প্রিয় যাজক ভাই ও বন্ধুরা,
আমার প্রণাম ও শুভেচ্ছা নিও। তোমরা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের যাজক বা পুরোহিত; তাই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ হিসেবে তোমাদের আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি এই জন্যই তোমাদের অভিনন্দন জানাই যে ঈশ্বর তোমাদের বেছে নিয়েছেন তাঁরই জনগণকে সেবা করার জন্য। তোমরা সাধারণ, কিন্তু ঈশ্বর তোমাদের অসাধারাণ করে তুলেছেন। যে মেলখিসেদেক মুক্তিদাতা প্রভু যিশুর পূর্বচ্ছবি সেই “মেলখিসেদেকের রীতি অনুসারে তুমি চিরকালের মতো যাজক” (সামসঙ্গীত ১১০:৪; হিব্রু ৫:৬)। আমি সাধু পলের মতই আমার প্রার্থনায় আমি সর্বদাই তোমাদের কথা মনে রাখি; সবসময়ই তোমাদের সকলের জন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। যিনি আমাদের ঈশ্বর ও পিতা, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি এই কথা স্মরণ করি যে, কেমন ভাবে কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তোমাদের ধর্মবিশ্বাস, কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তোমাদের ভক্তি-বিশ্বাস আর কর্তব্যনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রভু যিশুখ্রিস্টের ওপর তোমাদের আশা-ভরসা (তুলনীয় ১ থেসা ১:২-৩)। যদিও তোমরা এই সেবা কাজের জন্য তোমাদের কোন বেতন বা পুরষ্কার দেয়া হয় না, তোমরা সেই কারণে তোমাদের সেই সেবা কাজ থেকে বিরত হও না। ঈশ্বর তোমাদের আহ্বান করেছেন, যিশু তোমাদের অভিষিক্ত করে প্রেরণ করেছেন যেন তোমরা খ্রিস্টমণ্ডলির ও ঐশজনগণের সেবা করতে পার।
আমি ভাল করেই জানি যে তোমরা সকলেই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তোমাদের যাজকীয় সেবা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছ। এই কাজ করতে গিয়ে তোমাদের প্রচুর পরিশ্রম, কষ্ট ও ত্যাগস্বীকার করতে হচ্ছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে এর জন্য তোমরা ব্যক্তিগতভাবে কোন পারিশ্রমিক বা পুরষ্কার তো পাওই না, বরং উল্টো অনেকবার তোমাদের সইতে হয় সমালোচনা, বঞ্চনা, গঞ্জনা, আরও কত কি! তবু যীশুর উপর ভরসা রেখে তোমারা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছ অবিচলভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে। এই জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেই যে ঈশ্বর আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের জন্য তোমাদের মত এমন ত্যাগী, পরিশ্রমী ও নিঃস্বার্থ সেবাকর্মী দিয়েছেন। আমি তোমাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারপরেও আমি কিছু কথা তোমাদের বলতে চাই, আশা করি তোমরা তা ক্ষমাসুন্দর মন নিয়েই তা গ্রহন করবে।
মনে করে দেখ তোমরা সেমিনারীতে প্রবেশের সময় ও সেখানে গঠন লাভের সময় কত অধীর উন্মুখ হয়েই না তোমরা অপেক্ষা করছিলে, কবে সেই দিনটি আসবে যেদিন তোমরা প্রভুর বেদীতে খ্রীষ্টযজ্ঞ নিবেদন করতে পারবে। অনেক ধৈর্য্য ও পরিশ্রম করে দীর্ঘ সময় নিয়ে, কঠিন সব পড়াশুনা শেষ করে, আরও কত পরীক্ষাÑনিরীক্ষা ও চড়াই উৎরাই পার হয়ে, একদিন সেই দিনটি তোমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এসেছিল। এখন তোমরা স্মরণ করে দেখ তোমাদের যাজকীয় অভিষেকের দিনটির কথা, সেদিন তোমাদের কি মনোভাব আর অভিলাশ ছিল! সেদিন তোমাদের অন্তর ছিল পবিত্র, তোমার দেহ মন ছিল প্রভু যিশুর জন্য সম্পূর্ণ নিবেদিত। সেদিন কিন্তু তোমাদের কোন উচ্চ বেতন পাওয়া, পদোন্নতি পাওয়া বা বড় কোন পুরষ্কার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল না। বরং সেদিন তোমাদের প্রত্যেককে এই যাজকীয় জীবনের অনেক ত্যাগস্বীকার ও চ্যালেঞ্জের কথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবু সেদিন গেয়েছিলে “আমি নিজেকে উজাড় করে তাঁকে ভালবাসবো, প্রাণভরে যতনে শুধু যিশু বলে ডাকবো”। তোমরা যে জীবনের প্রত্যাশায় এতদিন ছিলে, কঠিন বন্ধুর পথ পেড়িয়ে তোমাদের যাজকীয় অভিষেকের মধ্য দিয়ে সেই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছলে বলে তোমাদের মনে সেদিন তোমাদের মনে ছিল অঢেল আনন্দ। সেই আনন্দে ভুলেই গিয়েছিলে যে, সেই আনন্দ মুহূর্তটি ক্ষণস্থায়ী হবে, যদি তুমি সর্বদা প্রভু যিশুর সঙ্গে না থাক। যারা সেদিন তোমাদের ধন্য ধন্য করেছিল, তোমাদের বিপদের দিনে, কঠিন সময়ে বা কষ্টের সময়ে, তারা কিন্তু কাছে থাকবে না। সেদিন সেই যিশুই তোমাদের সাথী হবেন – বন্ধু হয়ে তোমাদের সমব্যথী হয়ে পাশে থাকবেন। যিশুর ওপর আস্থা রাখ, তিনি কখনোই তোমাদের ঠকাবেন না।
যাজক হিসাবে তোমাদের প্রথম ব্রত ও দায়িত্ব হলো নিজে পবিত্র থাকা এবং তোমাদের তত্বাবধানে যারা থাকবে অথবা যারা তোমাদের কাছে আসবে তাদেরকে পবিত্র হতে সাহায্য করা। সেই পবিত্র সেবাকাজ করতে হলে তোমাদের চলতে হবে পবিত্র আত্মার পথ ধরে, যে পবিত্র আত্মা “খ্রিস্ট-যিশুতে নিহিত জীবন মানুষকে দান ক’রে থাকেন, সেই ঐশ আত্মার বিধান তো পাপ ও মৃত্যুর বিধান থেকে আমাদের মুক্তই করে দিয়েছেন” (রোমীয় ৮:২)। আমরা অভিষেকের দিনে নিজেকে ত্যাগ করে যিশুকেই পরিধান করেছি (তু: গালা ৩:২৭); সেইজন্য তোমাদের মনে জেগেছিল “আমি আজি সাজিব শুভ্র বসনে প্রভু তোমার শরণে। নিজেকে করিব সমর্পণ তোমারি তীর্থ চরণে”। তাই তোমাদের মনে রাখতে হবে যে, তোমরা এখন আর তোমাদের নিজেদের নও, তোমরা খ্রিস্ট যিশুর। সেই জন্যই তো তোমাদের বলা হয় “অপর খ্রিস্ট”। তাই তোমাদের খ্রিস্ট যিশুর মতই হতে হবে, করতে হবে তা-ই যা খ্রিস্ট করতেন, বলতে হবে তা-ই যা খ্রিস্ট বলতেন। মানুষ যেন তোমাদের মধ্যেই খ্রিস্ট যিশুকেই দেখতে পায় আর তাঁর ভালবাসা তোমাদের কাছেই পায়। “ভেবে দেখ তো, পরম পিতা কী অগাধ পেেেমই না আমাদের ভালবেসেছেন, যার জন্য আমরা ঈশ্বর-সন্তান ব’লে অভিহিত – আর আমরা তো সত্যিই তা-ই! সংসার যে আমাদের চেনে না, তার কারণ, পরমেশ্বরকেই সে চিনতে পারেনি” (১ যোহন ৩:১)।
তোমাদের ব্রতগুলির কথা স্মরণ করে দেখ, বাধ্যতা ও কৌমার্য পালন করা সহজ নয়, অথচ যাজকাভিষেকের সময় সেই প্রতিজ্ঞাই তুমি নিয়েছিলে। ধর্মপ্রদেশের কর্তৃপক্ষ বা বিশপ তোমাদের যে কাজ দিবেন তোমরা তা-ই করবে, যেখানে তোমাদের যেতে বলবেন তোমরা সেখানেই যাবে। তোমাদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকা সত্বেও তোমরা পদ পদবীর দাবী বা অহঙ্কার করবে না। তোমরা নম্র ও সরল জীবন যাপন করবে ও বাণী প্রচার করতে গিয়ে সকল দুঃখ-কষ্ট সইবে – এই হলো তোমাদের প্রতিজ্ঞা বা ব্রত। তবে অন্ধের মত নয়, তোমরা তা করবে বুঝে শুনে – স্বাধীনভাবে। কারণ “খ্রিস্ট যখন আমাদের স্বাধীন করে দিয়েছেন, তিনি চেয়েছেন, আমরা যেন সত্যি স্বাধীন হয়ে থাকি” (গালা ৫:১)। তোমাদের নিজস্ব চিন্তা, স্বাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছা, পরিকল্পনা বা ধ্যানধারণা তোমার থাকতেই পারে, আর তোমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে তোমরা তা প্রকাশ করতেও পার; কিন্তু তোমার কর্তৃপক্ষ বা বিশপ যদি মণ্ডলির বা ধর্মপ্রদেশের প্রয়োজনে, বৃহত্তর কল্যানের জন্য, এমন কি তোমাদের নিজের মঙ্গলের জন্য অন্যত্র বা অন্যভাবে তোমাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন তাহলেও তোমাকে তা গ্রহণ করতে হবে। আর তা করতে হবে খ্রিস্টের সেই স্বাধীনতা নিয়েই। না হলে আর বাধ্যতার ব্রত কেন? যদি সুযোগ সুবিধা বা আরাম আয়েশ অনুসন্ধান করো তাহলে তো এই জীবন তোমাদের নয়। তোমরা তো খ্রিস্টকেই অনুসরণ করবে বলে এই পথে এসেছ! আর খ্রিস্ট এই জীবন সম্বন্ধে বলেছেন, “কেউ যদি আমার অনুগামী হতে চায়, তবে সে আত্মত্যাগ করুক এবং নিজের ক্রুশ তুলে নিয়ে আমার অনুসরণ করুক” (মথি ১৬:২৪)। মনে রাখ যে যাজকীয় জীবন আসলে ক্রুশ বহনেরই জীবন; কারণ খ্রিষ্টভক্তদের যত্ন ও পরিচালনা করতে গিয়ে, তাদের জীবন ও তাদের অভাব অনটন বা দুঃক-কষ্ট সব কিছু যেন তোমারই হয়ে ওঠে। ভাল কাজ করে কোন মানুষের কাছ থেকে পুরষ্কারের আশা করো না, ঈশ্বরই তোমাদের পুরষ্কার দিবেন (তুলনীয় মথি ৬:১৬…)। তাই “তোমরা বরং সব কিছুর আগে অনুসন্ধান করো স্বর্গরাজ্যের পথ” (মথি ৬:৩৩)। তাছাড়া খ্রিস্ট তো “সেবা পাবার জন্য আসেন নি, এসেছেন সেবা করতে এবং বহু মানুষের মুক্তিপণ হিসাবে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে” (মথি ২০:২৮)।
কৌমার্য ব্রত এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু তোমরা তো তা স্বেচ্ছায় জেনেশুনেই গ্রহণ করেছ! এই ব্রত যে শুধু ‘বিয়ে না করে থাকা’ তা নয়। এই ব্রতের আসল বিষয় হলো সংযম ও শুচিতা; অন্য কথায় নিজের যৌন জীবনকে দমন করা ও অভিষেকের প্রতিজ্ঞা অনুসারে নিজের যৌনতাকের সঠিক পথে রাখা। মনে রেখ যীশুর সেই কথা “যে-কেউ কোন স্ত্রীলেকের দিকে লালসার চোখে তাকায়, সে মনে মনে তার সঙ্গে ব্যভিচার করেই ফেলেছে” (মথি ৫:২৮)। এই জীবনের মর্ম হলো পরিবার ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে বরং গোটা খ্রিস্টমণ্ডলিকেই পরিবারের মত ভালবাসা ও যত্ন নেওয়া। বলতে গেলে খ্রিস্টভক্তরাই তোমাদের বধুর মত, যার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে ও সেবা করতে তোমরা নিযুক্ত হয়েছ। তোমাদের ভালবাসা শুধু কোন এক বিশেষ ব্যক্তির জন্য নয়, বরং তোমাদের ভালবাসা অবারিত সবার জন্য; আর বিশেষভাবে যাদের তা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। খ্রিস্টমণ্ডলিতে সকল সদস্যই এখন তোমাদের ভালবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে – কারণ এই খ্রিস্টমণ্ডলির সাথেই তোমার প্রেমের বন্ধন রচিত হয়েছে সেই তোমাদের অভিষেকের সময়ই। সমাজে যারা অভাবী, দুর্বল, অসহায়, প্রতিবন্ধী, প্রবীন, নির্যাতিত, ইত্যাদি তারাই কিন্তু তোমাদের ভালবাসার প্রধান লক্ষ্য (মথি ২৫:৩৫-৪০)। এই ব্রত তোমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ণ আর এর জন্য তোমাদের প্রতিদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, নিজের প্রলোভন জয় করতে হয়, আর সকল প্রকার অশুভ স্বার্থের বন্ধন থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে পবিত্র জীবন যাপন করতে হয়। এটা প্রতিদিনের সংগ্রাম, একদিনের বা এককালীন নয়। এই বিষয় যদি সতর্ক না থাকো তাহলে তোমাদের অবস্থাও যে কোন সময় পতিত ফাদার প্রদীপ গ্রেগরীর (যাজকপদ রহিত) মতই হতে পারে। ফাদার প্রদীপ অনেক ভাল কাজ করলেও, সে একটি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে পরেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যে একটি কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ও মামলা হয়েছে তা কিন্তু অমূলক নয়। এর দায় সম্পূর্ণ তাঁর নিজের, কারণ তিনি একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক ও দায়িত্বশীল মানুষ। কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হলে তাঁকেই তা দিতে হবে। তাঁর এই অপকর্মের দায় ধর্মপ্রদেশ বা খ্রিস্টমণ্ডলি নিবে না, কারণ মণ্ডলি তাঁকে এই অসৎ কাজ করার জন্য নিয়োগ করেনি। সেই ভিকটিম মেয়েটি ও তার পরিবারের কাছে ইতিমধ্যেই আমি ক্ষমা প্রার্থনা করেছি তাদের প্রতি প্রদীপের এই অন্যায় আচরণের জন্য। এর জন্য তারা মণ্ডলি ও সমাজের সমবেদনা ও সমর্থন পেতে পারে, কারণ তারাও সমাজ ও মণ্ডলির সদস্য। আমরা বিশ্বাস করি সকলেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। আমি বলতে চাই যে প্রদীপ নিজেও হয়তো কখনো ভাবেনি যে তাঁর এই ধরনের পতন হবে, তবে অস্বচ্ছ ও অপরিনামদর্শীভাবে জীবন যাপন করলে এরূপ তো হবেই। সেইজন্য এই ঘটনা থেকে আমরা যেন সকলেই শিক্ষা নিতে পারি আর স্বচ্ছ ও পরিনামদর্শী জীবন যাপন করতে পারি। আমি আশা করি তোমরা আমার কথাটি বুঝতে চেষ্টা করবে।
বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী শিশু সুরক্ষা ও যাজকদের আচরণবিধির একটি নীতিমালা প্রনয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে শিশু কিশোর-কিশোরীদের সাথে যাজকদের আচরণ হতে হবে ভালবাসাপূর্ণ কিন্তু মার্জিত ও স্বচ্ছ। কোন ক্রমেই তাদের যৌন হয়রানি করা যাবে না। এর ব্যাত্যয় হলে সেখানেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও বলা আছে। আমরা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে সেই নীতিমালাই অনুসরণ করি। আর শুধু যৌন জীবন নয়, যাজকদের জন্য যে কোন ধরণের আসক্তির জীবনই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। মদ খেয়ে বা অন্যান্য মাদক গ্রহণ করে নিয়মিত নেশা করাও একটা বড় কলঙ্কময় বিষয় হতে পারে। তাই আমি তোমাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করি তোমরা মানুষের সামনে এই ব্যপারে ভাল দৃষ্টান্ত দিতে চেষ্টা করবে। ইন্টারনেট অতিমাত্রায় ব্যবহারও একটি ক্ষতিকারক আসক্তি যা পুরোহিতদের এড়িয়ে চলতে হবে।
তোমাদের নিজ নিজ পরিবারের (বাবা, মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ইত্যাদি) সঙ্গে ভাল ও দৃষ্টান্তমূলক সম্পর্ক বজায় রাখবে, যা সমাজের সকলের সামনে আদর্শ হয়ে থাকে। তোমাদের নিজেদের পরিবারের সঙ্গে যদি তোমাদের ভাল সম্পর্ক না থাকে আর যদি তোমাদের পরিবারের সদস্যরা সমাজে ভাল দৃষ্টান্ত না হয়, তাহলে তোমাদের যাজক বা পুরোহিত হিসাবে ক্রেডিবিলিটি বা বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায় আশা করি তোমরা তা বুঝতে পার। তোমাদের পরিবারকে তোমরা সেকথা বুঝাবে। তারা যেন তোমাদের কথা ভেবে অন্য ফাদারদের (যাজকদের) সম্মান ও সহযোগিতা করে; প্রয়োজনে তাদের সংশোধন করে। তাছাড়া তোমাদের যেন কোন বিশেষ মানুষ বা বিশেষ পরিবার না থাকে। তোমরা যদি ঘন ঘন একই ব্যক্তি বা একই পরিবারে যাওয়া আসা কর বা খাওয়া দাওয়া কর, তাহলে সেটা মানুষের কাছে দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়। তোমাদের মধ্যে যে খ্রিস্টিয় ভালবাসা রয়েছে, তাতো সকলেরই জন্যই সমান, কারো প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব করে না, “কেন না কারও প্রতি পরমেশ্বরের কোন পক্ষপাতিত্বই নেই” (রোমীয় ২:১১)। পরিবার পরিদর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ পালকীয় কাজ; কিন্তু সেখানে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ পরিবার নয়, বরং সকল মানুষ ও সকল পরিবার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তোমাদের পালকীয় কাজের মধ্যে যেন দরিদ্ররা, আদিবাসীরা, প্রবীনরা, অসুস্থরা, প্রতিবন্ধীরা, সমাজের প্রান্তসীমায় যারা পড়ে আছে তারা, সকলেই যেন বিশেষ ভালবাসার স্থান পায়। যিশু তো তোমাদের এই জন্যই আহ্বান করেছেন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমাদের বলতে চাই, আর সেটা হলো আমরা সকলেই হলাম ”দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক” এই কথাটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। তোমাদের যে সব কিছুর দায়িত্ব দেওয়া হয় – সে ধর্মপল্লী হোক, স্কুল কলেজ হোক, কোন প্রতিষ্ঠান হোক, ভূ-সম্পত্তি হোক – সে সব কিছুর বিশপ হিসেবে আমি বা তোমরা কেউই এগুলোর মালিক নই। এসো আমরা ঈশ্বরেকে ধন্যবাদ দেই যে তিনি আমাদের তাঁর ভালবাসায় অজস্র দান দিয়েছেন। আমাদের যথেষ্ঠ সম্পদ তিনি দিয়েছেন যেন আমরা আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করাতে পারি। তবে তোমরা যে সব ধর্মপল্লী বা প্রতিষ্ঠানে থাক ভালবাসা দিয়ে তার যত্ন কর, কোন অবহেলা করো না। যে ভূ-সম্পত্তি ও অর্থসম্পদ সেখানে রয়েছে তা কিন্তু তোমাদের নিজস্ব নয়, ঈশ্বর এগুলো দিয়েছেন, এগুলোর জাগতিক মালিক খ্রিস্টমণ্ডলি। এগুলোর জন্য কিন্তু তোমাদের জবাবদিহী করতে হবে। এগুলোর বিষয়ে তোমার মনোভাব ও আচরণ তোমার দায়িত্বশীলতার প্রমান দেবে। মণ্ডলি মায়ের মত, তাই তোমাদের কিছু দয়ার কাজ করে মণ্ডলির সেই মাতৃরূপ ফুটিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু তাই বলে ধর্মপ্রদেশের অর্থসম্পদ বা ভূ-সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে, মণ্ডলির ভবিষ্যৎ ধ্বংশ করে তোমরা যদি সস্তা জনপ্রিয়তা খোঁজো, তাহলে সেটা কিন্তু আর দয়ার কাজ হয় না। সেটা হয় দায়িত্বহীন আচরণ, অন্যদের কাছে সঠতা ও নিজের কাছে প্রবঞ্চনা। খ্রিস্টমণ্ডলির সম্পত্তি তোমরা অপব্যবহার করতে পার না, সেই অধিকার বা দায়িত্ব তোমাদের দেওয়া হয় নাই। ধর্মপ্রদেশের যাজক বা পুরোহিত হয়ে তোমরা দায়িত্বহীন মানুষ হবে এটা কেউ আশা করবে না; ঈশ্বরও তা চাইবেন না।
বুঝতেই পারছো যে যাজকের জীবন অনেক কঠিন ও দায়িত্বশীল। তোমাদেরকে শুধু খ্রিস্টানরা নয়, বরং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই সম্মান করে ও মর্যাদা দেয়; ভালও বাসে। সেই সম্মান, মর্যাদা, ভালবাসা, প্রভৃতি রক্ষা করা মানে খ্রিস্টমণ্ডলির প্রতি মানুষের সম্মান ও ভালবাসা রক্ষা করা। তোমরা খ্রিস্টের প্রতিনিধি, তাই তোমরাই তোমাদের কথাবার্তা ও জীবনাচরণ দ্বারা খ্রিস্টের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে। মনে রাখবে তোমাদের আচরণের কারণে যখন খ্রিস্টভক্তরা মণ্ডলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে বা তারা গীর্জা উপাসনায় যোগদান না করে দূরে সরে যাবে। এসবের জন্যও কিন্তু ঈশ্বর তোমাদের দায়ী করবেন। তাই তোমরা সাবধান থাকো যেন তোমাদের স্খলন না হয়। সর্বদা নিয়মিত “প্রার্থনা করো যেন প্রলোভনে না পড়ো” (মথি ২৬:৪১; মার্ক ১৪:৩৮)। কোন কারণেই প্রার্থনা ও উপাসনার রুটিনটি অবহেলা করবে না। তোমরা মানুষকে দেখাবার জন্য প্রার্থনা করবে না, কিন্তু তোমাদের যেন খ্রিস্টভক্তরা প্রার্থনা করতে দেখে। তোমরা মনে রাখবে যে খ্রিস্টভক্তরা তোমাদের আধ্যাত্মিক জীবন, তোমাদের প্রার্থনা ও ত্যাগস্বকিার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রার্থনা ও উপাসনায় যোগদান করবে – এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের একাকিত্বকে জয় করার জন্য তোমাদের সঙ্গী যাজক ভাইদের সাথে তোমাদের সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ধর্মপল্লীতে যাজকগণ তোমরা প্রতিদিন একসঙ্গে প্রার্থনা করবে আর খাওয়া দাওয়া করবে; কখনো তা অবহেরা করবে না। কোন মনোমালিন্য যেন তোমাদের সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে স্বার্থপর না হয়ে ভাই পুরোহিতের জন্য তোমাদের হৃদয় উন্মুক্ত রাখ – ক্ষমা করো আর ভাই পুরোহিতকে অন্তরে গ্রহণ করো। তোমরা অনেক শান্তি পাবে আর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি পাবে। এ সবের দ্বারা সকল পাপ কলঙ্ক ও বিপদ – আপদ জয় করতে পারবে। ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে থাকবেন, আর যিশু তোমাদের সত্যের পথ দেখাবেন। সেই সত্যই তোমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীন করে তুলবে (যোহন ৮:৩২) আর সকল প্রকার পাপের বন্ধন থেকে তোমরা মুক্তি পাবে। আমি তোমাদের জন্য ঈশ্বরের সেইআশীর্বাদ ও অনুগ্রহই প্রার্থনা করি। প্রভু যিশু খ্রিস্টের আনন্দ ও শান্তি সর্বদা তোমাদের অন্তরে বিরাজ করুক।
ইতি
তোমাদেরই ভাই ও বন্ধু
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ