সুমন কোড়াইয়া

সমাজে কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব থাকেন যাদের দেখলেই সকলে সম্মান করে থাকে । তাদের নিকট হতে আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। আর তেমনি একজন ব্যক্তি নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানার কালিকাপুর গ্রামের গাব্রিয়েল কস্তা। তার এক অঙ্গের অনেক রূপ। তিনি কর্মজীবনে একাধারে ছিলেন শিক্ষক, সমবায়ী কর্মী ও নেতা এবং উন্নয়ন কর্মী।

সাতাত্তর বছর বয়সী নীরব কর্মী হিসেবে খ্যাত গাব্রিয়েল কস্তা সেবা দিয়েছেন চোখ বন্ধ করে, কী পাবো কী পাবো না সেটা কখনো চিন্তা করেননি। তবে তার অবদানের জন্য তিনি সহকর্মী ও প্রাক্তন ছাত্রদের যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন সমাজ থেকে স্বীকৃতি। খ্রিস্টমণ্ডলী ও পোপের জন্য সেবাকাজের স্বীকৃতি হিসাবে পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক পোপীয় সন্মাননা “PRO ECCLESIA ET PONTIFICE” সন্মানে ভূষিত হন ২৩ অক্টোবর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। এই সম্মাননাটি দেশের হাতে গোণা কয়েকজনই মাত্র পেয়েছেন। যার মধ্যে উত্তরবঙ্গের তিনিই হয়ত প্রথম। এছাড়া শিক্ষকতা জীবনে সততা ও পরিশ্রম এবং সমবায় সমিতির মাধ্যমে সমাজকে উন্নয়নের আলোতে আলোকিত করার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রেডিও ভেরিতাস এশিয়া বাংলা কাউন্সিল সন্মাননা ২০০৭-এ ভূষিত হন তিনি।

কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন তার পিতা মৃত আগষ্টিন কস্তা ও মাতা মৃত মাগ্দালেনা রোজারিও। তার জন্ম  ১৫ জানুয়ারি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভাদুন  ধর্মপল্লীর হারবাইদের গোয়ালগাও গ্রামে। তার পিতামাতার সাথে তিনি ১৯৫০ বা ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বড়াইগ্রামের কালিকাপুরে অভিবাসিত হন। তিনি  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বীণা পিরিচের সাথে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। তার রয়েছে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। কর্মজীবনে বেশির ভাগ সময় তার কেটেছে পরিবার হতে দূরে; ফলে সে সময় স্ত্রী-সন্তানরা পাননি তার সান্নিধ্য। সেটার জন্য রয়েছে তার আফসোস।

শৈশব থেকেই তার ছিল পড়াশোর প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক। তাকে তার পিতা-মাতা কখনো বই পড়তে বসতে বলেননি বরং তিনি নিজেই পড়াশোন করতেন। তিনি পড়াশোনা করেন দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস্ হাইস্কুলে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। মাধ্যমিক পাশ করেন বান্দুরার গোবিন্দপুর হলিক্রস হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর পড়াশোনা করেছেন খুলনায় ব্রজলাল কলেজে ও পরে ঢাকা কলেজে। তিনি বিএড করেন রাজশাহীর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে। এছাড়া তিনি লণ্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ করেন। তিনি বলেন, ‘পড়ালেখা করেছি আমি আনন্দের সাথে। বাবা-মাকে আমাকে কখনো বলতে হয়নি, পড়তে বস। আমি নিজের উদ্যোগেই আমার পড়াশোনা করেছি।’

গাব্রিয়েল কস্তা ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে কর্মজীবন শুরু করেন বড়াইগ্রামের বনপাড়ার সেন্ট যোসেফস্ হাইস্কুলে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে ইংরেজী শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সেই স্কুলটিতে। তখন দিনাজপুর ও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ একই ধর্মপ্রদেশ ছিল। তিনি ১৯৮৬ -১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের শিক্ষা কমিশনে সেক্রেটারী ও স্কুল সুপারিটেণ্ডেন্ট হিসেবে দক্ষতার সাথে ৯ বছর সেবা দিয়েছেন। তার কর্মদক্ষতা, সততা দেখে তৎকালীন রাজশাহীর বিশপ পৌলিনুস কস্তা তাকে কাথলিক বিশপদের সামাজিক সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এই গুরু দায়িত্বে তিনি ছিলেন নয় বছর।

গাব্রিয়েল কস্তা মিষ্টি হেসে বলেন, ‘আমি খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছি। কিন্তু কখনো কোথাও চাকুরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। আমাকে সব জায়গাতে ডেকে নিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি নিজের সবটুকু উজার করে দিতে।’ কারিতাসে তার কর্মজীবন শেষ হওয়ার পর তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বড়াইগ্রামের বোর্ণী ধর্মপল্লীর সেন্ট লুইস হাইস্কুলে। তিনি সেই দায়িত্বও দক্ষতার সাথে পালন করেন তিন বছরের অধিক সময়। এরপর নিজ গ্রাম কালিকাপুরে চলে আসেন। সেখানেও তিনি বসে থাকতে পারেননি। সেন্ট পিটারস্ একাডেমীতে তাকে অনুরোধ করা হয় এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় বছরের মতো। এরপর  পরিবার, সন্তান ও নাতি-নাতনীদের পুরো সময় দিয়েছেন।

গাব্রিয়েল কস্তা বলেন, আমি যখনই যে দায়িত্ব পেয়েছি, চেষ্টা করেছি সঠিকভাবে করতে। ফলে কর্তৃপক্ষ সব সময় আমার কাজে সন্তুষ্ট ছিল। এভাবে অনায়াসে আমি কর্মজীবন শেষ করেছি ও উপভোগ করেছি। তিনি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে পোপের নিকট থেকে PRO ECCLESIA ET PONTIFICE সম্মাননা পেয়েছেন, এই সম্মাননা  পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমি তো আর সম্মাননা বা পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। সমাজের মানুষের জন্য কাজ করেছি। সেটার স্বীকৃতি হিসেবে আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাই আমি খুব খুশি হয়েছি।’

যুব সমাজ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দেখি বর্তমান যুবকদের মধ্যে অনেক প্রতিভা। তাদের প্রতিভা ধরে রাখতে হবে। নিজেকে শাণিত করতে হবে কর্মক্ষেত্রের জন্য, তাহলে তারা যেখানেই চাকুরি বা ব্যবসা করুক না কেন সেখানে ভালো করবে।’ তিনি মনে করেন, জেনারেল শিক্ষার পাশাপাশি বর্তমান কিশোর-যুবাদের কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদের এই লাইনে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা দক্ষ হয় এবং পড়াশোনা শেষে বেকার না থাকে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ বেকার থাকে না বলে তিনি মত দেন।

গাব্রিয়েল কস্তার সামাজিক জীবন বেশ বর্ণাঢ্য। তিনি বনপাড়া মিশন সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন নয় বছরের মতো। এছাড়া বনপাড়া ধর্মপল্লীতে ওয়াইসিএস এর এনিমেটর হিসেবে যুব গঠনে অবদান রেখেছেন। তিনি তার কর্মজীবনে বড় একটা অংশে অবদান রেখেছেন সমবায় অঙ্গণে। দীর্ঘ সময় বড়াইগ্রামের বনপাড়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ এর সেক্রেটারির (১৯৭৪-১৯৯১) দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সারা বাংলাদেশের সমবায় সমিতিগুলোর কেন্দ্রীয় সমিতি ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ (কালব্) এর সেক্রেটারি হিসেবে দক্ষতা ও সততার সাধে সেবা দেন ১৯৮৩-১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

গাব্রিয়েল কস্তা বনপাড়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ ও বরেন্দ্র চলন ক্রেডিট ইউনিয়ন চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি হিসেবে সেবা দেন । সমবায় সমিতির ওপর ‘মুক্তির সোপান’ নামে তিনি একটি বই লিখেছেন যা দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোতে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। সমবায় আন্দোলনের এই একনিষ্ঠ কর্মী ও নেতা বলেন, ‘আমরা যখন সমবায় সমিতিতে কাজ করেছি, নেতৃত্ব দিয়েছি তখন জনকল্যাণের জন্য কাজ করেছি, নিজে কিছু পাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু বর্তমানে যারা সমবায়ের সাথে যুক্ত, তাদেরও এই ধরনের মনোভাব থাকা জরুরি বলে মনে করি।’

বর্তমান সময়ে সমবায় সমিতিগুলোতে নির্বাচন নিয়ে অর্থ খরচ ও বিভক্তি বিষয়ে একজন সমবায়ী নেতা হিসেবে তিনি বলেন, ‘ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ক্রেডিট ইউনিয়ন আন্দোলন এদেশে এনেছিলেন একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। আর সেটা হলো, মানুষের আর্থিক দীনতা থেকে মুক্তি। তবে আমরা লক্ষ্য করছি, ক্রেডিটের কারণে আর্থিক মুক্তির চেয়ে এর মাধ্যমে অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল বাড়ছে; যা মোটেও কাম্য নয়। যারা সমবায়ী নেতা, তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে বেশি করে ভাবা উচিত ও সমাধানের জন্য কাজ করার প্রয়োজন বলে মনে করি।

উল্লেখ্য,  তিনি দিনাজপুর ও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে বিভিন্ন সময়ে যুব কমিশনের অধীনে যুব কার্যক্রম ও ট্রেনিং পরিচালনা করেছেন। জাতীয় খ্রিস্টান শিক্ষা কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। দিনাজপুর ও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে বিভিন্ন সময়ে পোষ্ট এসএসসি ও পোষ্ট এইচএসসি কোর্স পরিচালনা করেন। রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ‘কারিতাস বাংলাদেশ’ এর সাধারণ পরিষদ, কার্যনির্বাহী পরিষদ এবং পে-কমিশনের সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি ভারত, শ্রীলংকা, ব্যাংকক, ইটালী, ফ্রান্স, লণ্ডন, নেপাল, ভূটান, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যাণ্ড, সিংঙ্গাপুর, মালোয়েশিয়া, জার্মানী, গ্রীসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনার ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ এবং ভ্রমণ করেন।

জীবন সায়াহ্নে এসে গাব্রিয়েল কস্তা, যাকে বনপড়ায় সবাই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে থাকেন, তিনি বসবাস করছেন কালিকাপুর গ্রামে। তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী,  আইনজীবি, সাংসদ ও উন্নয়নকর্মী হয়ে সেবা দিচ্ছেন। রাস্তাঘাটে তাকে দেখলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট থেকে তিনি সম্মান-শ্রদ্ধা পান। সভা সেমিনারে তার স্থান হয় সবার সামনের চেয়ারে। সবার প্রিয় গাব্রিয়েল স্যার বেঁচে থাকুন জনমানুষের হৃদয়ে।

পূর্ব প্রকাশ: সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, বড়দিন সংখ্যা- ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

 

 

 

Please follow and like us: