ফাদার যোহন মিন্টু রায়

ভূমিকা

খ্রিস্টমণ্ডলীতে প্রায়শ্চিত্তকালের শেষ শুক্রবারকে “Good Friday” পুণ্য শুক্রবার বা যাতনাভোগের শুক্রবার বলা হয়। ইহুদী সমাজে শনিবারকে বিশ্রামবার হিসাবে পালন করা হতো বলে শুক্রবার ছিল বিশ্রামবার পালনের প্রস্তুতি দিবস। এদিনেই যিশু খ্রিস্ট ক্রুশের ওপর প্রাণত্যাগ করেছিলেন বলে এদিন হয়ে উঠেছে শোক ও দুঃখের দিন। প্রাচীন মণ্ডলীতে এদিনকে বলা হতো “Bitter Day” বা বেদনার দিন/তিক্ততার দিন।

মণ্ডলীর পিতৃপুরুষ তের্তুলিয়ান লিখেছিলেন, “যে দিন বর-কে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেদিন আমরা উৎসব করতে পারি না”। সেজন্য আদিমণ্ডলীর সময় থেকে এদিনে কোন খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করা হতো না।  প্রাচীনকাল থেকেই মণ্ডলীতে পুণ্য শুক্রবারের ভক্তিপূর্ণ উপাসনা স্থান পেয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীতে রোমে বাইবেল পাঠ, সামসঙ্গীত গান ও প্রার্থনা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এদিনের উপাসনা করা হতো। সপ্তম শতাব্দী থেকে পুণ্য শুক্রবারের উপাসনায় খ্রিস্টপ্রসাদ বিতরণ ও ক্রুশের অর্চণা যুক্ত হয়। গলগাথায় ক্রুশের ওপরে কখন যিশুর মৃত্যু হয়েছিল এ সম্পর্কে সময়ের ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকলেও মঙ্গলসমাচারগুলোই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সময়ের কথা উল্লেখ করে।

সাধু যোহন রচিত মঙ্গলসমাচার ছাড়া সাধু মথি, মার্ক ও লুক রচিত মঙ্গলসমাচারে বেলা তিন ঘটিকার সময়ে যিশুর প্রাণত্যাগের কথা উল্লেখ আছে (মথি ২৭:৪৬-৫০; মার্ক ১৫:৩৩, ৩৭ ; লুক ২৩: ৪৪-৪৬)। তাই পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিস্টের যাতনাভোগের স্মরণে তাঁর মৃত্যুর সময়ের কথা বিবেচনা করে বিকালবেলা পুণ্য শুক্রবারের উপাসনা করা হতো। এরপর ধীরে ধীরে সকালের দিকেও এ উপাসনা করার প্রচলন হয়। তবে মণ্ডলীতে উপাসনা পদ্ধতির সংস্কার করতে গিয়ে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ দ্বাদশ পিউস কতৃক প্রকাশিত “ORDO FOR HOLY WEEK” নামক  কাথলিক পঞ্জিকায় বিকাল বা সন্ধ্যায় এই উপাসনা অনুষ্ঠান করার নির্দেশ দেওয়া হয় – যা আজও প্রচলিত আছে।

ক্রুশ অর্চণা ক্রুশ চুম্বন

প্রথম দিকে ক্রুশের প্রতি খ্রিস্টানুসারীদের ব্যক্তিগত ভক্তি-ভালবাসা প্রকাশার্থেই ক্রুশ অর্চনা ও চুম্বনের প্রচলন হয়। চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুণ্য শুক্রবার সকালে জেরুশালেমের আশেপাশের খ্রিস্টভক্তগণ কালভেরী পর্বতে সমবেত হতেন এবং সেখানে যাতনাভোগের কাহিনী পাঠ করা হতো। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী খ্রিস্টের প্রকৃত ক্রুশ হিসাবে পরিচিত ক্রুশটি এদিন প্রদর্শন করা হতো।

জানা যায় যে, জেরুশালেমের বিশপ এই পবিত্র ক্রুশটি ভক্তগণের সামনে ধরে থাকতেন এবং ভক্তগণ যিশুর যাতনাভোগের প্রতি তথা খ্রিস্টের প্রতি গভীর ভক্তির প্রকাশ হিসাবে নীরবে এই ক্রুশ চুম্বন করতেন। এই ভক্তি-অনুষ্ঠান দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এমন কি যেখানে এই পবিত্র ক্রুশের স্মৃতিচিহ্ন বা কোন সাধু-সাধ্বীদের স্মৃতিচিহ্ন নেই সেসব স্থানে ও ধীরে ধীরে সমগ্র খ্রিস্টমণ্ডলীতে ক্রুশের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনার্থে ক্রুশ চুম্বন অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়। এভাবে সপ্তম খ্রিস্টাব্দ থেকে রোমীয় উপাসনায় ক্রুশ অর্চনা ও ক্রুশ চুম্বন স্থান করে নেয়।

পুণ্য শুক্রবারে উপাসনার বিশেষ তিনটি দিক হলো (১) বাণী অনুষ্ঠান – শাস্ত্রবাণী ও যিশুর যাতনাভোগের কাহিনী পাঠ ও শ্রবণের মধ্য দিয়ে আমরা যিশুর যন্ত্রণা ও মৃত্যুর প্রকৃত অর্থ বুঝতে চেষ্টা করি। (২) পবিত্র ক্রুশের আরাধনা ও ক্রুশ চুম্বন – গৌরব, বিজয় ও জীবনের আশার প্রতীক ক্রুশের প্রতি আমাদের ভক্তি ভালবাসার প্রকাশ করি। (৩) খ্রিস্টপ্রসাদ গ্রহণ – জীবনদাতা খ্রিস্টের সাথে যুক্ত হই। বর্তমানে ক্রুশ অর্চনা ও চুম্বন অনুষ্ঠানে শাস্ত্রপাঠ ও প্রার্থনার পর যাজক জ্বলন্ত বাতি হাতে দু’জন সেবককে সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা করে পবিত্র ক্রুশ বেদীতে নিয়ে আসেন।

যাজক প্রথমত ক্রুশের ওপরের অংশ, দ্বিতীয়বার দক্ষিণ বাহু ও তৃতীয়বার ক্রুশের সম্পূর্ণ আবরণটি খুলে ফেলেন এবং প্রতিবার থেমে যাজক বলেন, “এই দেখ সেই ক্রুশ! এই ক্রুশের উপরেই মুক্তিদাতা প্রাণ দিয়েছেন। এসো, আমরা এই পবিত্র ক্রুশের আরাধনা করি।” এর উত্তরে সকলে বলেন, “হে ক্রুশ পবিত্র, আমাদের একমাত্র মুক্তির আশা! তোমাকে আমরা নত মস্তকে প্রণাম করি। “এরপর ধুপারতি দিয়ে যাজক বেদীতে ক্রুশ স্থাপন ও চুম্বন করেন এবং সারিবদ্ধভাবে খ্রিস্টভক্তগণও ক্রুশ চুম্বন করে ক্রুশের প্রতি ভক্তি ভালবাসা প্রকাশ করেন।

শেষ কথা

এই ক্রুশের ওপর মৃত্যুবরণ করেই যিশু নিজ রক্তমূল্যে সকল মানবের পাপ নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, গৌরবান্বিত হয়েছেন ও আমাদের সবাইকে ক্রুশের দিকে টেনে এনেছেন। তাই ক্রুশ চুম্বনের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন প্রকাশ করি ক্রুশের প্রতি আমাদের ভক্তি-ভালবাসা,  তেমনি ক্রুশের পথে চলার মধ্য দিয়ে লাভ করি পাপের ক্ষমা ও যিশুর বিশেষ কৃপাশির্বাদ। যিশুর যাতনাভোগ স্মরণে আমাদের জীবনপথের প্রতিদিনের ক্রুশবহন হোক সহজ থেকে সহজতর; যিশুর ক্রুশ-স্পর্শে, চুম্বনে আমাদের জীবন হোক পুণ্য পবিত্র ও ধন্য।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

১। মঙ্গলবার্তা

2| The Catholic Encyclopedia for School and Home, Vol. 4, S.V. “ Good Friday” by William J. O’Shea, S.S

3| The Encyclopedia AMERICANA, Vol. 13 S.V. “Good Friday” by Henry Fehren.

পূর্বপ্রকাশিত: সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, ইস্টার সংখ্যা, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ

Please follow and like us: