ফাদার সুনীল রোজারিও। রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন নিবো কি নিবো না, এই নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিধায় ছিলাম। করোনা ভাইরাস অতিমারির মতো টিকাও অনেকের মধ্যে আতংক তৈরি করেছে। কোভিড- ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসলাম, ভ্যাকসিন নিয়ে আবার কোন বিপদেই না পরি- তাই সন্দেহ ছিলো। এই মহামারি রোগ থেকে একবার সুস্থ হলে শরীরে নাকি এ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই এ্যান্টিবডি কতোদিন বহাল থাকবে- তা নিয়েও বহু রকমের খবর শুনতে পাওয়া যায়। কেউ বলেন চয় মাস, আবার কেউ বলেন তিন মাস। এইসব সময় অসময় ও হের ফের নিয়ে বহুদিন ধরে হতাশা ও দ্বিধা পিছু লেগেই ছিলো। যখন দেখলাম যে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ টিকা নিচ্ছেন, তখন আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম।
মেডিক্যাল হাসপাতালে ঢুকতেই পরিবর্তন চোখে পড়লো। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে নার্স ডাক্তারগণ যার যার দায়িত্বে হাজির। এটা বাংলাদেশে ভাবা যায় ? সবদিকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গোছানো, যা কোনোকালেই দেখেনি। যেখানে রোগী কোলে নিয়ে অভিভাবকগণ ঘন্টার পর ঘন্টার বসে থাকেন- কিন্তু নার্স, ডাক্তারের হদিস মেলেনা, টিকা কেন্দ্রে সেখানে সবাই ব্যস্ত, কর্ম চাঞ্চল্য, হাসি-খুশি। সব মিলে উন্নত উৎসব পরিবেশ। সবাই যার যার দায়িত্বে ব্যস্ত। খুব ভালো লাগলো। দেশের মেডিক্যালগুলো এমনই হওয়ার কথা। সব দেখে শুনে টিকা নেওয়ার ইচ্ছাটা আরো প্রবল হলো। এর আগে বহুবার ইনজেকশন নিয়েছি। ক’দিন আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও ইনজেকশন নিয়েছি। সুই দেখলে আগে থেকেই ঈশ্বরের নামজপ শুরু করে দিতাম। কিন্তু সেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ইনজেকশন নিতে গিয়ে বুঝতেই পারলাম না ভ্যাকসিন কিভাবে পুশ করা হলো। কোনো ব্যাথা নেই, জ্বালা নেই। দ্বিতীয় ডোজ কোনদিন নিতে হবে ফরমের সটিক কলামে লিখে দিলেন। নার্স, ডাক্তারদের এটা সেটা জিজ্ঞেস করলাম, তারা জানামতে সব উত্তর দিলেন। । বিদায় জানাতে নার্স, ডাক্তরগণ রাস্তা পযর্ন্ত এগিয়ে এলন। টিকা নেওয়ার পর তাও বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো কেউ এযাবৎ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগ করেননি। আমরা দলে ছিলাম মোট আটজন। আত্মবিশ্বাস নিয়েই ঘরে ফিরে গেলাম।
করোনা ভাইরাসের কোভিড- ১৯ টিকা পর্যায়ক্রমে এবং আপাততঃ ১৮ বছরের উর্ধ্বে যাদের বয়স, তাদের সবাইকে নিতে হবে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেওয়া হবে। আমার মনে হয় স্ব-ইচ্ছায় টিকা না নিলে এক সময় প্রশাসন বাধ্য করবেন বা আইনী ব্যবস্থাও নিতে পারেন। কারণ এই সমস্যাটি একটি জাতীয় এবং সর্বজনীন সমস্যা। এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে মাগ্না, কিন্তু আমার মনে হয় একটা সময় আসবে যখন টিকা কিনতে হবে। মাগ্না হোক বা কিনতে হোক, আমি মনে করি নিজের স্বার্থে এবং জাতীয় বা সর্বজনীন স্বার্থে সবাইকে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অবহেলার কোনো সুযোগ থাকবে না, আর ভ্যাকসিন না নেওয়ারও কোনো বিকল্প নেই।
কোভিড- ১৯ টিকা নিয়ে গুজবের শেষ নেই। এইসব গুজবের কিছু আছে উসকানিমূলক বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আবার কিছু গুজব রটে মোড়ের চায়ের স্টল থেকে- যেগুলো অবৈজ্ঞানিক, ভিত্তিহীন। কিছু লোক কাজ করে না- সময় কাটে চায়ের দোকানে। ভাবখানা, এরা যেনো মহাপন্ডিত। বিশ্বের তাবৎ খবর জানা আছে। মানে খবর রাখে না কিন্তু খবর তৈরি করে। “কোভিশিল্ড” নামে যে টিকাটি বাংলাদেশে মানুষের দেহে প্রয়োগ করা হচ্ছে এটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি- অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোভিশিল্ডের ফর্মুলা তৈরি করেছে। অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্যে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ফর্মুলা অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, কোভিশিল্ড নামে টিকা তৈরির কাজটি করে যাচ্ছে মাত্র। সে হিসেবে টিকার আবিস্কারক কিন্তু ভারত নয়- শুধু ফর্মুলা অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, বিশ্বের মধ্যে সচেয়ে বৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতের পুনে নামক প্রাচীন শহরে অবস্থিত। বর্তমানে এই সেরাম প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মি. আদর পুনেওয়ালা। ড. সাইরুস পুনেওয়ালা ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে এই ভ্যাকসিন উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো- ভারত সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকার ভ্যাকসিন আমদানিতে যে পরিমান অর্থ ব্যয় করেন- তা কমিয়ে আনা। ড. পুনেওয়ালা তাঁর উদ্দেশ্য সফল করে তুলেছিলেন। বৃহৎ ভারত ভূ-খন্ডের সমস্ত প্রয়োজন মিটানোর পরও পাশাপাশি বিশ্বের ১৭০টি দেশের ৬৫ শতাংশ শিশু সেরামের উৎপাদিত কমপক্ষে একটি ভ্যাকসিন নিয়ে থাকে। সেরাম ইনস্টিটিউট এতোই আধুনিক যে, প্রতি মিনিটে ৫০০ কন্টেইনার তৈরি করতে সক্ষম- এবং সেরামের এই ক্ষমতা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। এখানে উল্লেখ্য যে, সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিলো রেসিং ঘোড়ার ফার্ম হিসেবে। অবসরপ্রাপ্ত রেসিং ঘোড়ার রক্তের উপাদান নিয়ে টিটিনাস ভ্যাকসিন এবং সাপে কাটা রোগীর জন্য এ্যান্টিভেনোম তৈরি করতো।
বিশ্বের করোনা ভাইরাস মহামারির ভয়ংকররূপ বিবেচনা করে তড়িৎ গতিতে মোকাবেলার জন্য নানা দেশের নানা কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। বাংলাদেশে এখনোও পযর্ন্ত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি- অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোভিশিল্ডের ফর্মুলায় তৈরি। এখনোও পযর্ন্ত উদ্ভাবিত সব টিকা আরোও উন্নত হবে- বিজ্ঞানিদের সেই আশা। তবে সরকারের পরামর্শ হলো- যারা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছেন- তার অর্থ এই নয় যে, তাকে আর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে না। টিকা নেওয়ার পরেও পুরো স্বাস্থ্য বিধি মানতে হবে- যতোদিন পযর্ন্ত গোটা বিশ্বে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে না আসে। সবাই হাসি-খুশি-মনে ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সরকারের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।