ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও
ভূমিকা
জনগণের কাছে একজন যাজক কতো জ্ঞানী, কতো বড় ডিগ্রি আছে- শেষ কথা নয়: খ্রিস্টভক্তগণ দেখতে চান একজন যাজক প্রার্থনাশীল, আধ্যাত্মিক, জনগণের বন্ধু, কথাবার্তায় অমায়িক এবং সাক্রামেন্তীয় দায়িত্ব পালনে তার সর্বক্ষণিক উপস্থিতি। জনগণ আজকে বুঝতে শিখেছেন, যাজকগণ দেহ-আত্মার মানুষ এবং মানুষ হিসেবে তার সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা। কিন্তু তাদের যে ঈশ্বর ডেকেছেন, তাঁর রাজ্যে জনগণের সেবা করার জন্যে- মানুষ সেটাও দেখতে চান। মানুষ দেখতে চান- খ্রিস্টযাগের প্রতি তার আকর্ষণ, আধ্যাত্মিক সাধনা, মঙ্গলবার্তার প্রতি তার উৎসাহ, উদারতা ও দয়াবান, জনগণের কথা শুনতে আগ্রহী কীনা।
এছাড়াও খ্রিস্টভক্তগণ একজন যাজকের মধ্যে যে সব গুণাবলী দেখতে চান, সেগুলো হলো- ঈশ্বরের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, মণ্ডলী এবং মণ্ডলীর শিক্ষাকে শ্রদ্ধা-সমর্থন করেন কীনা, জনগণের মধ্যে তার কাজ করার আগ্রহ ও যোগ্যতা কতটুকু, সামাজিক দায়িত্ব পালনে আগ্রহী কিনা। তাছাড়া, আরো দেখতে চান- বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষমতা, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান করা, শেখার আগ্রহ, যুগলক্ষণ সম্পর্কে উপলব্ধি, সুস্থ মানসিকতা, ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা এবং অসত্যের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসিকতা।
ভাটিকান সিটিতে অনুষ্ঠিত যাজকদের এক সম্মেলনে পোপ ফ্রান্সিস তাঁর ভাষণে নিজের জীবন অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করে বলেন, “সংকট একজন যাজকের চিরসঙ্গী- কিন্তু তা কাটাতে পারলে আনন্দ হয়ে উঠে চিরসঙ্গী।” তিনি বলেন, বাল্যকালে যাজকদের মধ্যে দেখা সে “উত্তম মেষপালকের মুখোচ্ছবি” তাকে এখনো অনুপ্রাণিত করে। আজকের দিনে যাজকদের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হচ্ছে- যেখানে অনেকেই উত্তর দিতে পিছিয়ে পড়ছেন। পোপ বলেন, চ্যালেঞ্জ যতোই আসুক- প্রস্তুত থাকতে হবে “মঙ্গলবার্তার অমৃত” (the flavor of the Gospel) ভাষায় মোকাবেলা করার জন্যে।
পোপ তাঁর বার্তায় বলেন, “ইতিহাসের এ মুহুর্তে এসে যিশু আমাদের আজও আহ্বান করে বলছেন ‘নৌকোটা এবার গভীর জলে নিয়ে যাও আর মাছ ধরবার জন্যে জাল ফেল’- অর্থাৎ খ্রিস্টই হলেন ইতিহাসের প্রভু যিনি আমাদের দিক নির্দেশনা এবং পরিচালনা দিচ্ছেন”। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর ভাষণের মূল পর্বে এসে, আজকের বাস্তবতায় যাজকদের পালকীয় বৈশিষ্টের- কয়েকটি মৌলিক সম্পর্ক, কাঠামো ((Four Forms of Closeness) উল্লেখ করেন।
ঈশ্বরের সঙ্গে যাজকদের ঘনিষ্ঠতা ((Closeness to God)
একজন যাজকের জীবনের মৌলিক শক্তি আসে ঈশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে। পোপ সাধু যোহনের মঙ্গলসমাচার থেকে উদৃতি দিয়ে বলেন, “আমি হলাম দ্রাক্ষালতা, আর তোমরা হলে শাখা-প্রশাখা। যে আমার মধ্যে থাকে আর আমি যার মধ্যে থাকি, সেই তো প্রচুর ফলে ফলশালী হয়ে ওঠে, কারণ আমাকে ছাড়া তোমরা কিছুই করতে পার না” (১৫:৫)। তারপর পোপ নিজের ভাষায় বলেন, “একজন যাজককে আমন্ত্রণ জানানো হয় তিনি যেনো ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের অন্তরঙ্গতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচর্যা করেন এবং এ কাজ করতে গিয়ে তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে অবশ্যই শক্তি লাভ করবেন।”
পোপ ফ্রান্সিস বলেন, যাজকগণ তখনই সংকটের সমুক্ষীণ হোন- যখন প্রার্থনার জীবন, আধ্যাত্মিকতা, বাণীশ্রবণ, খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ, সাক্রামেন্তীয় পালকীয় পরিবেশনায় শিথীলতা আসে। তখন ঈশ্বরের সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক সান্নিধ্য দুর্বল হয়ে যায়- ঈশ্বরের আশির্বাদ থেকে সে বঞ্চিত হতে থাকে। আজকের দিনে সমস্যার অন্ত নেই- কিন্তু সমাধানও আছে, যদি ঈশ্বর সঙ্গে থাকেন। যিশু বলেছেন, তোমাদের যা আদেশ দিয়েছি, তাদের পালন করতে শেখাও। আর জেনে রাখো, জগতের সেই অন্তিমকাল পযর্ন্ত আমি সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে আছি” (মথি ২৮:২০)।
বিশপের সঙ্গে যাজকদের ঘনিষ্ঠতা (Closeness to the Bishop)
এ ঘনিষ্ঠতা অর্থ হলো বিশপের কাছে এবং কাজে বাধ্য থাকা। যাজকীয় জীবনে এ বাধ্যতা হলো- শুধু নিয়ম শৃংঙ্খলা মেনে চলার গুণার্জন নয়- কিন্তু গভীরভাবে একাত্ম হওয়ার গুণার্জন। বাধ্যতা মানে, শ্রবণ করার মনোভাব অনুশীলন করা এবং সে মতে আচরণ করা। এ ব্যাপারে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “শ্রবণ, আমার জানতে ও শিখতে হয় এবং আমার মধ্যে ঈশ্বরের যে প্রজ্ঞা রয়েছে তা দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।” বিশপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে পোপ বলেন, “ঘনিষ্ঠতা, নিজের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে না রাখা, শুধু নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্টি লাভের ঊর্ধ্বে ওঠে নিজেকে শ্রবণ করার দিকে এবং সত্যের দিকে পরিচালিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।”
অন্যদিকে একজন বিশপ সব যাজকের জন্যে এবং সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান। একজন বিশপ, যাজকদের মধ্যে উপলব্ধির আগ্রহ তৈরি করতে পারেন, যদি সে, যাজকদের জীবনবৃত্তান্ত শুনেন- যে যাজকদের হাতে ঈশ্বর ভক্তসমাজকে স্থাপন করেছেন। সুতরাং বলা যায়, যাজকগণ যে চার্চ এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত- সেগুলোর সঙ্গে বিশপকে সঙ্গে নিয়ে যাজকদের জীবন হয়ে ওঠতে পারে নিশ্চিতভাবে একটি সত্যময় জীবন। পোপ জোর দিয়ে বলেন, যাজকদের উচিৎ বিশপের জন্য প্রার্থনা করা এবং নিজেকে বিনা দ্বিধায় বিশপের কাছে প্রকাশ করা।
বিশপের কাছে নিজেকে ভালো দেখানোর লক্ষ্যে কোনো যাজক যেন অন্য যাজকের বিরুদ্ধচারণ না করে- বিশপকে এ ভাষা বুঝতে হবে। একজন যাজকের মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্ঠের আলোকে প্রত্যেককে আলাদাভাবে বুঝতে হবে। বিশপকে কখনোই কোনো যাজকের পক্ষ্য নিতে হবে না। অন্যদিকে, বিশপকে হতে হবে বিনম্র স্বভাবের, থাকতে হবে শ্রবণ করার যোগ্যতা ও আত্মমূল্যায়নের ইচ্ছাশক্তি- যা হবে একে অপরের জন্য স্বাগত-সহায়ক। তাতেই স্থির হবে একত্রে যাত্রার সুগমন পথ।
যাজকদের সঙ্গে যাজকদের ঘনিষ্ঠতা (Closeness to other Priests)
যাজকদের সঙ্গে যাজকদের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বাইবেল থেকে উদৃতি দিয়ে বলেন, “দু’তিনজন লোক আমার নাম নিয়ে যখন যেখানে মিলিত হয়, আমি সেখানেই আছি, তাদের মাঝখানেই আছি” (মথি ১৮:২০)। অন্যথায় বাইবেল বলতে চায়, নতুবা ঈশ্বর সেখানে নেই। ভ্রাতৃপ্রেম বাইরে থেকে আমদানি করা যায় না। ভ্রাতৃপ্রেম হলো একত্রে পবিত্র হয়ে ওঠার জন্য যাত্রা- কিন্তু এককভাবে নয়। ভ্রাতৃত্ববোধের চিহ্ন হলো ভালোবাসা। ভ্রাতৃত্ববোধ হলো অন্য যাজকের জন্য কাতরতা, দায়িত্ববোধ ও কষ্টবহন করা।
ভ্রাতৃত্ববোধ হলো, অন্য যাজকের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে নিজের মধ্যে তাদের উপলব্ধি করা। অন্যদিকে, আচার-আচরণে ও সংলাপে একজন যাজক যখন অন্যদের থেকে দূরে সরে যায়- তখন তার মধ্যে শুরু হয় একাকীত্বের বেদনা- যে বেদনা তাকে বিনাশের পথে এগিয়ে দেয়। একজনের সঙ্গে অন্যের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথা না বলা, ছায়া না মাড়ানো- যাজকীয় জীবনের মধ্যে পড়ে না। এ স্বভাবের যাজক আজকাল অবশ্যই আছেন।
ভ্রাতৃপ্রেম কখনো নিজের জন্য খোঁজে না- কিন্তু একসঙ্গে সত্যে আনন্দ উদযাপন খোঁজে, একসঙ্গে সত্যকে নিরাপদে রাখে এবং একসঙ্গে সত্যকে প্রচার করে। চার্চের মধ্যে যাজকের সঙ্গে যাজকের সু-সম্পর্ক না থাকলে- একজন বিশপের পক্ষে আজকের আধুনিক যুগে চার্চ পরিচালনা করা হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ এবং মানসিক বিপর্যয়ও হতে পারে। তাই সবার আগে যাজকদের মধ্যে থাকতে হবে একত্রে সহযাত্রা- তারপর ভক্তগণের সঙ্গে সহযাত্রী হতে হবে।
জনগণের সঙ্গে যাজকদের ঘনিষ্ঠতা (Closeness to the People)
পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “যাজক হিসেবে ঈশ্বরভক্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু দায়িত্ব পালন নয়- কিন্তু একটি অনুগ্রহ।” তিনি বলেন, “অন্যকে ভালোবাসা হলো একটি আধ্যাত্মিক শক্তি, যে শক্তি আমাদের ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার নিশ্চিয়তা দেয়।” ভক্তগণের আত্মার প্রেরণকর্মী হিসেবে, যাজকদের জীবনে আস্বাদনীয় আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলেতে হয়, যেন ভক্তের জীবনের সঙ্গে ঐকতান রচিত হয় এবং আবিষ্কার করতে পারে সর্বময় আনন্দের উৎস।
ঈশ্বরের জনগণ সব সময় আশা করেন- যিশুর মতো একজন মেষপালক, যিনি অতি মাত্রায় জ্ঞানী, নানাবিধ প্রশাসনিক বিষয়ে পারদর্শী না হয়ে- হবেন সমব্যথী, সৎ-জ্ঞানী ও ঐশজ্ঞানান্বেষী এবং আহত মানুষের সামনে দাঁড়াবার মতো সাহস। একজন পালক যখন জনগণের হয়ে ওঠেন তখন তিনি সমাজে বন্ধন তৈরি করেন, একত্রে যাত্রার পরিবেশ মসৃন করতে পারেন- আর তাতে জনগণের মধ্যে উপলব্ধি গড়ে উঠতে পারে যে, “আমরা সহযাত্রী”। মনে রাখতে হবে, যাজকদের পালকীয় ক্ষেত্র হলো ভক্তজনগণ। ঈশ্বরকে লাভ করার আগে জনগণকে লাভ করতে হবে। সৃষ্টিকে ভালো না বেসে স্রষ্টাকে ভালোবাসা যায় না।
উপসংহার
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর আলোচনার সব শেষে এসে বলেন, ঘনিষ্ঠতার এই চতুর্মুখী রূপ- যাজকদের ওপর একটা বাড়তি ওজন চাপিয়ে দেওয়া নয়- কিন্তু এগুলো হলো যাজকদের জীবনের জন্য ঈশ্বরের অনুগ্রহ, যে অনুগ্রহ ক্যাথলিক চার্চে ঈশ্বরের আহ্বানকে সজীব, সৃজনশীল ও ফলদায়ী করে রাখে এবং ঘনিষ্ঠতার এ চতুর্মুখী রূপ বা কাঠামো গোটা ক্যাথলিক চার্চ, তার প্রতিষ্ঠান, সংঘবদ্ধ সমাজ-সম্প্রদায় ও ভক্তসমাজকে এক সরণীতে চলার অঙ্গীকার নিশ্চিত করে। প্রকৃতপক্ষে এ সবই হলো, যাজকদের কাছে চার্চের প্রত্যাশা।