ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
ছোটোকালে সন্ধ্যায় রোজারিমালা প্রার্থনার শেষে বুড়া-বুড়িরা গল্প বলতেন। একদিন শেষদিনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “শোন্ শেষদিনে আকাশ থেকে যখন সূর্য-নক্ষত্র খসে পড়বে, তখন মেলা রকমের ভন্ড প্রবক্তা এসে বলবে, আমার ছাতার তলে আসো, তাহলে আগুনের আঁচ লাগবে না। বুঝলি, যারা ভন্ড প্রবক্তার কথা শুনবে, তারা মরবে।” মনে রাখতে হবে, মিষ্টি সুরের মর্ম কথা- পতন বয়ে আনে। যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি- তা হলো প্রকৃত প্রবক্তা কে বা কারা?
“প্রাচীনকালে পরমেশ্বর আমাদের পিতৃপুরুষদের কাছে বহুবার বহুরূপে কথা বলেছিলেন প্রবক্তাদের মুখ দিয়ে (হিব্রু ১ঃ১)।” এই বাক্যের অর্থ হলো, প্রবক্তাগণ ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত এবং প্রেরিত। “মাতৃগর্ভে ধারণ করার পূর্বে আমি তোমাকে জানতাম এবং জন্ম নেওয়ার আগেই তোমাকে পবিত্র করে রেখেছিলাম। আমি তোমাকে জাতিগণের কাছে প্রবক্তা হিসেবে নিযুক্ত করেছি (জেরেমিয়া ১ঃ৫)।” বাইবেলে উল্লেখিত প্রবক্তাদের আগমন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঈশ্বর তাঁদের বিশেষ সময়ে, বিশেষ সংকট মোকাবেলার জন্য বিশেষ বাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন। বাইবেলের প্রাচীন নিয়ম থেকে শুরু করে নতুন নিয়মের দীক্ষগুরু যোহন পযর্ন্ত প্রবক্তাগণ ঈশ্বরকর্তৃক মনোনীত হয়ে প্রেরিত হয়েছেন। তার পরে এসেছেন স্বয়ং খ্রিস্ট। “কিন্তু শেষ যুগের এই দিনগুলোতে আমাদের কাছে তিনি কথা বলেছেন আপন পুত্রেরই মুখ দিয়ে (হিব্রু ১ঃ২)।” বাইবেলের নতুন নিয়মে সাধু পৌল তাঁর বিভিন্ন পত্রে কয়েকবার উল্লেখ করেছেন, প্রবক্তাগণ মন্ডলির জন্য ঈশ্বরকর্তৃক মনোনীত। ১ম করিন্থীয় (১২:২৮) পত্রে লিখেছেন, “পরমেশ্বর যাদের মন্ডলিতে বিশেষ পদে বসিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমে আছেন প্রেরিতদূতগণ, তারপর প্রবক্তাগণ…।” এফেসীয়দের কাছে সাধু পৌল লিখেছেন, “তাঁরই দেওয়া ক্ষমতায় কেউ কেউ হয়ে উঠেছে প্রেরিতদূত, কেউ কেউ প্রবক্তা …।” একই পত্রে সাধু পৌল আরো বলেছেন, “তোমরা প্রেরিতদূত ও প্রবক্তাদের ভিত্তির ওপর নির্মিত যেনো একটি গৃহ, আর সংযোগ প্রস্তর হলেন স্বয়ং খ্রিস্ট-যিশু।”
ঈশ্বরের রাজ্য প্রচার করা একটা অনুগ্রহদান এবং আহ্বান। “আমাদের যে অনুগ্রহ দেওয়া হয়েছে, সে অনুসারে যখন আমরা বিশেষ বিশেষ অনুগ্রহদানের অধিকারী, তখন তা যদি ভাববাদীয় দান হয়, তবে এসো, বিশ্বাস অক্ষুন্ন রেখে ভাববাদীর ভূমিকা অনুশীলন করি, তা যদি সেবাকর্মের অনুগ্রহ দান হয়, তবে সেই সেবাকর্মে নিবিষ্ট থাকি, তা যদি শিক্ষাদান হয়, তবে শিক্ষাদানে, তা যদি উপদেশদান হয়, তবে উপদেশদানে নিবিষ্ট থাকি, (রোমীয় ১২:৬-৮)।” ঈশ্বর যুগ যুগ ধরেই মানুষকে বেছে নিয়েছেন বাণী প্রচারের জন্য। ঈশ্বর যাদের বেছে নিয়েছেন বাণী প্রচারের জন্য, এই কাজটি তাদের করতে হয় বিশ্বাস অক্ষুন্ন রেখে এবং তাদেরকে থাকতে হয় যাবতীয় বিতর্কের উর্ধ্বে। এই বিষয়ে বাইবেলে বলা হয়েছে, “ভাই, তোমাদের মধ্য থেকে তোমরা এমন সাতজনকে বেছে নাও, যাদের সুনাম আছে, যারা ঐশআত্মা ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের হাতে আমরা এই কাজের ভার তুলে দেব (শিষ্য ৬:৩)।” বাণী প্রচারের জন্য বরাবরই ঈশ্বর আলাদাভাবে মানুষকে বেছে নিয়েছেন। যেমনটি যোহন বলেছেন, “…আমি তোমাদের বেছে নিয়েছি, তোমাদের নিযুক্তও করেছি (১৫:১৬)।” বাইবেলের প্রাচীন এবং নতুন নিয়মের বহু স্থানে উল্লেখ রয়েছে যে, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রবক্তা করে বেছে নিয়েছেন। কেউ স্বেচ্ছায়, নিজের স্বার্থে, নিজেকে প্রবক্তার আসনে বসাতে পারে না। যারা নিজেকে প্রবক্তার আসনে বসায়, তারা ভন্ড, তাদের লক্ষ্য ভিন্ন এবং যারা তার চারপাশে ভিড় করে- তারা সবাই ঈশ্বরের দশ আজ্ঞার দ্বিতীয় আজ্ঞা লংঘন করে। যেখানে বলা হয়েছে, “ঈশ্বরের নাম অনর্থক লইবে না।”
পবিত্র বাইবেলে যিশু নকল ধর্মগুরুদের বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। যিশু বলেছেন, “নকল প্রবক্তাদের সম্বন্ধে তোমরা কিন্তু সতর্ক থেকো। বাইরে ভেড়ার পোশাক পরেই তোমাদের কাছে আসে ওরা, কিন্তু ভিতরে ওরা শিকার-লোলুপ নেকড়েরই মতো (মথি ৭:১৫)।” এইসব ভন্ড প্রবক্তারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শেষ দিনের দিকে আবির্ভূত হবে। নকল খ্রিস্টদের আগমন সম্বন্ধে যিশু সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আবরও বলেন, “সেদিন কেউ যদি তোমাদের বলে, দেখ দেখ খ্রিস্ট এই তো, বা খ্রিস্ট ওই তো- তবে তা বিশ্বাস করো না। কেনো না, নকল যতো খ্রিস্ট ও নকল যতো প্রবক্তা, মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই। নানা আশ্চর্য কান্ড ও অদ্ভূত ঘটনা ঘটিয়ে তারা ঈশ্বর মনোনীত মানুষদেরও মন ভোলাতে চাইবে, অবশ্য অমন মন ভোলানো যদি আদৌ সম্ভব হয় (মথি ২৪:২৩-২৪)।” যারা ভন্ড, যারা ধান্ধাবাজ, তাদের ভাষা কিন্তু চমৎকার, তারা মিষ্টভাষী, কথার চমক দেখিয়ে সহজেই তারা মানুষের মন জয় করতে পারে। একজন যাজক তাঁর উপদেশবাণীতে বলেছিলেন, “তুমি সেরাটা প্রচার করতে পারো, কিন্তু তোমার নিজের হৃদয় যদি ঠিক না থাকে, ঈশ্বর তা শুনবে না।” নকল প্রবক্তা আর নকল খ্রিস্ট হলো তারা- যাদের হৃদয় ঠিক নাই। ভন্ড প্রবক্তা সাধারণত অর্ধেক সত্য প্রকাশ করে। এই প্রসঙ্গে ইহুদি প্রবাদবাক্য বলে, “অর্ধ সত্য মানে পুরোটা মিথ্যা।” ভন্ড প্রবক্তা তার কর্ম পরিচালনা করে, প্রলোভন, ছল চাতরী দিয়ে- পবিত্র আত্মার শক্তিতে নয়, তার মধ্যে পবিত্র আত্মা বিদ্যমান নেই। কিন্তু আসল প্রবক্তা পরিচালিত হোন পবিত্র আত্মার শক্তিতে। “পবিত্র আত্মা যে ফসল ফলিয়ে তোলেন, তা হলো: ভালোবাসা, আনন্দ, শান্তি, সহিঞ্চুতা, সহৃদয়তা, মঙ্গলানুভবতা, বিশ্বস্ততা, কোমলতা আর আত্মসংযম (গালাতীয় ৫:২২-২৩)।” একই প্রসঙ্গে মঙ্গলসমাচার লেখক সাধু লুক বলেন, “ভালো লোক তার অন্তরে সঞ্চিত ভালোর ভান্ডার থেকে যতো ভালো কিছুই বের করে আনে; তেমনি খারাপ লোক তার খারাপের ভান্ডার থেকে যতো খারাপ কিছুই তো বের করে আনে। কেনো না, মানুষের অন্তর যা দিয়ে ভরা থাকে, মানুষের মুখ তেমন কথাই বলে (৬:৪৫)।”
যিশু তাঁর দ্বিতীয় আগমনকালে কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে শিষ্যদের বলতে গিয়ে, ভন্ড প্রবক্তারা যে আসবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। “যিশু বললেন, শোনো, সতর্ক থেকো তোমরা, কেউ যেনো তোমাদের মন না ভোলায়। কেনো না, আমার নাম নিয়ে অনেকেই তো আসবে আর বলবে, আমিই সেই খ্রিস্ট এবং তারা অনেকের মনও ভোলাবে (মথি ২৪:৪-৫)।” সাধু পৌল, গভীর উৎসাহের সঙ্গে মঙ্গলসমাচার প্রচার করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কারণ এমন দিন আসবে, যখন মানুষ সেই যথার্থ শিক্ষা শুনতেই চাইবে না। তারা বরং তাদের খেয়াল খুশি মতোই নিজেদের চারপাশে এমন সব ভন্ড গুরুর ভিড় জমিয়ে তুলবে, যারা নানা কথার সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মন যুগিয়ে চলবে। … তুমি কিন্তু যে কোনো অবস্থাতেই স্থির সংযত হয়ে থেকো। ধৈর্যের সঙ্গে সমস্ত দুঃখভোগ স্বীকার করো (২য় তিমথি ৪:৩-৫)।”
ঈশ্বর মানুষকে আলাদা আলাদা জ্ঞান, বুদ্ধি, সামর্থ দিয়েছেন, খ্রিস্টের বাণী প্রচার করার জন্য। আমরা আমাদের নিজ নিজ সামর্থ দিয়ে বাণী প্রচারের জন্য আহুত। জনগণকে নিয়েই চার্চ। প্রতিটি ভক্তের দায়িত্ব সাধ্য মতো বাণী প্রচার করা। তবে চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, চার্চের সাক্রামেন্তীয় জীবন বিসর্জন দিয়ে, চার্চের শিক্ষা আমলে না রেখে কেউ যদি নিজের ডকট্রিন, মতবাদ ও বানানো নিয়ম নীতি প্রচার করতে চায়- চার্চ কখনো তাকে স্বীকৃতি দেয় না। মানুষ আগে হোক আর পরে হোক, কে সত্যের উপাসক তা বুঝতে পারে। মনে রাখতে হবে- বাইবেল কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়, ধর্মের নামে ব্যবসা করার জন্য কোনো পণ্য নয়। বাইবেল হলো মুক্তির ইতিহাস- স্বর্গের চাবিকাঠি।
প্রার্থনার উপযুক্ত স্থান হলো গির্জা। মনের প্রশান্তি, ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের উপযুক্ত স্থান উপাসনালয়। বিশ্বের অন্যতম স্থাপনাসমূহ হলো গির্জাঘর। যাজকগণ বাণী প্রচারের জন্য যেখানে বা যেদেশে গিয়েছেন, তার কাজটি শুরু করেছেন গির্জাঘর তৈরি করার মধ্যদিয়ে। যেখানে গির্জা নির্মিত হয়েছে, সেখানেই কালক্রমে গড়ে উঠেছে ধর্মপল্লী। এই ঘরে প্রবেশ করলেই মনের মধ্যে নেমে আসে অন্যরকম অনুভূতি। ধর্মপল্লীর মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় যখন দেখে তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুন্দর গির্জাঘর। তাহলে যারা এই গির্জাঘর আত্মার জন্য যথেষ্ট মনে না করে, ধর্মগুরুদের কাছ থেকে উপদেশবাণী না নিয়ে, চাটুকারদের খপ্পরে প’ড়ে নানা রকমের আখড়া, আস্তানা খুঁজে- তারা একসময় মনের মধ্যে প্রকৃত বিশ্বাস তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এদের বেশির ভাগই প্রলোভনে পা দিয়ে অবস্থার শিকার হয়।
উপসংহারে ১ম যোহনের পত্র থেকে উদৃতি দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। “আমার স্নেহের সন্তানেরা, তোমরা কিন্তু পরমেশ্বরের আপনজন; আর সেই সব নকল প্রবক্তাকে তোমরা জয় করেছো; কারণ যিনি তোমাদের অন্তরে রয়েছেন, তিনি সেই খ্রিস্ট-শত্রুর চেয়ে শক্তিশালী- যে খ্রিস্ট-শত্রু এই সংসারে রয়েছে। সেই সব প্রবক্তারা সংসারের লোক, তাই তারা কথা বলে সংসারের ভাষায়, আর সংসারও তাদের কথা শোনে। আমরা কিন্তু পরমেশ্বরের আপনজন; তাই পরমেশ্বরকে যে জানে, সে আমাদের কথা শোনে; আর যে পরমেশ্বরের আপনজন নয়, সে আমাদের কথা শোনেই না। এ-ই থেকেই আমরা বুঝতে পারি- কোন আত্মিক প্রেরণার মধ্যে রয়েছে সত্য, আর কোন্টা ভ্রান্তিময় আত্মা (৪:৪-৬)।” পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: