‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ কবি জীবনানন্দের এ কবিতার সাথে সঙ্গতি রেখে বলতে ইচ্ছে হয়, ভাওয়াল অঞ্চলের অভিবাসী খ্রিস্টভক্তগণ, বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার খ্রিস্টভক্তগণ, যেন শত বছর পারি দিয়ে ছুটে চলেছে হাজার বছরের পানে। তবে তাদের এ ছুটে চলার মধ্যে রয়েছে উন্নত জীবন গড়ার বা ভবিষ্যত গড়ার তাগিদ। গত ২৭-২৮ মে ২০২১ খ্রি: মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসন শতবর্ষ (১৯২০-২০২০) পূর্তি উৎসব উদ্যাপন তারই এক জীবন্ত সাক্ষ্য বহণ করছে। এ উৎসবটি আনন্দঘন করে সাফল্য মণ্ডিত করার জন্য উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ডিডি। কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মি: সেবাষ্টিন রোজারিও, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফা: পল গমেজ, ধর্মপ্রদেশের কর্মরত ও স্থানীয় ধর্মপল্লীর কৃতি সন্তানসহ ৩২ জন ফাদার, ১৫ জন সিস্টার, রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক মিঃ সুক্লেশ জর্জ কস্তাসহ প্রায় হাজারো খ্রিস্টভক্ত।
শতবর্ষকে, শত স্মৃতি বেধে রাখার জন্য নেওয়া হয়েছিল দু’দিনের বিশেষ কর্মসুচী। আধ্যত্মিক প্রস্তুতির চিহ্নস্বরূপ তৈরী করা হয়েছিল শতবর্ষের জুবিলী ক্রুশ। সেই ক্রুশ প্রতিটি গ্রাম ঘুরে ঘুরে জানিয়ে দিয়েছে অভিবাসী হিসেবে তারা একাই পথ চলছে না, বরং তাদের সঙ্গে পথ চলছে স্বয়ং মুক্তদাতা খ্রিস্ট। ২৭ মে, পলু শিকারীর বীরোত্তম যাত্রার কথা স্মরণ করে লাউতিয়া গ্রামে যেখানে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন; সেখানে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন সেই গ্রামেরই কৃতি সন্তান ফাদার সুজন গমেজ। বিকাল ৫টার সময় শতবর্ষের শত আশীবার্দের কথা স্মরণ করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা নিবেদনের নিমিত্তে করা হয় পবিত্র ঘন্টা। এর পরে চলেছে শত বছেরের শত স্মৃতিগুলো ফিরে দেখা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান। ২৮ মে সকাল থেকেই সাজ-সাজ রবে সমবেত হতে শুরু করে উৎসবমুখর খ্রিস্টভক্তরা। সকাল ৯টার সময় শুরু হয় শতবর্ষের পূর্তি উৎসবের খ্রিস্টযাগ। খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরতিহ্য করেন বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তিনি তারঁ উপদেশে বলেন, উত্তর বঙ্গে বাওয়াল খ্রিস্টবিশ^াসীদের অভিবাসন আমাদের জন্য একটা ইতিবাস বা ঐশ পরিকল্পনা। ঈশ্বর নিজেই এই ইতিহাসের রচয়িতা। বাইবেলেও আমরা দেখি যে, আদম হবা থেকে শুরু করে ইস্রায়েল জাতি মিশর দেশ থেকে অভিবাসী হয়েছিলেন প্রতিশ্রুত কানান দেশে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও অভিবাসিত হয়ে সেই ভাওয়াল অঞ্চল থেকে অত্র একালায় এসেছিলো সার্বিক মানব মুক্তির তাড়নায়। তাই দেখি ভাওয়ালের সেই শিক্ষা-দীক্ষা ও খ্রিস্টের মূল্যবোধ ও শিক্ষা ও ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে হাজির হয়েছিলো। তাই এই শতবর্ষ হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবার সময়। খ্রিস্টযাগের পর পরই শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যা সাজানো হয়েছিল ভাওয়ালের বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে। সেই সাথে ভাওয়াল অভিবাসনের অগ্রপথিক পলু শিকারী উপর ভিত্তি করে অভিনয় এবং ধর্মপল্লীর প্রতিপালিকা সাধ্বী রীতার জীবনীর উপর নির্মিত অভিনয়।
উত্তরবঙ্গে ভাওয়ালবাসীদের আগমন ও অভিবাসনের শতবর্ষের পূর্তি উৎসবের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বিশপ মহোদয় আরো বলেন, এটি সত্যিই এক আনন্দময় অনুভূতি ও ঐতিহাসিক ঘটনা। উত্তরবঙ্গে ভাওয়ালবাসীদের আগমন ও অভিবাসনের শতবর্ষ পূর্তির মহোৎসব আরো ঘটা করে উদ্যাপন করার পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য এ উৎসব সময় মতো সেভাবে উদ্যাপন করা সম্ভব হয়নি। শতবর্ষ পূর্বে সেই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মথুরাপুরের উথুলী গ্রামে ব্যাপ্টিষ্ট পালকের নিমন্ত্রণে ভাওয়াল থেকে পলু শিকারীর আগমনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে ভাওয়ালবাসীদের অভিবাসনের যাত্রা শুরু হয়। গত শতাব্দির ৭০ দশক পর্যন্ত এ অভিবাসনের যাত্রা চলমান থাকে। পরবর্তীতে দরিদ্রতা ও নানা অভাব-অনটন থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় ভাওয়াল খ্রিস্টানুসারীগণ উত্তরবঙ্গের পাবনা ও নাটোর জেলায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে এবং পালকীয় সেবাদানের সুবিধার্থে এ অঞ্চলে গড়ে উঠে মথুরাপুর, বোর্ণী, বনপাড়া, ফৈলজনা, গোপালপুর, গুল্টা, নাটোর ও ভবানীপুর ধর্মপল্লী। ধর্মপল্লী, বিদ্যালয়, ডিসপেনসারী ও সেলাই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে দেশী-বিদেশী মিশনারী ফাদার-সিস্টারগণ তাদের পালকীয় সেবা-দান করা শুরু করেন। শত বৎসরের স্মরণ উৎসব উদ্যাপনকে ঘিরে একটি স্মৃতি বিজড়িত চিহ্ন হিসেবে ‘শতবর্ষের অনুগ্রহ’ নামক স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই স্মরণিকাটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি দলিল হিসেবে আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে সমাদৃত হবে বলে প্রত্যাশা করি। খ্রিস্টযাগের পর শতবর্ষের অনুগ্রহ সাধ্বী রীতা’র স্মারক আশীর্বাদ করেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ মহোদয়।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফাঃ পল গমেজ তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন- ভাওয়াল খ্রিস্টানদের নিজস্ব কৃষ্টি বা লোকাচার রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের জীবনও দৃঢ়। কয়েকশত যাজক ও অর্ধ হাজার ধর্মব্রতী রয়েছে ভাওয়াল এলাকা থেকে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রেডিট ইউনিয়ন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসহ অনেক ক্লাব-সংঘ-সমিতি গড়ে উঠেছে। আর এর পেছনে একটি উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। খ্রিস্টিয় লোকাচারের মধ্যে পালাগান, কষ্টের গান, ধর্মীয় যাত্রা-নাটক, সাধু আন্তনীর পালাগান, কীর্তন ও বৈঠকী গানের প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও খাদ্য, পর্বাদি, বিয়ে-সাদির নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি রয়েছে। খ্রিস্টবিশ্বাস ও সামাজিকতার প্রকাশ ঘটে ভাওয়াল সংস্কৃতির মাধ্যমে।
মথুরাপুর ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাঃ দিলীপ এস.কস্তা তার বক্তব্যে বলেন যে, উত্তর বঙ্গে ভাওয়াল খ্রিষ্টান অভিবাসনের দ্বার হলো মথুরাপুর ধর্মপল্লী এবং দক্ষিণ ভিকারিয়ার প্রথম ধর্মপল্লী মথুরাপুর। পল গমেজ যিনি পলু শিকারী নামে সমধিক পরিচিত তিনি বন্য শুকর শিকারের উদ্দেশ্যেই ঢাকার ভাওয়াল এলাকার নাগরী ধর্মপল্লীর বাগদী গ্রাম থেকে চাটমোহরে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে লাউতিয়া গ্রামে বসতি গড়েন। তাঁরই পথ ধরে আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য খ্রিস্টভক্ত বড়াল নদ ও চলন বিলের পাড়ে বসতি গড়ে তোলেন। পলু শিকারীর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ ও কষ্টস্বীকারের সার্বিক দিক বিবেচনা করে তাঁকে উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসনের অগ্রপথিক বলা যায়।
রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক মিঃ সুক্লেশ জর্জ কস্তা শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, শতবর্ষে ঈশ্বরের বিভিন্ন দয়া-দানের জন্যে আমরা তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞা জানাই। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে অভিবাসনের এ যাত্রা শুরু করেছিল এবং খ্রিস্ট বিশ^াসের যে সমাজ গড়ে তুলেছিল সেই উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন পূরণে আমরা যেন সদা তৎপর থাকতে পারি।
ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসন একটি ঐত্যিহাসিক ঘটনা এবং ঐশ ‘অনুগ্রহের বর্ষকাল’। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ভক্ত মানুষ অভিভাসনের মাধ্যমে শত ধারায় আশীর্বাদে মণ্ডিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে আলোকিত ও উন্নত জীবন গড়েছেন ভাওয়াল অভিবাসিত খ্রিস্টভক্তগণ। শতবর্ষের যাত্রাপথে কত শত কথা, অভিজ্ঞতা, চাওয়া-পাওয়ায় জীবন অভিজ্ঞতা আশা-আনন্দ ও ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়েছে। পরিশেষে, ভাওয়ালবাসীদের বর্তমান বংশধরদের সার্বিক কল্যাণ ও পূর্বপুরুষদের সকলকে দান করুণ স্বর্গরাজ্যে চিরন্তন সুখ। শতবর্ষের এই পূর্তি উৎসবে আবারও সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসন শতবর্ষের পূর্তি উৎসব
Please follow and like us: