ফাদার সুনীল রোজারিও
কৃষ্টি-সংস্কৃতি মানুষের পরিবার এবং সন্তানের মতোই আপন। একটা সন্তান বেড়ে ওঠে পরিবার ও সমাজ থেকে। সেখানেই সন্তান প্রথম দেখা পায় তার সংস্কৃতির। ভাষা, আহাড়, পোষাক, বাসস্থান এবং দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের প্রতিটি স্তর সন্তান লক্ষ্য করতে থাকে। এখানে পরিবার ও সমাজই তার শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। বড়রা বলে দেন না, এটা এইভাবে আর ওটা ঐভাবে। পাঠশালায় না গিয়েও খুব স্বাভাবিকভাবে সন্তান ভাষা শিখে নেয় এবং প্রাত্যহিক জীবনে স্রষ্টার স্থান, প্রকৃতি বা দেবতার তুষ্টি সাধনে যেসব আয়োজন করা হয়, সেগুলো দেখে দেখে শিশু বড় হতে থাকে। এটা সব জাতি ও আদিবাসীদের মধ্যেই বিদ্যমান। আজকের আলোচনায় আদিবাসী কৃষ্টি নিয়েই বলতে চাই।
প্রথমেই বলতে হয় যে, আদিবাসী জনগোষ্ঠি প্রকৃতির স্বচ্ছলতার ওপর জীবন প্রবাহ নির্ভরশীল ছিলো। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, আধুনিক চিকিৎসা, নগরায়ন এবং উন্নয়ন তার জীবনের হুমকি হিসেবেই দেখতো। তাদের জীবন ধারণ ছিরো প্রকৃতির মতোই সুন্দর ও নির্ভেজাল। উপমহাদেশের শত শত নৃ-গোষ্ঠির প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, নৃ-গোষ্ঠি যে এলাকায় বসতী গড়েছিলো, সে এলাকার প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু তাদের কৃষ্টি/ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধশালী করেছে। সেইসাথে সেইসব অঞ্চলের বনাঞ্চলে যেসব খাদ্য সামগ্রী পাওয়া যেতো, তা থেকে তাদের খাদ্যভাষ তৈরি হতো। বিশেষ করে বনাঞ্চল, আবাদি ভুমি ও নদনদী নৃ-গোষ্ঠির আদি সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। নৃ-গোষ্ঠি বরাবরই নিরিহ প্রকৃতির জাতি। অন্যদিকে, বহিরাগতদের আক্রমন, প্রাকৃতিক দৃর্যোগে বনাঞ্চল, আবাদি ভুমি ধ্বংস ও নদনদীর গতিপথ বদলের কারণে এবং সেই সাথে প্রকৃতির স্বচ্ছলতা কমে যাওয়ার কারণে তারা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হতো। এইসব কারণ তাদের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। এগুলো নৃ-গোষ্ঠির প্রাচীনকালের দৃশ্য। আজকের যুগে, জনসংখ্যাধিক্য, বনাঞ্চল বিনাশ, পরিবেশ বিপর্যয়, আকাশ সংস্কৃতি, ধর্মান্তরিত, আধুনিক ষিক্ষা ও আধুনিকতার কারণে আদিবাসীর ভাষা, সংষ্কৃতি ও জীবন প্রকৃতি সোজা কথায় হুমকির মুখে।
সংস্কৃতি মৃত জীবন ব্যবস্থা নয়- এটা জীবন্ত। কালের বিবর্তনে, প্রকৃতির পরিবেশ পরিবর্তনে, সময়ের প্রয়োজনে এবং বৃহত্তর সমাজের প্রভাবে কৃষ্টির মধ্যে পরিবর্ধন, পরিরবর্তন অনিবার্য। বিশ্বের সর্বত্রই আদিবাসীদের মধ্যে এই পরিবর্তন লক্ষনীয়। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজের একটা বৃহৎ অংশ আজকে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। তারা কোনো প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে এটা বলা যাবে না। তারা নিজেরাই বেছে নিয়েছে খ্রিস্টধর্ম। এর পিছনে বহুবিধ কারণও রয়েছে- যার মধ্যে প্রকৃতি-পরিবেশ বড় বিষয়। বৃহৎ শক্তির কাছে মানুষের নত হওয়া একটা স্বভাবজাত চরিত্র। কিন্তু আজকে কোথায় সে প্রকৃতি-পরিবেশ- যেখানে প্রাচিনকালে দেব-দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তাদের দৈনন্দিন উপাসনা, উৎসবের আয়োজন হতো। তাহলে তাদের সন্তান-সন্ততি, বিষয় সম্পদ কে রক্ষা করবে। অনেকে আবার নিরাপত্তার বিষয়টিও বড় করে দেখেছে। ফলে তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। অন্যদিকে মিশনারিগণ তাদের রক্ষার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আদিবাসীদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে এমনটি বলা যাবে না।

প্রতিটি বড় ধর্মেরই আলাদা কিছু কৃষ্টি-সংস্কৃতি রয়েছে। বছর ধরে উপাসনা করতে গিয়ে ধর্মের শিক্ষা, ধর্মের বিধি নিষেধ জীবনকে প্রভাবিত করে। ফলে নিজেদের জীবনকে ঘিরে আদি সংষ্কৃতির গুরুত্ব খুব স্বাভাবিকভাবে কমে যেতে থাকে। এমনটা হওয়ার জন্য কোনো পক্ষকেই দোষ দেওয়ার অজুহাত দাঁড় করার জো নেই। তবে যদি এমনটি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে, তাহলে দেখা যাবে আদিবাসীদের আলাদা জাতিগোষ্ঠি হিসেবে চিনার আর কোনো চিহ্ন থাকবে না। তাই একটা উদ্যোগ অবশ্যই খোঁজার প্রয়োজন ছিলো- ধর্মের বিধি বিধান অনুশীলনের পাশাপাশি নিজেদের আদি কৃষ্টি-সংস্কৃতির একটা যোগসেতু তৈরি করা।
চলতি বছর রাজশাহী ডাইয়োসিসে অনুষ্টিত হলো ১৭তম পালকীয় সম্মেলন। আর এই পালকীয় কর্মশালার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো “কৃষ্টি-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে খ্রিস্টবাণী প্রচার।” আদিবাসী ভাষা, সংষ্কৃতি আধুনিকতার চাপে পড়ে যে হারিয়ে যাচ্ছে- সমস্যাটির দিকে নজর দিতেই এবারে মূল বিষয়। সম্মেলন আয়োজন করা সহজ কিন্তু মূল বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাওয়া অতো সহজ মনে করি না। আজকে আদিবাসীদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত হলেও তারা নিজের সংস্কৃতি নিয়ে কতোটুকু চিন্তা ভাবনা করে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। প্রবীণরা অশিক্ষিত হলেও এখনো তারা কৃষ্টি নিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু শিক্ষিত নবীনরা নিজেদের সংষ্কৃতির এতো ধারণা রাখে না। কিন্তু কৃষ্টি-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে হলে শিক্ষিত আদিবাসী এগিয়ে আসা, না আসার কোনো বিকল্প নাই। আদিবাসীদের অনেক সংঘ-সমিতি গড়ে উঠলেও কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিষয়টি নিয়ে সেখানে তেমন চর্চা হয় না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সংস্কৃতি জানা আর সংস্কৃতির মাধ্যমে বাণী প্রচার এক কথা হলো না। এখানে বাণী প্রচারে সংস্কৃতির সংস্কৃতায়ন পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয় রয়েছে। এই গবেষণার বিষয়টির অভাব রয়েছে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষা বা গবেষণা কারা কীভাবে করবে সে বিষয়ে রেডিও জ্যোতির পক্ষ থেকে রাজশাহী ডাইয়োসিসের বিশপ জের্ভাস রোজারিওকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি খোলাসা করে বলার চেষ্টা করেছেন। বিশপ বলেছেন- এটা চার্চ এবং জনগণের একটা সম্মিলীত চেষ্টার মাধ্যমে করতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কৃতি জীবন্ত এবং প্রবাহমান। কোনো এক বিন্দুতে স্থির হয়ে নেই। সেইদিকে নজর রেখে পুজা পার্বণের মূল ভাবনার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে- যেখানে একটা নির্দিষ্ট উৎসবের আদি ও মূল কথা বলা রয়েছে। সেই মূল ধারণাকে উদ্ধার করে বাণী প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এগুলো উপাসনানির্ভর- পালাগান, নাটক ও আরো কিছু হতে পারে। এই কাজটি করার জন্য বিশপ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে কিছু দল গঠনের কথা বলেছেন। আসল কথাটিই হলো কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে পরীক্ষা ও গবেষণা। তাই ভাবতে পারি যে এই কাজটি এখন থেকে অব্যাহত থাকবে। (চলবে)

Please follow and like us: