ভূমিকা: ক্যাথলিক চার্চ, চলতি বছর (২০২৫) খ্রিস্টজন্মের দুই হাজার পঁচিশ বছরের “খ্রিস্ট জুবিলি” বর্ষ পালন করছে। মণ্ডলীর পালকীয় জীবন মূল্যায়ন করার এটা একটা উপযুক্ত সময়। এখন থেকে ২৫ বছর আগে খ্রিস্ট জুবিলিবর্ষ পালিত হয়েছিলো। গত ২৫ বছরে সমাজ জীবনে বহুবিধ পরিবর্তন এলেও চার্চের পালকীয় কাজে কী পরিমাণ পরিবর্তন এসেছে? ভাবনার বিষয়। এ সুযোগে প্রথমেই সামান্য ফিরে দেখি পবিত্র বাইবেলের আলোকে সে সময়ের বাণী প্রচার কেমন ছিলো। জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরতো- যিশু তাদের বানালেন মানুষ ধরার জেলে। সমাজচ্যুত কুষ্ঠরোগিদের সুস্থ করে তাদের সমাজে ফিরিয়ে দিলেন। অন্ধ ভিক্ষুককে দৃষ্টিদান করে কর্মজীবী ক’রে তুললেন। বীজ বুনিয়ের মাধ্যমে সমাজে মানুষের বাস্তব চিত্র দিয়ে গেলেন। পাপীদের ভালোবেসে সুপথে ফিরিয়ে আনলেন।
এতো বছর পরে আজো জেলে মাছ ধরে- কিন্তু মানুষ ধরা জেলে ক’জন, কৃষক বীজ বুনে- কিন্তু সমাজে মানুষের চিত্র বদলায়নি, আত্মায় অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, শোনা যায় সমাজচ্যুত মানুষের কান্না, ঈশ্বর বঞ্চিত হয়ে কতো মানুষ- খোড়া, বোবা, ভিক্ষুক হয়ে আছে। খ্রিস্ট পাঁচখানা রুটি দিয়ে পাঁচ হাজার লোক খাইয়ে তাদের জীবন আশান্বিত ও টেকসই করেছিলেন- পালকবিহীনদের পালভূক্ত করেছিলেন। আজকের মণ্ডলীতে ধর্মীয় শক্তিগুলো কেনো সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না- এ নিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। এ বছর খ্রিস্ট জুবিলি বর্ষের শিরোনাম হলো “আশার তীর্থ”। তাই আগামীদিনের আশা নিয়ে এখনই বিশ্লেষণ করার মোক্ষম সময়। উদ্দেশ্য- আশার তীর্থ হবে মণ্ডলীতে নতুন আশা নিয়ে- মিলন, অংশগ্রহণ এবং প্রেরণের মধ্যদিয়ে একত্রে যাত্রার অঙ্গীকার।
রিলিজিয়াস পাওয়ার কী: রিলিজিয়াস পাওয়ার বা ধর্মীয় শক্তি বা এজেন্ট কোন্গুলোকে বলে? ক্যাথলিক চার্চের ধারণানুসারে প্রধান শক্তিগুলো হতে পারে- মঙ্গলবার্তা, সংস্কারসমূহ, সত্যবাদিতা, আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, পুণ্য- পবিত্রতা, আশির্বাদ, শুচিতা, ভক্তি, ধর্মানুষ্ঠান, বিশ্বাস- আশা- ভালোবাসা, এগুলোকে বলতে পারি রিলিজিয়াস পাওয়ার বা চার্চের ধর্মীয় শক্তি। খ্রিস্ট পৃথিবীতে এগুলোই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ক্যাথলিক চার্চের পালকীয় বিচরণ ক্ষেত্র হলো ধর্মীয় শক্তিগুলোকে ভক্তদের জীবনে পরিচর্যা করা। এ পরিচর্যার ধরণ দেশ-কাল ভেদে ভিন্ন হতে পারে- তবে উদ্দেশ্য, সমাজে ভক্তের সুন্দর জীবন এবং তার পরকাল নিশ্চিতকরণ।
সেক্যুলার পাওয়ার কী: ক্যাথলিক চার্চ যেগুলোকে সেক্যুলার পাওয়ার বা নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলো হতে পারে- পাপ-পুণ্যের ব্যাখ্যা, ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি- গণমাধ্যম- সমাজমাধ্যম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, একাডেমিক শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্লোবালাইজেশন, কমন মার্কেট, জাতীয়তাবাদের উত্থান, মৌলবাদ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, রাজনীতি, জাতিগত বৈষম্য, ধনী-গরিব, রিলিজিয়াস ট্রাইবালিজম ইত্যাদি। ধর্ম এগুলোকে নেগেটিভ শক্তি বা চার্চের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে দেখে না- যতোক্ষণ না ধর্মকে বাধাগ্রস্থ করে। তবে এগুলো দিন দিন চাচের্র প্রতিযোগী হয়ে উঠছে।
![](https://www.barendradut.com/wp-content/uploads/2025/01/1-3.jpg)
একদিকে সেক্যুলার পাওয়ারগুলো যতো দ্রুত সর্বজনীন হয়ে উঠছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোর পাশাপাশি রিলিজিয়াস ট্রাইবালিজম বা ক্ষুদ্র অর্থে সেক্টেরিয়ান মুভমেন্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যেমন হরেকৃষ্ণ হরেরাম মুভমেন্ট (ইসকন), সিন্টোইজম, তাওইজম, আহমদিয়া মুভমেন্ট, প্রটেষ্টানিজম, স্পিরিসুয়ালিম, অগ্নি পূজক, ভূমি পূজকের মতো শত শত মুভমেন্ট অনুসারি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এগুলোতে যোগ দিচ্ছে। কেনো বহুসংখ্যক মানুষ প্রতিষ্ঠিত, পৈত্রিক ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে এধরনের মুভমেন্টে যোগ দিচ্ছে।
১. প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অনুসারিদের একটা কমন কাঠামোর মধ্যদিয়ে ধর্ম অনুশীলন করতে হয়।
২. এই কাঠামোগুলোর মধ্যে অনেক বিধি-বিধান ও বিধি নিষেধ রয়েছে।
৩. অনেকে আজকাল মনে করেন, ধর্ম তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছে।
৪. নতুনত্বের অভাব- গির্জায় যাও, পাপস্বীকার করো, দান করো।
৫. ধর্ম ব্যক্তির আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করে না।
৬. মানুষের জীবনাচরণ যতো দ্রুত বদলাচ্ছে- ধর্মের বিধি-বিধান সে তুলনায় মডিফাই হচ্ছে না।
সেক্যুলার পাওয়ারগুলো পূর্ব-পশ্চিম, সব মহাদেশের মানুষকে কমবেশি দ্রুত আকর্ষণ করছে। এর বড় কারণ হলো- এগুলোর নতুনত্ব, সুপ্রচার এবং সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে উঠা, আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা। একজন কাটিখিস্ট মাস্টারের উপার্জন কতো ? আর একজন চিকিৎসকের উপার্জন কতো ? অনেক ব্যবধান।
অন্যদিকে রিলিজিয়াস পাওয়ারগুলোর শক্তি কি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে? বা ধর্ম হলো আফিম, সেই বাইণ্ডিং ফোর্স কী শিথিল হয়ে যাচ্ছে? চার্চ কি যুগের লক্ষণগুলো পেশাদারিভাবে দেখার চেষ্টা করছে না? এক রবিবার থেকে আর এক রবিবার- মাঝখানে সাত দিন একটা ধর্মপল্লীতে জনগণের আত্মার জন্য কি হয়? আমরা কি বলতে পারি- ধর্মপল্লীতে ভক্তজনগণের আত্মার পরিচর্যা এখন খণ্ডকালীন হয়ে গেছে? অর্থের দিকে নজর কি বেড়ে গেছে? জলজাহাজ আবিষ্কারের পর ইউরোপীয় মিশনারিগণ পুরো সুযোগ নিয়েছিলেন- এসব জলযানে চড়ে এশিয়া মহাদেশে ও মিশনদেশগুলোতে বাণী প্রচার করার জন্য। এখন রাস্তাঘাট সুন্দর, গাড়ি আছে, মোটরবাইক আছে, দ্রুত চলাফেরা করা যায়- কিন্তু গ্রামে সময় দেওয়ার ইচ্ছা কমে গেছে।
প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো দিন দিন আরো সেন্ট্রালাইজ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে-পল্লীতে আগের মতো এখন আর যাওয়া হয় না। খ্রিস্টভক্তগণ কিন্তু এখনোও খুশি হোন যদি দেখেন ফাদার, সিস্টার তাদের বাড়ি ঘুরতে এসেছেন। অন্যদিকে দেখুন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোস্যাল মিডিয়াতে সেক্যুলার পাওয়ারগুলোর প্রচার, সৃজনশীলতা, নতুনত্ব কতো শক্তিশালী। এ পাওয়ারগুলো আরোও পাওয়ারফুল করে তোলার জন্য গবেষণার অন্ত নাই। পশ্চিমে খ্রিস্টানদের পরিচালিত মিডিয়াগুলো বাণী প্রচারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না কেনো? যেসব টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক খ্রিস্টান বা খ্রিস্টান রাষ্ট্র, সেসব চ্যানেল থেকে দিনে মাত্র এক ঘন্টা বাইবেলভিত্তিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলে বিশ্বাবাসীর মতিগতি বদলে যেতো। আবার সে মিডিয়াগুলোই সোচ্চার হয়ে উঠে চার্চের এবিউস নিয়ে। ঘটা করে প্রচার করে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতা, চলচ্চিত্র উৎসব, খেলাধুলা ও বিনোদন। জিজাস খ্রাইস্ট সুপার ষ্টার, Inferno (2016), The Da Vinci Code (2006) Angels & Demons (2009) খ্রিস্টধর্ম নির্ভর এ সিনেমাগুলো মুসলিম দেশগুলোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো- কিন্তু খ্রিস্টান দেশগুলোতে ভালো ব্যবসা করেছে।
যাজকদের গুণাগুণ ও পেশাদারিত্ব চ্যালেঞ্জ: আজকের সেক্যুলার ও রিলিজিয়াস পাওয়ার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের কী ধরনের চার্চ, বিশপ, যাজক সমাজ দরকার, সেটা ভাবতে হবে। এ সেক্যুলার পাওয়ারগুলোই যাজকদের চ্যালেঞ্জ ও অনবরত ফেস করতে হয়। খ্রিস্টান সমাজের মধ্যেও এ সেক্যুলার পাওয়ারগুলো বেড়ে উঠছে। সেক্যুলার পেশাজীবীদের মধ্যে একটা প্রশ্ন- সমাজ জীবনে বহু পরিবর্তন আসলেও যাজক সমাজকে সেক্যুলার পাওয়ারগুলো মোকাবেলা করার দক্ষতা অর্জনে গঠন প্রক্রিয়ায় ও যাজকত্বলাভের পরবর্তীকালগুলোতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ততো পেশাদারি নয়- কেনো?
![](https://www.barendradut.com/wp-content/uploads/2025/01/2-2.jpg)
একজন যাজক বা পালকের কাছে বিশ্বদর্শন যে বার্তাগুলো উত্থাপন করে- তার প্রচারকাজের ভিত্তি সেগুলোই। চার্চকে যুগ লক্ষণগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে পালকীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকের অভিযোগ যে- যাজকগণ পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে ব্যস্ত থাকেন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে- বিষয়টি ভেবে দেখার বিষয়। চার্চ মনে করে তার সবই আছে, but when you think you have everything- you are losing. মণ্ডলী হলো অনুমোদিত প্রতিনিধি এবং মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যস্থতাকারী। তাই দেখা গেছে মানুষের মধ্যে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো মণ্ডলীকে ঘিরে। অসুখ-বিসুখ হলে ফাদারের পরামর্শ নিতো। খ্রিস্টযাগকে মনে করা হতো “Spiritual and social health centre” বা আধ্যাত্মিক ও সামাজিক ব্যাধি নিরাময় কেন্দ্র। চার্চ এসব বিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছে কীনা- সেটা মূল্যায়নের বিষয়।
A paradigm shift: বিশ্বটা এক স্থানে দাঁড়িয়ে নেই, অনবরত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মহাদেশ থেকে মহাকাল- অনবরত বদলে যাচ্ছে। সে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানব সমাজের প্রচলিত নানা মূল্যবোধ, ধারণা, ঐতিহ্য। পরকাল সম্পর্কে ধারণা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে- প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের আবিষ্কারে। বদলে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। বদলে যাচ্ছে পাপের সংজ্ঞা, বদলে যাচ্ছে পাপ সম্পর্কে মানুষের প্রাচীন ধারণা। এ যেনো ঈশ্বরের সঙ্গে নতুন করে জন্ম নিচ্ছে মানুষের সম্পর্ক। ঈশ্বর এখন যার যার এবং আলাদা আলাদা ঈশ্বর হয়ে গেছে। এর মধ্যেই চার্চ ও যাজকগণ হলেন “মানুষের জন্য ঈশ্বরের প্রতিনিধি”। “তোমরা, জীবন্ত যতো প্রস্তরেরই মতো, নিজেদের নির্মিত হতে দাও এক আধ্যাত্মিক মন্দির-রূপে। তাহলে তোমরা হয়ে উঠবে এক পবিত্র যাজক সমাজ। তোমরা তখন এমন আধ্যাত্মিক যজ্ঞ উৎসর্গ করতে পারবে, যা যিশুখ্রিস্টের নিবেদনে পরমেশ্বরের কাছে গ্রহণীয় হয়” (১পিতর ২:৫)।
![](https://www.barendradut.com/wp-content/uploads/2025/01/3.jpg)
উপসংহার: মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে আনতে হবে যে, “ঈশ্বর হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং সবকিছুর প্রথম কারণ” (God is the centre of the universe and first cause) খ্রিস্ট জুবিলি বর্ষে আমাদের অঙ্গীকার হোক- শুধু সভা-সমাবেশ নয়, কথা আলোচনা নয়, অর্থকড়ির অপচয় নয়। আসুন আমরা গভীর জলে জাল ফেলি- ভাগীদারদের আহ্বান করি, সহভাগী হওয়ার জন্য তারা এগিয়ে আসবেন এবং এভাবে রিলিজিয়াস পাওয়ারগুলো সেক্যুলার পাওয়াগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মীয় শক্তিগুলো হয়ে উঠবে নিপীড়িত প্রাণীর সুস্থ দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হারা প্রকৃতির হৃদয় এবং আমাদের আত্মাহীন মানবতার আত্মা।
Please follow and like us: