পূণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের সার্বজননীন পত্র “তোমার প্রশংসা হোক, হে প্রভু” এর পঞ্চম বর্ষ ঊদ্যাপনকালে তিনি আমাদের আবার ও স্মরণ করিয়ে দেন যেন আমরা ঈশ^রের সৃষ্টির যত্ন ও পরিচর্যায় আরও বেশি দায়িত্বশীল হই। কারণ “ঈশ^রের সৃষ্টিকর্মের যত্ন নেওয়া ও তা লালন পালন করে সৎ ও ধার্মিক জীবন যাপন করাই হচ্ছে আমাদের আহ্বানের মূল বিষয়’ এটি আমাদের খ্রীষ্টিয় জীবনের কোন ঐচ্ছিক বা আনুষঙ্গিক বিষয় নয়” (তোমার প্রশংসা হোক- ২১৭)।
পোপ মহোদয়ের এই পত্রের আলোকে এ বছর আমাদের ধর্মপ্রদেশের পালকীয় কর্মশালার জন্য যে মূলভাবটি বেছে নেওয়া হয়েছে তা হল ’আমরা হলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক’। আর আমাদের ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ এই মূলভাবের উপর একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ পালকীয় পত্র লিখেছেন। এই পালকীয় পত্র পড়ার মধ্য দিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা ও আত্মপোলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি এবং অনুধ্যান করার চেষ্টা করেছি। আমি যাজকীয় জীবনে যে সেবা দায়িত্ব আমি পেয়েছি তা আমি ঈশ^রের কাছ থেকেই দান পেয়েছি। আমার জীবনে ‘যাজকত্ব’ হল ঈশ্বরের একটি মহাদান। একজন যাজক হিসেবে খ্রীষ্টের মহাযাজকত্বের অংশিদার হয়ে ভক্তজনগণের আধ্যাত্মিক যত্ন ও ঈশ^রের সৃষ্টিকর্মের যত্ন নেওয়াই হল আমার জীবনের সর্বোত্তম আহ্বান। সেই যাজকীয় আহ্বানে আমি কতটুকু বিশ্বস্ত থাকি ও সেবাদায়িত্ব পালনে সচেতন আছি তা আত্মপোলব্ধি করার চেষ্টা করছি ।
আজ মনে পড়ছে ছোট বেলার সেই স্মৃতিকথা। আমি যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা করি তখন থেকেই গির্জায় সেবক হতাম ও সেবক দলের মিটিং ও বিভিন্ন কার্যক্রমে যোগ দিতাম। তখন সেবক হিসেবে আমার দায়িত্ব সর্ম্পকে যতটুকু না বুঝতাম তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম যখন গির্জায় সেবক হয়ে ফাদারে পাশে বসে থাকতাম। একটা বিষয় আমার খুব ভাল লাগতো যখন সেবক দলের ক্লাসে ফাদার-সিস্টারগণ বলতেন, ‘তোমরা হলে যীশুর সেবক’। তাই আমি যখন সেবক হতাম তখন চিন্তা করতাম, যে আমি যীশুর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরই সেবা করছি। বড় হবার সাথে সাথে এই সেবক হবার বিষয়টা আমার কাছে আরও একটু পরিস্কার হয়। আর এভাবেই আমার যাজকীয় জীবনের আসার অনুপ্রেরণাও লাভ করি। ধীরে ধীরে যখন জ্ঞান-বুদ্ধিতে বেড়ে উঠি তখন এই সেবাকাজের জীবনাহ্বান সর্ম্পকে আরও বেশি জানতে চেষ্টা করি এবং যাজকীয় জীবনে সেবাকাজের বিস্তৃতি সর্ম্পকেও জানতে পারি। সেমিরারীতে পড়াশোনার সময় যাজকীয় সেবাকর্মও আত্মনিবেদন ও নম্রতার বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি। ঐশতত্ত্ব পড়াশোনার সময় জেনেছি, ‘যাজক হলেন ঈশ্বরের জনগণের জন্য সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গকৃত। ভক্তজনগণের সেবার্থেই যাজক নিজেকে নিবেদন করেন নম্রতা ও আনুগত্যের সাথেই, ঠিক মহাযাজক যীশু খ্রীষ্টেরই মত। খ্রীষ্টের সেই আদর্শ অনুসরণ করেই যাজকগণ ভক্তজনগণের সেবক হয়ে উঠেন। ভক্তজনগণের সাথে যাজকের সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃসুলভ, বন্ধুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ।’ এই বিষয় গুলো নিয়ে আমি আরও গভীরভাবে ধ্যান করি এবং শুনতে পাই যীশুর সেই বাণী, “সেবা পেতে নয় বরং সেবা করতেই মানবপুত্র এ জগতে এসেছেন”(মথি ২০:২৮)। যীশু মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেছেন। তিনি গরীব-দুঃখী, অভাবী ও ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি উদার ছিলেন। তিনি কুষ্ঠ রোগীদের সুস্থ করেছেন, অন্ধকে দৃষ্টি দিয়েছেন, ক্ষুধার্তদের খেতে দিয়েছেন, এমনকি মৃতকেও জীবন দিয়েছেন। যীশু পাপী-তাপী সকল মানুষকেই ভালবেসেছেন। যাজকীয় গঠন লাভের দীর্ঘ সময়ে যীশুর সেই জীবনাদর্শে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি আর যীশুকে অনুসরণ করার জন্য মনোস্থির করি। আমি একজন নতুন যাজক হিসেবে ভক্তজনগনের জন্য আধাত্মিক ও সংস্কারীয় সেবাকর্ম করার দায়িত্ব পেয়েছি। আমার জীবনে শত অযোগ্যতা ও দুবর্লতা থাকা সত্বেও তিনি আমাকে তার সেবাকাজের জন্য মনোনীত করেছেন। যীশু আমার জীবনের ঊত্তম মেষপালক হয়ে তিনি প্রতিনিয়ত সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন, আমাকে তাঁর সেবাকর্মী হিসেবে মনোনীত করেছেন। পূণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের সার্বজননীন পত্র “তোমার প্রশংসা হোক, হে প্রভু” এর আলোকে আমার একান্ত উপলব্ধি ও অনুধ্যান হল, যাজক হিসেবে ভক্তজনগণের পালক হয়ে তাদের পালকীয় যত্ন নেওয়াই শুধু নয় বরং ঈশ্বরের সুন্দর সৃষ্টিকর্মের প্রতি যত্নশীল সেবক হওয়া আমার বিশেষ দায়িত্ব। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই ঈশ^র মানুষকেই অন্য মানুষের সেবা-যত্ন, রক্ষণা-বেক্ষণ ও ভালবাসার দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈশ^রের এই অপূর্ব সৃষ্টিকে যদি অবহেলা করি বা স্বার্থপর, ভোগবাদী, হিংসুটে, ঈর্ষাপরায়ণ ও অন্যদের প্রতি হিংস্র হই, তবে ঈশ^রের দেওয়া দায়িত্বের প্রতি অবহেলাই করি, অবাধ্য হই। বর্তমান বিশে^ একটা চরম বিপর্যয়ের মুখে পতিত। মানুষ ঈশ^রের সৃষ্টিকে নানাভাবে কুলষিত করছে, ধ্বংস করছে। মানুষ হিংস্রতার বশবর্তী হয়ে মানুষকে খুন করছে, প্রাণীকূলকে ধ্বংস করছে ও সুন্দর প্রকৃতিকেও নষ্ট করছে পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঈশ^রের সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য ঈশ^র আমাকে প্রতিনিয়ত ডাকছেন। আজ আমার একান্ত অনুধ্যান ঈশ^র আমাকে ভালবেসে তাঁরই দ্রাক্ষাক্ষেত্রে সেবাকাজের জন্য মনোনীত করেছেন। একজন যাজক হলেন ঈশ্বরের মনোনীত বিনয়ী বিশ্বস্ত ও পবিত্র সেবক। তাই আমি বিশ^াস করি, একজন যাজক হিসেবে আমার সেই সেবকের দায়িত্ব পালন করা একটি পবিত্র দায়িত্ব। আজ ঈশ^রের কাছে একটাই মিনতি, আমি যেন সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ঈশ^রের সৃষ্টিকর্মের সেবাকর্মী হিসেবে নিজেকে দান করতে পারি, তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রংশসা ও গৌরবে মুখরিত করতে পারি এই ধরণী।
ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন
Please follow and like us: