গত ১৫ মার্চ ২০২১ খ্রি: ভাটিকানের “বিশ্বাসতত্ত্ব বিষয়ক পুণ্য দপ্তর” (Office of the Doctrine of Faith) এক ঘোষণায় বলেছে যে কোন কাথলিক পুরোহিত বা অন্য কোন কাথলিক মিনিষ্টার সম-লিঙ্গের কোন বিবাহ আশীর্বাদ করতে পারবে না। বর্তমানে জার্মানী, বেলজিয়াম ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা দেশে সমলিঙ্গের নারী অথবা পুরুষের যুগল-বন্দী জীবন সরকারীভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। অনেক মানুষের মধ্যেও এই ধরনের মিলন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। সেইজন্য উল্লেখিত দেশসমূহে অনেক কাথলিক যাজক এই সমলিঙ্গের বিবাহ আশীর্বাদ করতে আরম্ভ করেছেন। বিশেষভাবে পোপ ফ্রান্সিস দুইবছর আগে যখন এই সমলিঙ্গের বিবাহ সম্পর্কে বলেছেন “তাদের বিচার করার আমি কি? ঈশ্বরই তাদের বিচার করবেন”, তারপর থেকেই এই প্রবনতা দেখা দিয়েছে। এমনকি তারা সকল বিশপগণকে এই ধরণের সমকামী বৈবাহিক মিলন সমর্থন বা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আহ্বান জানিয়েছে। ভাটিকানের বিশ্বাসতত্ত্ব বিষয়ক দপ্তরের এই বিবৃতিটি তারই প্রতিক্রিয়া। বেশ কিছু ধর্মপ্রদেশ থেকে এই বিষয় জানতে বা পরিষ্কার হতে অফিসিয়াল চিঠিও পাঠানো হয়েছে। তাতে এই পুণ্য দপ্তরের উত্তর হলো “নেতিবাচক”। অর্থাৎ কাথলিক মণ্ডলি কোন পাপের কাজ সমর্থন করে না। জানানো হয়েছে যে পোপ ফ্রান্সিসও এতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। কাথলিক মণ্ডলিতে বিবাহ একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে সম্পন্ন হয় এবং তা কাথলিক মণ্ডলির নিয়ম অনুসারে সম্পন্ন হলে তা হয় একটি সাক্রামেন্ত। এই কারণে এই সাক্রামেন্তীয় মিলন সমলিঙ্গের দম্পতিদের প্রদান করা সম্ভব নয়। জার্মানীর অন্তত দুইজন বিশপ সমলিঙ্গের ব্যক্তিদের এই বৈবাহিক মিলনকে কোনভাবে পালকীয় আশীর্বাদ প্রদান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ভাটিকানের এই বিবৃতির পর তা আর সম্ভব নয়। কাথলিক মণ্ডলির শিক্ষা অনুসারে “আমুদে স্বভাব বা আচরণ” (Gay tendency or orientation) বা সমকামী প্রবণতা কোন পাপের নয়; কিন্তু “সমকামী কাজ” অবশ্যই প্রাকৃতিক নিয়ম ও ঐশরিক নিয়মের পরিপন্থী আর পাপ। কিছু মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা পারিপার্শিক অন্য কোন কারণে সমকামী প্রবণতা বা আচরণ পেতে পারে, কিন্তু তা প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে সঠিক নয়, বরং এটি একটি ব্যাধি (Disorder)। কারণ পৃথিবীর কোন জীব জন্তু বা পশুপাখীই এই সমলিঙ্গের মিলন করে না; আর তা উৎপাদনশীলও নয় – অর্থাৎ এরূপ মিলন কোন সন্তান জন্ম দেয় না। বৈবাহিক মিলনের দু’টি উদ্দেশ্য রয়েছে: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শর্তহীন ভালবাসা ও সন্তান জন্মদানের জন্য উন্মুক্ততা। সমকামী ব্যক্তিদের মধ্যে তা সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে ভালবাসা বা প্রেম থাকলেও তা সন্তান জন্মদান করতে পারে না। তথাপি তারাও মানব ব্যক্তি আর এই কারণে কিছু নারী ও পুরুষের সমকামী প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকেও সম্মান করতে হবে, ও মানবীয় মর্যাদা দিতে হবে। তাদের সকল প্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকারও তাদের দিতে হবে। তাদের জীবন ধারণের জন্য যা দরকার তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা উচিত। পোপ ফ্রান্সিস তাদের জন্য এক প্রকার রাষ্ট্রীয় বন্ধন (Civil Union) সমর্থন করেছেন যেন তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
ভাটিকানের এই বিবৃতি প্রকাশের পর কাথলিক মণ্ডলির ভিতর ও বাহির থেকে বিভিন্ন প্রকার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অনেক লেখা লেখি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটাকে ভাটিকানের দ্বিমুখী আচরণ বা দ্বিচারিতা বলে সমালোচনা করছে বা করছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত মার্কিন গায়ক এলটন জন। তিনি একজন কাথলিক এবং সমকামী। তাঁর সঙ্গীর নাম ডেভিড। তিনি বলেছেন যে ভাটিকান ভন্ডামী করছে। তাঁর যুক্তি হলো যে তাঁর জীবনের উপর নির্মিত “রকেটম্যান” নামক একটি চলচিত্রে ভাটিকান পূজি বিনিয়োগ করেছে ব্যবসার জন্য। সেখানে তাঁর সমকামী সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। অথচ এখন ভাটিকান সমকামী বিবাহ আর্শীবাদ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আসল কথা হলো ভাটিকান সরাসরি এই চলচিত্রে টাকা বিনিয়োগ করেনি। বরং যে ব্যাংকে ভাটিকান টাকা জমা রাখে সেই ব্যংক থেকে এই সিনেমার প্রযোজক তাঁর ছবি নির্মানের জন্য ঋণ নিয়েছেন। এইসব ব্যাংক অস্ত্র নির্মান কারখানার জন্যও ঋণ দিয়ে থাকে যদিও ভাটিকান বা কাথিলিক মণ্ডলি জীবন ধ্বংশের পক্ষে কোন ক্রমেই অবস্থান নিতে পারে না। কাথলিক মণ্ডলি নৈতিকভাবে এই সব সমর্থন না করলেও এইসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
আবার কেউ কেউ এই যুক্তি দিয়েছে যে ঈশ্বর সকলকেই ভালবাসেন ও ক্ষমা করেন। তিনি পাপীকেও ভালবাসেন একথা সত্য। কিন্তু কাথলিক মণ্ডলি এই কথার সঙ্গে এটাও শিক্ষা দেয় ঈশ্বর কিন্তু কারো পাপ সমর্থন করেন না। ঈশ্বর সব সময়ই চান যেন পাপী তার পাপ থেকে মন ফিরান। ঈশ্বরের যেমন সমকামী পুরুষ ও নারী সকলকেই ভালবাসেন কিন্তু তাদের সমকামী কাজকে সমর্থন করেন না, তেমনিভাবে কাথলিক মণ্ডলিও সমকামীদের প্রতি সংবেদনশীল ও তাদের সম্মান করে কিন্তু তাদের সমকানী কাজ সর্মথন করে না। “পরমেশ্বর প্রেমস্বরূপ। ভালবাসায় যার আবাস, সে বাস করে পরমেশ্বরের আশ্রয়ে আর পরমেশ্বর-ও তার অন্তরে বাস করেন। আমাদের অন্তরে ভালবাসার পূর্ণতা এতেই প্রকাশ পায়, সেই বিচারের দিনে আমরা নির্ভয়ে থাকতে পারব; …” (১ যোহন ৪: ১৬-১৭)। সাধু যোহনের এই কথার উপর জোর দিয়ে কেউ কেউ বলে যে ‘ভালবাসা তো ভালবাসাই’। তাদের মতে ‘যেখানে ভালবাসা আছে, সেখানে ঈশ্বর আছেন’ আর আমুদে সমকামীরা তো পরস্পরকে ভালবাসে। সুতরাং তাদের মিলন বন্ধনেও ঈশ্বর আছেন। যদি তাই হয়, তাহলে যারা অন্যান্য পাপ কাজ করে, অথচ তাদের জীবনে মানুষের প্রতি প্রেম ভালবাসা প্রকাশ করে, তাদেরও তো সেইসব পাপ কাজ করার অধিকার বা সুযোগ থাকবে। কেউ পরিবারকে ভালবাসে বলে তাদের ভরণ পোষণ করতে চুরি করতে বা ঘুষ গ্রহন করতে পারে না। এইভাবে সামাজিক বা ধর্মীয় নৈতিকতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যাদের ‘আমুদে স্বভাব’ বা সমকামী প্রবণতা রয়েছে তাদের উচিত তাদের এই ব্যাধির নিরাময়তা অনুসন্ধান করা অনৈতিক জীবনে বা পাপের মধ্যে থাকার অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য অধিকার দাবী করা নয়।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ