লর্ড রোজারিও
“কলেজে যাওয়া আসার পথে প্রতিনিয়ত হাজারো নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় । অনেকবার কৌতূহলী হয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করি, আবার কখনো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এড়িয়ে যাই । দিনটি ছিল রবিবার। যেহেতু দশটার সময় ক্লাশ শুরু হয় তাই ধীরে ধীরেই সাইকেলের প্যাডেল ঘুরাচ্ছিলাম। শীতের ঠাণ্ডা বাতাস তার ওপর হালকা মিষ্টি রোদ । কি যে ভালো লাগছিল!
সে যাই হোক। হঠাৎ রাস্তায় দেখলাম খুবই হট্টগোল। আমি ভাবলাম আন্দোলন-টান্দোলন কিছু হবে হয়তো। আমার বন্ধু আমাকে ইশারা দিয়ে বলল, চল যাই। আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, এ আর নতুন কি? কোন নতুন দাবি নিয়ে হয়তো সব রাস্তায় বসে আছে। কিন্তু হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে। লক্ষ্য করলাম একটি ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। হাতে গোলাপ ফুল দেখে ভাবলাম হয়তো ইন্টারেস্টিং কোন বিষয় হবে, তাই এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া । বোকার মতো শুধুই ঝগড়া শুনে যাচ্ছিলাম কিন্তু মূল ঘটনা বুঝতে পারছিলাম না।
পরে জানতে পারলাম তারা দুজনে প্রেমিক-প্রেমিকা । তাদের এক বছরের সর্ম্পক। রোজ ডেতে প্রেমিক প্রেমিকাকে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে প্রপোজ করে। প্রেমিকার তো গোলাপগুলো পেয়ে আনন্দের সীমা নেই। প্রপোজ করার পর প্রেমিক প্রেমিকাকে অন্তরঙ্গ সর্ম্পকের কথা বললে প্রেমিকা একবাক্যে তা প্রত্যাখান করে। কিন্তু প্রেমিক তা শুনতে নারাজ। তাকে জোরাজুরি ও রিকোয়েস্ট করতে লাগল।
একপর্যায়ে মেয়েটা রাস্তার মধ্যেই সিনক্রিয়েট করায় ঘটনার মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। মজার বিষয় হলো, ছেলেটার নাকি ঘরে স্ত্রী-সন্তান আছে, যা তার প্রেমিকা জানতো না। অসম্পূর্ণ ঝগড়া প্রত্যক্ষ করেই আবার কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হই। মনে মনে চিন্তা করে দেখলাম, এরকম ভালোবাসা ও প্রতারণা আজকাল অহরহ দেখা যায়। আর তথাকথিত বর্তমান ভালবাসা দেখেই আগ্রহ জন্মায় ভালবাসার প্রকৃত অর্থ জানার।
ভালবাসার নেই কোন রূপ বা রঙ। হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয় ভালবাসা। প্রিয়জনকে ভালবাসতে বা তা প্রকাশ করতেও প্রয়োজন নেই কোনো নির্দিষ্ট ক্ষণ, দিন, মাস বা বছরের। তারপরও সব কথার পরেও গুরুত্বপূর্ণ বলে একটা কথা থেকে যায়। আর এই ভালবাসার গুরুত্ব বা তাৎপর্যকে তুলে ধরতেই জন্ম হয় বিশ্ব ভালবাসা দিবসের। ১৪ ফেব্রুয়ারি বহু আকাঙ্ক্ষিত, প্রতীক্ষিত একটি দিন।
এই দিনে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালবাসা সাড়ম্ভে প্রকাশ করি বিভিন্ন কিছুর মধ্য দিয়ে। ফুল, কার্ডসহ বিভিন্ন কিছু দিয়ে প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাই। তবে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে, এই দিনটি কেবলমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকা ও দম্পত্তিদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। যে কেউ এই দিনে তাদের প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে। ভালবাসা দিবস পালনের পূর্বে আমাদের জানা উচিত প্রেম-ভালবাসা কি। আমরা যখন প্রেম ভালবাসার সঠিক অর্থ বুঝতে পারি ঠিক তখনই ভালবাসা দিবস পালন সার্থক হয়ে উঠে।
ভালবাসা একটি মানবিক অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন ব্যক্তির প্রতি বিশেষ ভাবের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। আর এই ভালবাসায় ব্যক্তির সাথে মানবীয় সকল অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া এমনকি শরীরের বিষয়টাও এই ভালবাসা থেকে আলাদা করা যায় না। আবার ভালবাসার ধরণ আলাদাও হয়। যেমন, নিষ্কাম ভালবাসা, ধর্মীয় ভালবাসা, ভ্রাতৃপ্রতীম ভালবাসা, আত্মীয়ের প্রতি ভালবাসা, পোষ্য কোন পশু-পাখির প্রতি ভালবাসা।
এই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই ভালবাসা। আসলে ইংরেজি শব্দ LOVE এর বাংলা অর্থ ভালবাসা বা প্রেম। তাই ভালবাসার কথা বললে বেশিরভাগ সময় সর্বজনীন ভালবাসা বা ভালবাসার অবস্থানকেই বোঝায়। প্রেম বললেই বিষয়টি আলাদা ও জটিল হয়ে যায়। প্রেম হল নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি বিশেষ অনুভূতি ও দৃঢ় আকর্ষণ। ব্যক্তির প্রতি তীব্র মনোসংযোগ ও বাসনা । ভালবাসা সবার ও সবকিছুর সাথে হলেও প্রেম নাকি হয় শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা, স্রষ্টা ও প্রকৃতির সাথে। প্রেম হলো প্রাণের আরাম, মনের শান্তি, হৃদয়ের অতৃপ্ত বাসনা! প্রেম অবশ্যই দু’পক্ষের মধ্যে এক বিনিময়; যার মধ্য দিয়ে আত্মহুতি, আত্মসন্তুষ্টি, আত্মশুদ্ধি ও আত্মতুষ্টির সন্মিলন ঘটায়। প্রেম হল আসক্তি। ভালবাসা হলো বিলিয়ে দেওয়া সর্বজনীন স্বতন্ত্র অবস্থা।
জীবনে বেঁচে থাকার অপর নাম হলো ভালবাসা। ভালবাসাকে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। প্রকৃতপক্ষে ভালবাসা একটি অনুভবের বিষয়। আমরা সবাই ভালবাসা পেতে চাই কিন্তু অনেক সময় আমরা নিজেরা অন্যকে ভালবাসতে কার্পণ্য করে বসি। ভালবাসা একটি দক্ষতা যা আমাদেরকে শিখতে হয়। শুধু বিবাহিত জীবনে আবদ্ধ হয়ে একজন প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসা থেমে থাকে না। এই জগৎ সংসারে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ভালবাসার চর্চা করে যেতে হয়। যতই চর্চা করবে ভালবাসার দক্ষতা ততই বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বস্ত প্রেমিক-প্রেমিকা হওয়াটা কতই না প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে যাকে আমরা সত্যিকার অর্থে ভালবাসি তার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা আমরা গ্রহণ করে নিতে পারি। ভালবাসা যাই হোক না কেন ভালবাসায় কিছু বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো:
বিশ্বাস (Faith) : সর্ম্পকের মধ্যে বিশ্বাস থাকতেই হবে। বিশ্বাস ছাড়া যেমন কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারে না তেমনি স্থায়ীও হয় না। কালি ছাড়া কলম ও প্রাণ ছাড়া দেহের তো কোন মূল্য নেই। তেমনি বিশ্বাস ছাড়া প্রেম ভালবাসার মতো যেকোন সম্পর্কই অচল।
সম্মান (Respect): প্রেম ভালবাসা কেন, সন্মান-শ্রদ্ধা ছাড়া কোন সম্পর্কই টিকতে পারে না। বন্ধুত্বের মতো অতি আনন্দিত সম্পর্কও সন্মান ও শ্রদ্ধা ছাড়া টিকতে পারে না। ছোট-বড় সবাইকে সন্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হয়। ভালবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত একটি সর্ম্পকই হবে মজবুত ও চিরস্থায়ী। তাই প্রেম ভালবাসায় সম্মান-শ্রদ্ধা ও সমর্থনই পারে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে! পরস্পরের মতামত , ইচ্ছা, চাওয়া-পাওয়ার প্রতি সম্মান দেখানো খুবই দরকার।
যত্ন (Care): কথিত জনপ্রিয় একটি প্রবাদ আছে , ভালবাসা ও যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো সম্ভব। সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। যত্ন ছাড়া প্রেম-ভালবাসা ছন্নছাড়া জীবনের মত। যত্নে গড়ে উঠুক আমাদের প্রেম-ভালবাসা।
বোঝাবুঝি (Understanding): সর্ম্পকের ক্ষেত্রে বুঝাবুঝি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা নিজের বুঝ ভালোই বুঝি। নিজের বেলায় ষোলআনা, অন্যের বেলায় একআনাও না। সর্ম্পকের ক্ষেত্রে এই মনোভাব খুবই খারাপ। আর এই কারণেই সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় আর সম্পর্কে ভাঙ্গণ ধরে। আমরা অনেক সময় বুঝতে চাই না আমি যাকে ভালবাসি, সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, আলাদা সৃষ্টি। তার আলাদা দেহ-মন-আত্মা আছে। তাই তার মনোভাব ও চিন্তা-চেতনা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা মানতে একেবারেই নারাজ। তাই আমাদের পরস্পরকে সময় দেওয়া ও বুঝা উচিত।
বিশ্ব ভালবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি! ভালবাসা দিবস সবার কাছেই গুরত্বপূর্ণ দিন। এদিন শুধুই ভালবাসার দিন। ভালবাসাকে উদযাপন করার দিন। ভালবাসাকে উপলব্ধি করার দিন। ভালবাসা দিবসের ইতিহাস আমাদের শেখায় ভালবাসলে ত্যাগস্বীকার ও আত্মত্যাগ করতে হয় আর সেবা করতে হয়। তবে নিরাশার কথা হলো ভালবাসা দিবস পালিত হলেও গুরুত্ব উপলব্ধি করছে না কেউ।
আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে , শুভেচ্ছার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হলেও প্রকৃত ভালবাসা প্রকাশিত হচ্ছে না। তাই দেখি আজও ভালবাসা মানুষের কামনার আগুনে পুড়ে মরছে, ভালবেসে কেউ হারিয়ে যাচ্ছে, কেউবা হচ্ছে ধর্ষিত। কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা তো হারিয়ে যাওয়ার কথা না, ধর্ষিত হওয়ার কথা না। ভালবাসা তো ভালবাসারই কথা। তবে কেন ভালবাসার এই বিপরীত অবস্থা? তাই হয়তো আজও অনেকে ভালবাসতে ভয় পায়। আর আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠে ‘সখী ভালবাসা কারে কয়’।