই যাজক। যাজকত্বকে আমরা চর্চা করতে পারি সাক্রামেন্তীয় যাজকদের সঙ্গে যুক্ত থেকে। যাজকত্ব হলো ঐশ আহ্বান। ঈশ্বরই একজন যাজককে তার কাজের জন্য মনোনীত করেন, বেঁছে নেন এবং উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। যাজকদের বিশেষত্ব হচ্ছে পাপকে জয় করে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে এ জগতে বাস্তবায়ন করা। যাজকদের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে নিজে পবিত্র থেকে অন্যদেরকে পবিত্র করে তোলা।
নব অভিষিক্ত ফাদার সাগর জেমস্ তপ্ন তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন- মহাযাজক যিশুর হয়ে সরাসরি কাজ করার দায়িত্ব পাওয়াটা সত্যিই আমার কাছে অনেক আনন্দের বিষয়। যাজক অভিষেকের মধ্যদিয়ে সত্যিকারভাবেই যিশুময় জীবন পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়াটা সত্যি আনন্দের। যে দিনটির অপেক্ষা করতে করতে ১৮টি বছর পার করলাম; তা আজ ঈশ্বরের অনুগ্রহে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে হৃদয়ের আনন্দ অনুভ‚তিতে এই বলতে ইচ্ছে করছে যে “আমার এ প্রাণ পরমেশ্বরের মহিমা গায়”। আমার পড়াশোনা, সেমিনারী জীবন, জীবনের লক্ষ্যের একটি ফল হিসেবে আজ এই দিনটি ঈশ্বর আমাকে উপহার দিয়েছেন বলে আমি নতমস্তকে ঈশ্বরের প্রশংসা করি, তাঁর প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি, আমার পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, বিশপ, পরিচালকগণ, ফাদার-সিস্টারগণ, আমার জন্য যারা প্রার্থনা করেছেন তাদের সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাজকীয় অভিষেক স্মরণিকার সম্পাদক দানিয়েল পুর্তি তার অনুভুতি ব্যক্ত করে বলেন- প্রকাশনা কাজকে সাফল্যমণ্ডিত করতে লেখা, সময়, শ্রম ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে যারা আমাদের পাশে ছিলেন তাদের সকলের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনাদের কাছ থেকে প্রকাশনার জন্য প্রাপ্ত আর্থিক সাহায্য ও অনুদান আমরা প্রকাশনা ব্যয় ও যাবতীয় অনুষ্ঠানের ঘাটতি পূরণ করতে পেরেছি। ঈশ্বরের কাজের জন্য আপনাদের সুচিন্তা ও প্রয়াস আশির্বাদিত হোক। সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও নব অভিষিক্ত যাজক সাগর জেমস্ তপ্ন’র প্রতি আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন, প্রার্থনা ও আশির্বাদ।
বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার মাইকেল কোড়াইয়া তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আজ আমরা বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীর সকল ফাদার, সিস্টার, প্রার্থনা পরিচালক ও খ্রিস্টভক্তগণ সকলেই আনন্দিত। যারা এই নব অভিষিক্ত ফাদার জেমস্ সাগর তপ্নকে এ পর্যন্ত আসতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকেই আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। পবিত্র যাজকাভিষেক উপলক্ষে সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত; আপনাদের সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। শুধু স্মরণিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে নয়, আপনাদের সহযোগিতায় অন্যান্য পরিসরেও বেনীদুয়ার ধর্মপল্লী সহযাত্রিক মণ্ডলী হবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরম করুণাময় পিতা ঈশ্বর, নব অভিষিক্ত যাজক জেমস সাগর তপ্নকে প্রচুর আশির্বাদ করুন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার