ফাদার সাগর কোড়াইয়া

দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার পর মাতৃভাষায় উপাসনা রীতির চালু একটি  যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বোর্ণী, বনপাড়া ও মথুরাপুর ধর্মপল্লীর বয়স্ক খ্রিস্টভক্তরা কোনভাবেই এই সিদ্ধান্ত করতে পারেননি। যেহেতু তারা ল্যাটিন ভাষায় উপাসনা করে অভ্যস্ত তাই এটা হওয়াটা স্বাভাবিকই ছিলো। একটি ঘটনার কথা এখানে বলা যেতে পারে। অত্র এলাকায় খ্রিস্টযাগে হারমোনিয়াম-তবলা বাজিয়ে সঙ্গীত পরিচালনার ইতিহাস বেশি দিন আগের নয়। অত্র এলাকার মিশনগুলোর মধ্যে বোর্ণী ধর্মপল্লীতে সর্বপ্রথম ফাদার প্যাট্রিক গমেজ ও ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সেমিনারীয়ান থাকা অবস্থায় হারমোনিয়াম ও তবলা বাজিয়ে খ্রিস্টযাগে উপাসনা সঙ্গীত চালিয়েছিলেন। এ নিয়ে তৎকালীন মুরুব্বিদের নিকট তাদের দু’জনকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে বটে।

বাংলা ভাষায় খ্রিস্টিয় উপাসনা সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ শুরু হলে সে সময় অনেকেই এগিয়ে আসেন। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফাদার প্যাট্রিক গমেজ, বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ফাদার পল ডি. রোজারিও ও ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও’র নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সময়ে এই চারজন সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন সবেমাত্র সেমিনারীয়ান। হলফ করে বলা যায়, এই চারজন খ্রিস্টপ্রেমিক সঙ্গীতানুরাগী তাদের সঙ্গীতের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। বিশপ জের্ভাস, ফাদার পল এবং ফাদার সুনীল ডানিয়েল ক্লাসমেট হওয়ায় তাদের মধ্যে সঙ্গীত ও লেখালেখি নিয়ে গবেষণা এবং প্রতিযোগিতা তাদেরকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলো। সঙ্গীতে এই তিনজন ছিলেন যেন ত্রিরত্ন। আবার তিনজনই হচ্ছেন রোজারিও পরিবারের সন্তান। তবে ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও ছিলেন দু’জনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম।

ফাদার সুনীল ডানিয়েলের জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বোর্ণী ধর্মপল্লীর পারবোর্ণী গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক এক পরিবারে ফাদারের বেড়ে উঠা। বাবা ভিক্টর রোজারিও ও মা আগ্নেশ গমেজ। ভিক্টর রোজারিও রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সাতানীপাড়া গ্রামের গায়েন বাড়ি থেকে এসে অত্র এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। এই এলাকায় এসেও বাড়ির নাম গায়েন বাড়িই রয়ে যায়। ভিক্টর রোজারিও ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বৈরাগী বাড়ির জাকি মাষ্টারের সাথে তিনি বোর্ণী ধর্মপল্লীতে প্রথম বাজনার দল গড়ে তুলেছিলেন। মা আগ্নেশ গমেজ ছিলেন একজন ধার্মিকা মহিলা। সবুজ প্রকৃতি ও বড়াল নদের তীরে ফাদার বড় হয়েছেন। ফাদার প্যাট্রিক গমেজ সম্পর্কে ফাদার সুনীলের মামা হন। কৈশোরকালের কিছুটা সময় তাদের একসাথে কেঁটেছে। ফাদার প্যাট্রিক গমেজ ফাদার সুনীলের বিষয়ে বলেন, আমাদের মধ্যে প্রতিদিন সকালবেলা প্রতিযোগিতা ছিলো কে আগে খ্রিস্টযাগে সেবক হবো।

ম্যাট্রিক পাশ করার পর ফাদার সুনীল ডানিয়েল সেমিনারীতে প্রবেশ করেন। তিনি সেমিনারীতে প্রবেশের পূর্ব থেকেই সঙ্গীত ও অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিশপ জের্ভাস ও ফাদার পল ডি. রোজারিও সঙ্গীত রচনা করতেন। কিন্তু ফাদার সুনীল রচনা ও সুরারোপের মতো উভয় ক্ষেত্রেই ছিলেন দক্ষ। জানা যায়, বাংলা উপাসনা সঙ্গীতের আরেক যাদুকর ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ সীমা ফাদার সুনীল ডানিয়েলকে সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতেন। ধরতে গেলে সেই সময় থেকেই সঙ্গীত রচনায় হাতেখড়ি। ফাদারের সেমিনারীয়ান অবস্থায় রচিত গান এবং পরবর্তী গানগুলো প্রত্যেকটাই অনন্য এক আধ্যাত্মিক ভাব সৃষ্টি করে। গীতাবলীতে ফাদারের লেখা ও সুর করা অসংখ্য গান রয়েছে। তার গানের একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রত্যেকটা গানই রাগনির্ভর। আর এই কারণেই গানগুলো বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ফাদার সুনীল ডানিয়েলের রচিত ও সুরারোপিত বাঞ্ছা পূর্ণ কর প্রভু, তুমি ভরসা/তৃষ্ণা বারি তুমি হে সাগর (১৩৬৭) ভজন গানটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এছাড়াও ফাদার সুনীলের আরেকটি অনন্য সৃষ্টি তোমারই বিশ্বে যা কিছু দেখেছি নাথ/সেবিছে তোমারে বন্দিছে প্রণত (১৫১); এই গান দুটি শিল্পী সুবীর নন্দী এমন দরদ দিয়ে গেয়েছেন যা স্রষ্টার প্রতি ফাদারের আকুল ভক্তিরই প্রকাশ। এছাড়াও গীতাবলীতে স্থান পাওয়া ফাদারের লেখা ও সুরারোপিত গানগুলো হচ্ছে, আকাশ বাতাস মুখরিত আজি ভরেছে গানে গানে (১০২০), আনন্দঘন আজ মধুর জাগরণ (৬৮৭), এসো এসো হে সুন্দর, স্বাগতম (৬০৪), এসো হে মহান, এসো পবিত্র (৫৫৯), জয় ঈশ-নন্দন, জয় খ্রীষ্টরাজ (৪৭), জয় জয় জয় হে (১৩৭৮), জয় জয়তু জীবন পূজারী (১৩৭৪), জয় নাম, জয় নাম, তোমারই চরণে প্রণাম (১৩৪০), পিতা নাম ভজ নাম (১৩৯৩), ভুল পথের কাণ্ডারী ওরে (৭৪৭), শক্তি দাও প্রভু মুক্তি দাও প্রভু (৯০৫) ও শান্তি রাণী প্রজ্ঞার রাণী (১১৪৮)। দীপক হালদারের লেখা লক্ষ জনের হৃদয় জুড়ে (৭৫৫) এবং ফাদার ফ্রান্সিস সীমা’র রচিত মধুর সুর আজি বাজে গগনে (৮১০) গানে ফাদার সুনীল ডানিয়েল সুর প্রদান করেছেন।

ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও’র যাজকীয় জীবনটা হচ্ছে বর্ণময়। তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বলদীপুকুর ধর্মপল্লীতে তিনি যাজকীয় সেবাকাজ করেছেন। আর সেই সময় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অরুন খালকো নামক একজন উঁরাও খ্রিস্টভক্তের সাথে ‘ধার্মে অহমা’ নামক উঁরাও কুড়ুক ও সাদ্রী ভাষায় প্রার্থনা ও উপাসনা সঙ্গীতের বই বের করেন। ফাদার সুনীল উঁরাও কুড়ুক ও সাদ্রী উভয় ভাষায় বেশ দক্ষ। এরপর ফিলিপিন্সে দুই মেয়াদে (১৯৮৮-১৯৯১ ও ২০০২-২০০৪) সাত বছর রেডিও ভেরিতাসের বাংলা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি ফিলিপিন্সের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও খ্রিস্টিয় যোগাযোগ কেন্দ্রে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এই সময় ওস্তাদ শাহাবুদ্দিনের নিকট আড়াই বছর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেন। ফাদার সুনীল ডানিয়েলের ভরাট কণ্ঠ ঈশ্বরপ্রদত্ত। আর এই কণ্ঠের যাদুতে রেডিও ভেরিতাসে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সে সময় হাজার হাজার রেডিও ভেরিতাসের শ্রোতা ফাদার সুনীলের কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকতেন।

ফাদার সুনীল ডানিয়েলকে সব্যসাচী বললেও ভুল হবে না। ফাদারের লেখার হাত চমৎকার; প্রত্যেকটি অঙ্গণে তিনি সোনার ফসল ফলিয়েছেন। প্রবন্ধ, নাটিকা, গান ও সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে ফাদার হচ্ছেন সিদ্ধহস্ত। শুনেছি, এক সময় তিনি পড়তেনও প্রচুর। ভারতের নিমাই ভট্রাচার্যের লেখা প্রত্যেকটি উপন্যাস তিনি পড়েছেন বলে জানি। সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে ‘বাংলার জনপদ থেকে’ কলাম ফাদারেরই সৃষ্টি। এই কলামে লেখার মধ্য দিয়ে তিনি অন্য ধারার একটি পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়াও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অনলাইন পেজ বরেন্দ্রদূতে তিনি ‘বিশ্ব মণ্ডলীর খবরা-খবর’ ও ‘সময়ের বিকল্প ভাবনা’ নামক কলামে সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মকধর্মী লেখা লিখতেন।

ফাদার সুনীল ডানিয়েল গুল্টা, মহিপাড়া ও বগুড়াতে পাল-পুরোহিত হিসেবে সেবাকাজ করেছেন। বগুড়াতে তিনি রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অনলাইন রেডিও জ্যোতির পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। আর এই সময়ে রেডিও জ্যোতির জন্য বাইবেলভিত্তিক নাটিকা ‘জীবন বাণী’, ও ছোটদের নাটিকাগুচ্ছ ‘কাকলী’ বইয়াকারে প্রকাশ করেন। এছাড়াও Meditation: A Step of Inner Healing নামক একটি ইংরেজি বইও প্রকাশ করেছেন। রেডিও জ্যোতির অনুষ্ঠানের জন্য ফাদার ‘যুব কল্লোল’, ‘অন্বেষণ ও নার্সিং হোম’ ‘চার্চ নিউজ’, ‘আজকের গণমাধ্যম’, ‘আন্তর্জাতিক সমীক্ষা’, ও ‘মহিলাঙ্গন’ বিভাগের জন্য ভিন্নস্বাদের লেখা লিখতেন। পরবর্তীতে রাজশাহী খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেন্টারে অবস্থান করে তিনি রেডিও জ্যোতি দেখাশুনা করতেন; এবং পরবর্তীতে মুশরইল ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল পুরোহিতের দায়িত্বও পালন করেছেন।

বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীতে উপাসনা সঙ্গীতে যে কয়েকজন ব্যক্তি অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও অন্যতম। তিনি জীবনভর আপন বলয়ে আপন খেয়ালে সুর-সঙ্গীত নিয়ে খেলে সৃষ্টির কাজে মাতাল হয়েছিলেন। রাগ-রাগিণীর ভৈরবী ও ইমনে কাঁটিয়েছেন অধিকাংশ সময়। ভরাট কণ্ঠের মায়ায় উন্মত্ত করে রেখেছিলেন প্রিয় পাঠ-শ্রোতার মনবীণা। আর এই সৃষ্টি সুখের উল্লাস ছিলো সব খ্রিস্টকে ভালবেসে। তাই খ্রিস্টিয় উপাসনা সঙ্গীতের রাজত্বে ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী।

 

Please follow and like us: