ফাদার সুনীল রোজারিও। রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
গত ২৮ এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে উকান নিউজ তাদের অনলাইন পেইজে উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুরের কোনো এক গ্রামের (নাম উল্লেখ নেই) আদিবাসীদের নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলো। রিপোর্টে প্রতিবেদকের নাম থাকা উচিত ছিলো। যাই হোক, দেরিতে হলেও বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। যার শিরোনাম ছিলো, Santal Christians return to ancestral faith in Bangladesh, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, “বাংলাদেশের আদিবাসী সাঁওতাল খ্রিস্টানগণ আবার তাদের পৈত্রিক বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছেন।” এই বিষয়ে উকান নিউজ যে ভুল ও সাংঘর্ষিক তথ্য দিয়েছে, তাদের সেই রিপোর্ট থেকেই সত্যটা দেখার জন্য এই প্রতিবাদ রিপোর্ট তুলে ধরলাম।
উকান রিপোর্টার শুরুতেই লিখেছেন, ডজনে ডজনে সাঁওতাল আদিবাসী যারা গত বছরগুলোতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তারা সামাজিক নিরাপত্তা ও সমর্থনের অভাবে তাদের প্রাচীন প্রকৃতি-পূজা সর্ণা ধর্মে ফিরে গেছেন। এর প্রমাণস্বরূপ রিপোর্টার ১৯ এপ্রিল তারিখে, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুরের উদাহরণ টেনেছেন, সেখানে মাত্র একটি পরিবার গ্রাম্য প্রধানদের উপস্থিতিতে সর্ণা ধর্মে ফিরে গেছেন- ডজনে ডজনে নয়। আর এই ফিরে যাওয়ার ছবি প্রকাশ করা হয়েছে ফেইসবুকে- ফলে এই ভিত্তি প্রশ্নের মুখে। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতারা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন,“অবহেলা ও সামাজিক সমর্থনের অভাব।” নরেশ টুডু (ছদ্দনাম) তার সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে সর্ণা ধমে ফিরে গেছেন, কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, “আমার সমাজ আমাকে ত্যাগ করেছেন- খ্রিস্টান হওয়ার পর থেকেই।” তাহলে এটা সহজেই বোধগম্য তিনি খ্রিস্টান হয়েছিলেন কোনো কারণ নিয়ে- বিশ্বাস নিয়ে নয়। অ-খ্রিস্টান সমাজকর্তৃক অবহেলা, অসমর্থন ও পরিত্যাক্ত হওয়ার পরও তিনি আবার ফিরে গেছেন আদি ধর্মে- স্বার্থসিদ্ধি হয়নি বলে। এখানে চার্চের কোনো অবহেলার বিষয় নেই। উকান রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছি, “তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, তারা লোভের কারণে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন- এবং সেই ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়াতে ফিরে গেছেন।” সত্যটা হলো- যা এই নরেশ টুডু উকান নিউজকে বলেছেন, “আমি দেখেছি ক্যাথলিক যাজকগণ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জন্য অসাধারণ কাজ করছেন। তারা চিকিৎসা সুযোগ দিচ্ছেন- যাদের প্রয়োজন, আমাদের সন্তানদের স্কুলে এবং হোস্টেলে পাঠাচ্ছেন। তারা কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যেমন জমি সংক্রান্ত জটিলতা অথবা খাদ্য সংকটে। আমি খ্রিস্টান হয়েছি তাদের দয়ার কারণে, লোভের কারণে নয়।” এটা তার মনের আসল কথা। তাহলে কেনো উকানের এই সাংঘর্ষিক রিপোর্ট ? একটু পরেই এই নরেশ টুডু উকানকে যা বলেছেন, তা আগের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বৈপরিত্য ধাঁচের। তিনি বলেছেন, তিনি সামাজিক সমস্যা এবং জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতারিত হয়েছেন। এই সময়ে চার্চ তাকে সমর্থন দেয়নি, সহায়তা দিয়েছেন- ছেড়ে আসা তার সম্প্রদায়। এই বিষয়ে নরেশ টুডু শুরুতেই বলেছিলেন, “আমার সমাজ আমাকে ত্যাগ করেছেন- খ্রিস্টান হওয়ার পর থেকেই।” এই উল্টাপাল্টা বক্তব্য কোনোভাবেই উকানের বক্তব্যের পক্ষে যায় না। এই প্রসঙ্গে ফাদার বালাসারিও সিরো মন্তোয়া’র বক্তব্য পরিস্কার যে, তারা সাহায্যের জন্য আসেন নি। তিনি বলেছেন, “চার্চ কোনো সময় খ্রিস্টান হওয়ার জন্যে লোকদের জোর করে না এবং সব ধর্মের অধিকারকে সম্মান করে।” তবে দুইটা বিষয়ে এখানে উকান নিউজ রিপোর্টারের অভিসন্ধি বোঝা গেলো না- প্রথমতঃ নরেশ টুডু, এই ছদ্দনামে কেনো তার বক্তব্য অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো। আর অন্যটি হলো- নিয়ামতপুর উপজেলার কোন্ গ্রামের কথা প্রতিবেদক বলতে চাইছেন।
অন্যদিকে সুবাস মুর্মু তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেছেন, “আমার কোনো সমস্যা নেই- কে কোন্ ধর্ম অনুসরণ করবেন।” তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে যা তিনি বলেননি তা হলো, একটা ধর্মকে গ্রহণ করা মানে সেই ধর্মের শিক্ষা, আচার অনুষ্ঠান ও বিধান মেনে চলা। একজন তখনই অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন- যখন দেখেন বা মনে হয়, তার আদি ধর্ম তার মুক্তির কথা বলে না। সুতরাং সে পরকালের সুখ ভেবে তার আদি ধর্ম বিসর্জন দেন। এখানে দুই দিকে পা ফেলার কোনো সুযোগ নেই। সুবাস মুর্মু পরে আরো বলেছেন, সন্তানদের শিক্ষা ও চাকুরীর ব্যাপারে চার্চের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে খ্রিস্টান হয়েছেন এবং কোন খ্রিস্টান, অ-খ্রিস্টানকে বিয়ে করলে তাকে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করা হয়। এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো- উত্তবঙ্গের শিক্ষিত খ্রিস্টান আদিবাসীদের একটা বড় অংশ চার্চের সহায়তার কারণে শিক্ষিত হয়েছেন। অন্যদিকে এখানে মনে রাখতে হবে- ক্যাথলিক চার্চের বিধান মোতাবেক- বিয়ে হলো একজন খ্রিস্টানের সঙ্গে আর একজন খ্রিস্টানের। এটাও যুক্তিসঙ্গত, একজন অ-খ্রিস্টান, ক্যাথলিকের সঙ্গে বিয়ে হয় ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিবেচরা করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। মনে রাখতে হবে একজন ক্যাথলিকের সঙ্গে অ-খ্রিস্টানের বিয়ে- ক্যাথলিক বিয়ে নয়। তবে মি. মুর্মু যে বলেছেন- খ্রিস্টান, অ-খ্রিস্টান, যে যাই হোক না কেনো, তিনি সাঁওতালদের জন্য একটা কমন প্লাটফর্ম তৈরি করতে চান। একজন নেতা হিসেবে এই বোধদয় বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
মি. সুবোধ বাস্কে, একজন সাঁওতাল ক্যাথলিক এবং উন্নয়ণ কর্মী। তিনি বলেছেন “তার পিতামহগণ খ্রিস্টান হয়েছেন কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়- কিন্তু ধর্মকে ভালোবেসে।” তিনি আরো বলেছেন, “তার পরিবার বিশ্বাসকে আর্থিক লাভের স্বার্থসাধন হিসেবে দেখেননি।” মি. বাস্কে, যাজকদের অবহেলার কারণে কিছু আদিবাসী প্রাচীন ধর্মে ফিরে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। এখানে বলার বিষয় হলো, ধর্ম গ্রহণ হলো একটা স্বাধীন চেতনা। কে কী করলো বা করেনি- তার জন্য আমার ধর্মকে বিসর্জন দেওয়া মানে ‘ধর্ম আমার আত্মার গভীরে প্রবেশ করেনি।’ এটাও ঠিক, আজকের দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাজকদের বহুকিছু দেখতে হয়- আর সবই করা হয় জনকল্যাণের জন্যে। মি. বাস্কে আবার স্বীকারও করেছেন, “চার্চ হলো সংখ্যালঘু এবং তাই প্রায়ই তার পক্ষে সবকিছু দেওয়া অসম্ভব।”
উকান নিউজ বলেছে, বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ৬০০,০০০, যার অর্ধেক আদিবাসী। এখানে বলতে চাই যে, উত্তরবঙ্গের এই নওগাঁ জেলাতেই এখন থেকে ১২০ বছর আগে একটি মাত্র পরিবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আজ হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার খ্রিস্টধর্মের অনুসারি। এই সংখ্যাই প্রমাণ করে- খ্রিস্টধর্ম মিথ্যা আশ্বাস, প্রতারণা, অবহেলা নয় বরং সেবা, প্রেম ও সহায়তার কারণেই আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
সবশেষে বলতে চাই, মিডিয়ার কাজ হলো, স্বাধীনভাবে সত্যকে উদঘাটন করা- কোনো কিছু বানিয়ে, অন্যের কাছ থেকে শুনে- সমাজকে ভুল পথে, সমাজের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি নয়। পোপ ফ্রান্সিস সাংবাদিকদের কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “এসো দেখে যাও।” তিনি বলতে চেয়েছেন, নিজের চোখে দেখে প্রত্যক্ষ করো- যেনো সত্য বার্তা মানুষের কাছে সত্য হয়েই প্রকাশিত হয়।

Please follow and like us: