ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী।
আগমনকালীন দীপাচক্র সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিলো ষোড়ষ শতাব্দিতে ইউরোপের জার্মান দেশে। সে দেশের গরিবদের জন্য পরিচালিত একটি স্কুলের ছাত্ররা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতো, বড়দিন কবে আসবে। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের শিক্ষক যোহান হিন্রিস উইচের্ন ছাত্রদের মুখে জবাব না দিয়ে কাঠ দিয়ে বড় একটা চাকা তৈরি করলেন। সেই চাকার চারিদিকে মি. উইচের্ন চারটি বড় ও সাদা মোমবাতি বসালেন এবং সেই সঙ্গে যুক্ত করলেন আরো ২০টি ছোটো আকারের লাল মোমবাতি। প্রতিদিন একটি ক’রে লাল মোমবাতি জ্বালানো হতো এবং রবিবারদিনে জ্বালানো হতো একটি ক’রে সাদা বড় মোমবাতি। কোনো কোনো অঞ্চলে চারটি সাদা বড় মোমবাতির মাঝখানে আরো একটি বড় মোমবাতি রাখা হতো- যেটি ছিলো যিশুর জন্মের প্রতীক। এই মাঝখানের বাতিটি জ্বালানো হতো ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে অর্থাৎ বড়দিনে। ক্যাথলিক চার্চে এই আগমানকালীন দীপাচক্র শুরু হয় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। অন্যদিকে আমেরিকান-জার্মানরা এই ঐতিহ্য উত্তর আমেরিকাতে শুরু করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। প্রদীপ শিখার আসল অর্থ ছিলো, “তাঁর মধ্যে ছিল জীবন, সেই জীবন ছিল মানুষের আলো। অন্ধকারে সেই আলোর উদ্ভাস, অন্ধকার তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি (যোহন ১:৪-৫)।”।
আগমনকালীন দীপাচক্র হলো, ঈশ্বরের অফুরন্ত ভালোবাসার প্রতীক। চক্রের চারিদিকটা মোড়ানো থাকে চিরসবুজ পাতা-লতা দিয়ে যার প্রতীক হলো, খ্রিস্টকর্তৃক আনীত অনন্ত জীবন। চক্রে স্থাপিত বাতিগুলোর বিভিন্ন অর্থ থাকলেও সাধারণ অর্থ হলো “খ্রিস্ট জন্মের মধ্যদিয়ে পৃথিবীতে ঈশ্বরের আলোর প্রবেশ।” চারটি বড় ও সাদা মোমবাতির প্রাচীন ব্যাখ্যা ছিলো এই রকম। প্রথমটি হলো বেগুনী রং- মুক্তিদাতার আগমন সম্পর্কে প্রবক্তাদের ঘোষণা। দ্বিতীয়টি হলো বেগুনী রং- বেৎলেহেম নগরের উদ্দেশ্যে যোসেফ ও মারীয়ার যাত্রা। তৃতীয়টি হলো গোলাপি রং- প্রান্তরের রাখালদের জয়োল্লাস এবং চতুর্থটি হলো বেগুনী রং- স্বর্গ দূতবাহিনীর শান্তির ঘোষণা। যুক্তরাজ্যের প্রোটেস্টান্ট মন্ডলিতে দীপাচক্রে চারটি লাল রংয়ের মোমবাতি, বড়দিনের সাজস্বজ্জা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পোপ ১৬তম বেনেডিক্ট নিজেও এই চারটি লাল রংয়ের বাতি ব্যবহার করেছেন। অতি সম্প্রতি ইস্টার্ন অর্থডোক্স মন্ডলিভূক্ত কিছু পরিবার মোট ছয়টি বাতি ব্যবহার করছেন- যার অর্থ হলো বড়দিনের উপবাস পালন। যুক্তরাজ্যের নতুন পাঠ পঞ্জিকা অনুসারে- প্রতিটি বাতি যিশুর আগমন বার্তা দিলেও বিশেষ অর্থে তারা তা ব্যাখ্যা দিতো। প্রথমটি- ঈশ্বর জনগণের আশা। দ্বিতীয়টি- প্রাচীন সন্ধির প্রবক্তগণ। তৃতীয়টি- দীক্ষগুরু যোহন এবং চতুর্থটি- খ্রিস্টের মাতা মারীয়া।
অনেক প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে উপাসনা বিষয়ক জনপ্রিয় রং হলো বেগুনী এবং গোলাপী। বিশেষ ক’রে প্রথম তিন সপ্তাহে খ্রিস্টযাগের সময় যাজকগণ বেগুনী রংএর কাপড় ব্যবহার করেন। বেগুনী হলো অনুতাপের চিহ্ন। আর গোলাপি হলো অনুতাপের পর উৎসবের রং। ক্যাথলিক চার্চের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে জানা যায় যে, চারটি বাতি, চার সপ্তাহের প্রতি সপ্তাহকে ধরা হয় ১০০০ বছর। সেই হিসেবে চার সপ্তাহ মিলে হলো ৪০০০ হাজার বছর। অর্থাৎ প্রতীক হিসেবে আদমের সময় থেকে চার হাজার বছর পর যিশুখ্রিস্টের জন্ম পযর্ন্ত।
আগমনকালীন দীপাচক্র চিরসবুজ পাতা-লতা গোলাকৃতি চাকার চারিদিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হতো। এটাকে বুঝানো হতো জড় শীতকাল থেকে নব বসন্তকালের দিকে যাত্র। এর আধ্যাক্তিক প্রতীক হলো- যিশুখ্রিস্টের ত্যাগস্বীকারের মধ্যদিয়ে মানুষের অনন্ত জীবনে প্রবেশ। যেমন মঙ্গলসমাচারে সাধু যোহন লিখেছেন, “পরমেশ্বর জগৎকে এতই ভালবেসেছেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে দান ক’রে দিয়েছে, যাতে যে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে, তার যেন বিনাশ না হয়, বরং সে যেন লাভ করে শ্বাশত জীবন (৩:১৬)।”
প্রাচীনকালে খ্রিস্টিয় আগমনকালীন প্রার্থনা পুস্তকের অধ্যায়ে একটি চমৎকার আগমনকালীন পারিবারিক প্রার্থনার উল্লেখ রয়েছে। যেখানে দেখানো হয়েছে যে, পরিবারে রবিবারদিন নতুন প্রদীপ জ্বালাবার সময় পিতা-মাতা ও সন্তানগণ একসঙ্গে প্রার্থনা করতেন।

পিতামাতা ঃ হে প্রভু, তুমি জগতের আলো।
সন্তানগন ঃ এসো, এসো প্রভু, আমাদের সহায় হও।
পিতামাতা ঃ হে স্বগীয় পিতা, অনাদিকাল থেকে আমরা তোমার মুক্তি-কর্মের অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের এমন অন্তর দান করো যেনো, তুমি যে সবকিছু পুনরায় সুন্দর ও নবীন ক’রে তুলবে, তোমার সেই উজ্জ্বলতা উপলব্দি ক’রে নব আশা নিয়ে জীবন যাপন করতে পারি।
সন্তানগন ঃ এসো, এসো প্রভু, আমাদের সহায় হও।
পিতামাতা ঃ যেনো তোমার আলো এবং ভালোবাস আমাদের হৃদয়-মন আলোকিত করে এবং যেনো আমাদের আশেপাশে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যেও আশা ও শান্তি বিস্তারলাভ করে।
সন্তানগণ ঃ আমেন।
এই প্রার্থনা থেকে একটা বিষয় জানা যায় যে, আগমনকালীন দীপাচক্র শুধুমাত্র গির্জায় ব্যবহারের কোনো ঐতিহ্য নয়- এটি একটি পারিবারিক ঐতিহ্যও।
আগমনকাল হলো আশায় আশান্নিত থাকার সময়কাল। এই আশান্নিত হলো মর্তে যিশুর আগমনকে ঘিরে। প্রাচীনকালের প্রবক্তাদের বাণীতে বিশ্বাস ক’রে ঈশ্বরভক্তগণ শতাব্দিকাল ধ’রে মুক্তিদাতার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রচীনকালের প্রচলিত ঐতিহ্য থেকে জানা যায় যে, ঈশ্বরভক্তরা মনে করতেন, মশীহ জন্ম নিবেন কোনো পর্বতে- কারণ তিনি হবেন মহা শক্তিধর। কেউ আবার মনে করতেন- তিনি হবেন মহাযাজক তাই পর্বতে নয় জন্ম নিবেন কোনো মন্দিরে। আবার কেউ কেউ মনে করতেন- তিনি তো হবেন রাজাধিরাজ, তাই জন্ম নিবেন কোনো রাজ প্রাসাদে। কোনো এক ভোরে শোনা যাবে রাজ প্রাসাদ থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি, আর ভক্তগণ ছুটে যাবেন প্রণাম জানাতে। কিন্তু মানুষের চিন্তা আর ঈশ্বরের কাজ এক নয়। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে- আগমন শুধু যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগমনকাল নয়। আসল অপেক্ষা হলো যিশুখ্রিস্ট পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন মানুষের বিচার করা জন্য। আমরা স্মরণ করি তাঁর দ্বিতীয় আগমন। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: