বিশেষ প্রতিবেদন 

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের নবাই বটতলা ধর্মপল্লীতে প্রতি বছর ১৬ জানুয়ারি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার র্তীথোৎসব ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। প্রথমদিকে রক্ষাকারিণী মারীয়ার এই পর্ব পালন শুধুমাত্র নবাই বটতলা গ্রামবাসী ও এলাকার জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পালিত হলেও এখন নবাই বটতলা গ্রামটি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার পুণ্য তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর ১৬ জানুয়ারি দূর-দুরান্ত থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী ও খ্রিস্টভক্ত এসে মিলিত হয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং মাতা মারীয়ার নিকট তাদের বিশ্বাসের মানত ও প্রার্থনা নিবেদন করেন। রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার এই তীর্থ এখন ধর্মপ্রদেশের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থোৎসব উদযাপিত হয়। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও ও খুলনা ধর্মপ্রদেশের বিশপ রমেন বৈরাগী দুই দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মারীয়া ভক্তবিশ্বাসী, ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টার তীর্থে অংশগ্রহণ করেন। ১৫ জানুয়ারি বিকালে বিশপদ্বয় ও ফাদারদের পাহাড়িয়া, উঁরাও নৃত্য ও সাঁন্তালী দাসাই নৃত্য সহযোগে বরণ করে নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় আলোক শোভাযাত্রা, মা মারীয়ার ওপর আলোচনা এবং পবিত্র সাক্রামেন্তীয় আরাধনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভক্তবিশ্বাসীরা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার নিকট শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

তীর্থের খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরহিত্য করেন খুলনা ধর্মপ্রদেশের বিশপ জেমস রমেন বৈরাগী। এছাড়াও বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী, ক্যামেরুনের ভাটিকান দূতাবাসের সেক্রেটারী ফাদার লিংকু লেনার্ড  গমেজ ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরোহিত উপস্থিত ছিলেন। বিশপ জেমস রমেন বৈরাগী খ্রিস্টযাগের উপদেশে বলেন, মা মারীয়া যিশুর মা। আর যিশু মারীয়াকে আমাদেরও মা করে পাঠিয়েছেন। নবাই বটতলাবাসী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচানাের জন্য মা মারীয়ার নিকট ভরসা করেছিলেন। আর মা মারীয়া ঠিকই তাঁর স্নেহের আঁচলে ভক্তবিশ্বাসীদের রক্ষা করেছেন। মঙ্গলসমাচারের আলােকে তিনি আরাে বলেন, মা মারীয়া যেমন কানা নগরের বিবাহ উৎসবে দ্রাক্ষারস ফুরিয়ে গেলে তা যিশুকে জানান। তেমনি আমাদের সকল অভাব মা মারীয়া ঈশ্বরের নিকট অর্পণ করেন। তবে আমরা শুধু অভাব ও বিপদেই মা মারীয়ার শরণাপন্ন হই। মা মারীয়ার নিকট প্রতি মূর্হুতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়।

সুন্দর ও প্রার্থনাপূর্ণ আয়োজনের জন্য রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও সবাইকে ধন্যবাদ জানান। নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার স্বপন পিউরিফিকেশন মা মারীয়ার নিকট গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আপনাদের প্রত্যেকের সহযোগিতা সিনোডাল মণ্ডলীর রূপকে প্রকাশ করে। আমরা এই বছর যিশুর জন্মের জুবিলীবর্ষে রয়েছি। জুবিলী বর্ষে আমরা মা মারীয়ার আশীর্বাদে যেন পথ চলি।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন নবাই বটতলা গ্রামের সাহসী ও ধর্মপ্রাণ লক্ষণ মাস্টার ও লুইস মাস্টারের অভয় বাণী ও ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রামবাসীকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। গ্রামসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক রবিবার গির্জায় গির্জা পরিচালক লক্ষণ মাস্টার ঘোষণা করেন, “আমরা প্রতিদিন রোজারীমালা প্রার্থনা করে মা মারীয়াকে বলবো-“মা তুমি যদি তোমার সন্তানদের এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করো, তাহলে প্রত্যেক বছর আমরা তোমার নামে পর্ব পালন করবো।” তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে আরও ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা কেউ গ্রাম ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাবো না। মরতে যদি হয় গ্রামের লোক সকলে এক সাথে মরবো। কোনদিন যদি রাজাকার, আলবদর অথবা পাকবাহিনী গ্রামে আসে তবে ঘন্টা বাজানো হবে এবং ঘন্টা শোনামাত্র সবাইকে গির্জা ঘরে এসে সমবেত হতে হবে।”

গ্রাম সভার সিদ্ধান্ত এবং গির্জায় ঘোষণার ২/৩ দিন পর সকালের সূর্য সবেমাত্র পূর্বাকাশে দেখা দিয়েছে এমন সময় গ্রামবাসীরা দেখতে পেল গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে প্রায় ১০০ জনের মত পাকসেনা ও আলবদর রাজাকারেরা নবাই বটতলা গ্রামের দিকে আসছে। রাজাকারদের আসতে দেখে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গির্জার ঘন্টা বাজানো হলো। ঘন্টা শুনে গ্রামের লোকজন সবাই দ্রুত গির্জাঘরে এসে সমবেত হলো। তারা গির্জায় মা মারীয়ার নিকট রোজারীমালা প্রার্থনা করতে লাগলো। পাক হানাদারেরা এসে দেখে গ্রামের অধিকাংশ লোক গির্জা ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে বসে প্রার্থনা করছে। চারটি জানালায় দু’জন করে এবং দুই দরজায় দু’জন করে খান সেনা রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে; যেন কেউ গির্জা ঘর থেকে বের হতে এবং পালাতে না পারে।

এরপর গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে প্রায় ছয়জন সৈন্য। সেনারা গির্জায় প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান করতে থাকে। গির্জা ঘরে অবস্থানরত কয়েকজনকে তারা  প্রার্থনা  করতে বলে। প্রাণভয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল বেশকিছু হিন্দু ও মুসলমান নারী পুরুষ। মূলত: দৈব্যক্রমে তাদেরকেই খান সেনারা নানা প্রশ্ন করে। তারা প্রার্থনা করতে আসলেই জানত না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লক্ষণ মাস্টার খানদের প্রশ্নের উত্তর দেন যে, “আসলে তারা এত বেশি ভয় পেয়েছে যে, তারা কথা বলতেই পারছে না।” খান সেনারা গির্জা ঘরের ভিতরে আর কোন রকম বাড়াবাড়ি না করে ১০/১২ জন সাঁওতাল যুবককে ধরে নিয়ে গুলি করার জন্য লাইনে দাঁড় করায়। তবে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেনের নিদের্শে সৈন্যরা আর গুলি করেনি। সৈন্যরা গ্রাম ছেড়ে ফিরে যাবার সময় কয়েকটি বাড়ির ছাউনীতে আগুন দিলেও তা পুড়েনি।

সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লী থেকে আগত মারীয়া ভক্ত আন্তন কিস্কু বলেন, প্রতি বছর আমি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার এই তীর্থে অংশগ্রহণ করি। এই বছরের তীর্থ আমার জন্য একটু ব্যতিক্রম। রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার নিকট বিশেষ কারণে আমার মানত ছিলো। তাই মাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। এছাড়াও ভক্তবিশ্বাসীদের আগমন ও তীর্থের কলেবর প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী বছর আরো বৃদ্ধি পাবে এই প্রত্যাশা করি।

Please follow and like us: