ফা: সুশীল লুইস পেরেরা
ভূমিকা: উপানায় বাণী পাঠ এক মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া। জীবন্ত প্রেমে পবিত্র বাণী পাঠ ও তা শ্রবণ হবে এক সৃষ্টিশীল ক্রিয়া। মণ্ডলীর দিন কাল উপলক্ষ অনুসারে ২টি, ৩টি বা আরো বেশী পাঠ ব্যবহার ক’রে পাঠের ব্যাখ্যা দেয়া হয়, সামসঙ্গীত আবৃত্তি বা গান করা হয়। পবিত্র বাইবেল পাঠগুলির মধ্য দিয়ে ঈশ্বর কথা বলে মানুষকে শক্তিশালী ও সমর্থ করেন। উপাসনা অনুষ্ঠানে খ্রীষ্টের উপস্থিতি প্রকাশ করতে দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলের পুণ্য উপাসনা বিষয়ক সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়: “তিনি উপস্থিত আছেন তাঁর বাণীর মধ্যে যেহেতু মণ্ডলীতে যখন শাস্ত্র পাঠ করা হয় তখন খ্রীষ্ট নিজেই কথা বলেন।” উপাসনায় পবিত্র শাস্ত্রের ব্যবহার উল্যেখ করতে দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলের পুণ্য উপাসনা বিষয়ক সংবিধানের ২৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়: “শাস্ত্র থেকেই অনুপ্রেরণা ও শক্তি লাভ করে প্রার্থনাদি, অনুপ্রার্থনাদি ও ভক্তিগীতিসমূহ এবং শাস্ত্র থেকেই উপাসনার ক্রিয়াদি ও চিহ্নসমূহ তাদের তাৎপর্য খুঁজে পায়।” আর সেভাবে শাস্ত্র যথাযথ ব্যবহারে উপাসনা বেশী জীবন্ত, ফলপ্রসূ ও যুগোপযোগী হয়ে উঠে। উপাসনায় তাই অর্থপূর্ণভাবে বাণী পাঠ করার পাঠক /পাঠিকাকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। উপাসনায় ফলপ্রসূভাবে বাণী পাঠ করার জন্য পাঠের আগে, পাঠের সময়, পাঠের পরে ও মাঝে মাঝে করণীয় হিসেবে কিছু ধারণা, মতামত, প্রস্তাব ধারাবাহিকভাবে লেখা হল। এখন একে একে সেসব দেখা যাক।
১। পাঠের পূর্বে করণীয়
ক) পাঠ নির্দেশিকায় দিন, উপলক্ষ, স্থান প্রভৃতি দেখে আগেই পাঠ ঠিকমত জানা ও বের করা
খ) নিজের মধ্যে ঐশবাণী ভাল পড়তে পারার প্রত্যয় ও আস্থা রাখা অর্থাৎ ভাল পড়ার জন্যে নিজের মনের দিক থেকে সচেতন ও প্রস্তুত থাকা।
গ) উপাসনার পূর্বেই নির্দিষ্ট পাঠ ২/৩ বার পড়ে রাখা।
ঘ) পাঠের মূলভাব, অন্তর্নিহিত ধারণা ও অর্থ আগেই বুঝে রাখা।
২। পাঠের ঠিক আগে
নিজে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে শালীন ও রুচিশীল পোশাক প’রে যথাসময়ে প্রস্তুত হওয়া। পোশাক তো অবশ্যই মার্জিত হতে হবে অন্যদিকে তা এমন হতে হবে যেন তা পাঠ চলাকালে যথাযথভাবে থাকে।
পাঠের চিহ্নরূপে পবিত্র বাণীপাঠ গ্রন্থের পৃষ্ঠা কোনভাবে ভাঙ্গা বা ভাজ করা ঠিক নয়। সেখানে কোন ক্লিপ বা অনুরূপ কোন কিছু যুক্ত করা উপযুক্ত নয়। সেখানে ভারী, দৃষ্টিকটূ কোন কিছু রাখাও ভক্তিযুক্ত নয়।এ উপাসনাগ্রন্থের পবিত্রতা ও মাহাত্ম সর্বদা, সযত্নে রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।
ক) ব্যক্তির সময়মত উপাসনায় উপস্থিতি।
খ) বই ও পাঠ ঠিক ও প্রস্তুত আছে কিনা তা আগেই দেখা।
গ) বিশেষ বিশেষ সময়ে বাণী সম্মানদান- (শোভাযাত্রা, ধূপ, ফুল বাতি, প্রণাম ইত্যাদি দ্বারা)।
ঘ) পাঠের দক্ষতার জন্য ভয় জয় করা, নিশ্চয়তার ভাব অর্জন।
ঙ) শ্বাস-প্রশ্বাস ও মুখের বিশেষ অনুশীলন নাড়ানোর মাধ্যমে (স্থানে বসে পাঠক/পাঠিকা)।
চ) আসা-যাওয়া, দাড়াঁনো, নড়াচড়া ভদ্র ও ভক্তিযুক্ত হওয়া।
ছ) ভক্তির সঙ্গে পাঠ বই ধরা, পাঠ বের করা ও রাখা (বন্ধ করা)।
৩। পাঠের সময়
পাঠক পাঠিকাকে সর্বদা সর্বতোভাবে সচেতন ও প্রস্তুত থাকতে হবে যেন পাঠের সময় কোন শব্দই অপ্রত্যাশিত ও ভুলভাবে উচ্চারণ করা না হয়। কারণ সেসব উপাসনার সময় ভক্তদের মনে অমনোযোগ ও বিঘ্নের সৃষ্টি করতে পারে।
ক) পাঠের আগে বলতে হবে ’অমুক গ্রন্থ বা পত্র’ থেকে প্রথম বা দ্বিতীয় পাঠ। পাঠক পাঠিকাকে পবিত্র বাইবেলের গ্রন্থগুলির সঠিক নাম জানা ও বলা প্রয়োজন। সেসময় বাণীগ্রন্থের ডানদিকের ছোট লেখা লাইন পড়তে হবে না।
খ) ভালবাসা ও ভক্তি নিয়ে পাঠ, গাম্ভীর্যের ভাব রাখা প্রয়োজন।
গ) পাঠক জোরে ও মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করবে কারণ পাঠ হলো অন্যের জন্য।
ঘ) স্বরের পরিবর্তন, উঠানামা, মধুর ও স্পষ্ট উচ্চারণ ও প্রয়োজনমত বিরতি রাখা।
ঙ) উদ্ধৃতি ও কথোপকথন দেখে পাঠ। বিষয়বস্তু দেখে সেভাবে পাঠ পড়া উচিৎ।
চ) পাঠকের পাঠের মাধ্যমে অন্যের নিকট প্রভুর বাণী যেন ছবির মত ফুটে উঠে।
ছ) বাণী যেন স্বর ও মুখে সবার জন্য আনন্দ ও অর্থদায়ক ঘোষণা হয়।
জ) বাণী পাঠ যেন মানুষের অনুভূতিতে নাড়া দেয়।
ঝ) পাঠের গতি নিয়ন্ত্রণ করা, অস্থিরতা ও তাড়াহুড়ার ভাব বর্জন করা।
ঞ) আঞ্চলিক ও ভুল উচ্চারণ বর্জন।
ট) দৃষ্টিকে মাঝে মাঝে ভক্তদের দিকে প্রসারিত ক’রে সামনে সকলের দিকে তাকানো। কারণ পবিত্র বাণী পাঠ হল তাদের জন্য।
ঠ) নিজে নিজে পড়ার ভাব, অভিনয়ের ভাব বা কবিতা পাঠের ভাব বর্জন।
ড) প্রধান শব্দগুলিকে দেখে নিয়ে সেসব গুরুত্ব দিয়ে পাঠের ভাব অনুসারে পড়তে হবে।
ঢ) পাঠের শেষে বলতে হবে: “প্রভুর বাণী”
ণ) রবিবার ও বড় পর্বসমূহে ২টি পাঠ থাকলে এবং সেগুলির জন্য ২জন পাঠক পাঠিকা বাণীমঞ্চে যাওয়া আসা করলে প্রথম পাঠের শেষে ও দ্বিতীয় পাঠের আগে ২জন পাঠক/পাঠিকা একত্রে সমানে প্রণাম ক’রে যাওয়া আসা করতে পারেন, তা সুন্দর দেখায়।
ত) রবিবার ও মহা পর্বসমূহে ২টি পাঠ থাকলে দ্বিতীয় পাঠের পর মণ্ডলীর কাল অনুসারে বাণী বন্দনা পড়তে হবে। অন্যান্য দিনে ও পর্বদিনসমূহে প্রথম পাঠের পর উপাসনার সময় অনুসারে বাণী বন্দনা পড়তে হবে।
৪। পাঠের পর
পবিত্র বাণী পাঠ ক’রে মানুষ পরম জ্ঞান লাভ করবে, বিচিত্র উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঐশ-ভাবে আবিস্কার করবে এবং ধীরে ধীরে নিজেকে বিকশিত করবে- এটাই তো বাণী পাঠের এক চরম লক্ষ্য।
ক) পাঠক বিশ্বাস নিয়ে নিজ জীবনে এই বাণীকে বাস্তবায়িত করে তার অর্থ পরিস্কার করবেন, পাঠের পূর্ণতা দিবেন ।
খ) নিজের জীবনের জন্য পাঠ অনেক শিক্ষা ও জ্ঞান দিবে। শিক্ষানুসারে ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে তা তাকে সাহায্য করবে।
৫। বিশেষ বিশেষ সময় ও উপলক্ষে মাঝে মাঝে করণীয়
ক) লোকদের বয়স, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি দে’খে বিবেচনা ক’রে সহজ ও সুন্দর পাঠ।
খ) সম্ভব হলে শিশুদের জন্য সোজা প্রচলিত শব্দ ব্যবহার, শিশুতোষ বাইবেল ব্যবহার।
গ) মাঝে মাঝে পাঠের ছোট ভূমিকা থাকতে পারে ।
ঘ) একের অধিক ব্যক্তিকে দিয়ে পাঠ করানো (পাস্কা পর্বের মত কিছুটা নাটকীয়তায়)।
ঙ) স্থান অবস্থা অনুসারে মাঝে মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার (পোষ্টার, ছবি, প্রতীক ইত্যাদি) করা, প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে যে, পাঠক পাঠিকাদের মাধ্যমে ঈশ্বর কথা বলেন।
উপসংহার : উপাসনায় বাণী পাঠ যত সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী ও প্রাসঙ্গিক হবে আশা করা যায় যে, তা তত অর্থপূর্ণ, উপযোগী ও কার্যকরী হবে। উপাসনায় নবায়ন, অগ্রগতি ও যুগোপযোগী ভাবধারা আনতে পবিত্র শাস্ত্রের প্রতি মধুর ও জীবন্ত প্রেম বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন (দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলের “পুণ্য উপাসনা” বিষয়ক সংবিধানের ২৪ নং অনুচ্ছেদ)। আর এটি প্রকাশ পেতে পারে তা পাঠ, শ্রবণ, ধ্যান ও সে অনুসারে জীবন যাপনের মাধ্যমে। আমার ধারণা ঐশ বাণী সেভাবে মানুষের জীবনে বেশী বেশী দেহ ধারণ করবে, মানুষের মধ্যে অগ্রগতি আনবে, মানুষকে জীবন দিবে। যেভাবে যীশুর কথার ফল হিসেবে লিখেন সাধু যোহন মঙ্গলসমাচার ৬ অধ্যায় ৬৩ পদে: “আমি যে-সব কথা তোমাদের বললাম, সে-সব কথা তো আত্মিক শক্তি, সে-সব কথাই তো জীবন।” উপাসনায় নবায়ন আনতে জীবন্ত প্রেমে ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাণীপাঠ অনেক অবদান রাখবে। তাই উপাসনায় প্রতিবার বাণী পাঠের সময় উপযুক্ত প্রস্তুতি, বিশ্বাস, ভালবাসা, দক্ষতা ও আন্তরিকতাসহ তা করা অতি জরুরী। সেজন্য উপাসনায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রচেষ্টা ও তৎপরতা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের সকল সভা সমাবেশ, প্রার্থনা, উপাসনা পবিত্র বাণী পাঠ দিয়ে শুরু হোক, পরিচালিত হোক। অন্যদিকে, যারা সেই পবিত্র বাণী পাঠ শুনবেন তারাও যেন অন্তরে মধুর ও গভীর ভালবাসা নিয়ে তা শ্রবণ করবেন ও সে অনুসারে চলবেন। তাহলে সেখানে এক সৃষ্টিশীল সমাজ হবে।