কাথলিক খ্রিস্টভক্ত হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি যে এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড, গ্রহ-তারা এবং পৃথিবীর সকল সৃষ্টজীব, গাছপালা, প্রাণীকুল, বায়ুমন্ডল, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ইত্যাদি সকলই ঈশ্বরের সৃষ্টি। আর তিনি এই সবই সৃষ্টি করেছেন মানুষেরই মঙ্গলের জন্য। তাই আমাদের সকলকেই সৃষ্টির কারণ ও লক্ষ্য সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। আমরা যারা কাথলিক খ্রিস্টভক্ত, আমাদের বিশ্বাসের দৃষ্টিতেই এই সৃষ্টি রহস্য ও এর উদ্দেশ্যকে দেখতে হবে। এখানে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো:
১। সৃষ্টি আমাদের যত্ন করে
মায়ের যে হাত আমাদের খাওয়ায়, সেই হাতে আমাদের কামড় দেওয়া উচিত নয়। সৃষ্টির যত্নের কথা যখন বলি তখন এই বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। ‘ধরিত্রী’ বা পৃথিবী হলো আমাদের মায়েরই মত। ধরিত্রী আমাদের খাইয়ে থাকে; আমাদের খাদ্যসহ সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা বস্তু আমরা পৃথিবী থেকেই পাই। তাই ধরিত্রীকে যত্ন করা মানে নিজেদেরই যত্ন করা। পৃথিবীর সাথে যদি আমাদের সম্পর্ক ভাল থাকে, তাহলে আমরা তার যত্ন করব; আর প্রতিদানে আমরাও ভাল থাকব। আমরা যদি পৃথিবী ও এর প্রাকৃতিক পরিবেশকে ভালবাসি ও যত্ন করি, তাহলে পৃথিবীও আমাদের ভালবাসবে ও যত্ন করবে।
২. শান্তি আনয়ন 
ধরিত্রী বা পৃথিবীকে যত্ন করলে প্রতিদানে পৃথিবী আমাদের ভরে দিবে প্রাচুর্য্য। যখন প্রাচুর্য্য থাকে তখন জগতে ও সমাজে শান্তি বজায়ে থাকে। প্রাচুর্য্য ও পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে মানব সমাজে কোন প্রতিযোগিতা বা অবিশ্বাস থাকে না। যার যা প্রাপ্য তা তারা সহজেই পেয়ে যায় বলে সেই সমাজে বা স্থানে কোন অশান্তি সৃষ্টি হয় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের ( Ecology of Nature) মধ্যে যদি ভারসাম্য, শান্তি ও সমন্বয় না থাকে, তাহলে তাহলে পোপ ১৬শ বেনেডিক্টের ভাষায় মানব প্রকৃতির (Human Ecology) মধ্যেও কোন ভারসাম্য, শান্তি ও সমন্বয় থাকবে না (বিশ্বশান্তি দিবসের বাণী ২০০৭)। পোপ মহোদয় সেই বাণীতে বলেছেন, “অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে প্রকৃতির প্রতি অসম্মান দেখালে, মানুষের মধ্যেও কোন মিলন ও শান্তি থাকে না। তাই আমরা যদি সত্যিই শান্তি চাই তাহলে আমাদেরকে বেশী করে ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ’ ও ‘মানব প্রকৃতি’র মধ্যে যোগ সূত্রটি সর্ম্পকে সচেতন হতে হবে”।
৩। দরিদ্রদের প্রতি অধিক ভালবাসা
দরিদ্র ও অসহায় জনগণ ভূমির উপর বেশী নির্ভরশীল। প্রকৃতির সঙ্গে তাদেরই যোগাযোগ বেশী। প্রাকৃতিক পরিবেশ বা প্রতিবেশ নষ্ট হলে তাদেরই ক্ষতি হয় বেশী; অথচ তারাই খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপন্য উৎপাদনে জড়িত। এই কারণে এটি একটি ‘সামাজিক ন্যায্যতা’ সম্পর্কিত বিষয়ও। জলবায়ুর পরিবর্তন বা পরিবেশে বিপর্যয়, দরিদ্রদের জন্য অনেক দুঃখ কষ্ট নিয়ে আসে। সেই জন্য পোপ ফ্রান্সিস জোর দিয়েই বলেছেন যে “প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা ও যত্ন করা মানেই প্রতিবেশী মানুষের প্রতি ভালবাসা ও যত্ন” (তোমার প্রশংসা হোক ৬৭ Laudato Si )। মানব সংহতি ও ন্যায্যতার জন্য এই ভালবাসা ও যত্ন অপরিহার্য্য।
৪। সৌন্দর্য্য – পরিচ্ছন্ন ও সবুজ
ঈশ্বরই সৌন্দর্যের উৎস ও সৃষ্টিকর্তা। বিশ্বপ্রকৃতি ও সকল সৃষ্টি কৃষ্টি ঈশ্বরের সেই সৌন্দর্যই প্রকাশ করে আর তাঁর গৌরব ও প্রশংসা গান করে। ‘পরিচ্ছন্নতা ও সবুজ’ হলো সৃষ্টির সৌন্দর্য্যরে প্রথম ও প্রধান বিষয়। এই সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে আমাদের মানব জীবন ধন্য; এই মধ্যেই আমরা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারি। ঈশ্বরই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন – আর আমরা তার চিহ্ন দেখতে পাই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। কিন্তু আধুনিক মানুষ সৃষ্টির সেই অতিন্দ্রীয় দিকটি ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে স্বেচ্ছাচারীভাবে ‘কাঁচা মালের মত’ মত ব্যবহার করছে। পোপ ফ্রান্সিস যেমন বলেছেন, “আমরা অবাক হওয়ার, ধ্যান করার, সৃষ্টির প্রতি শোনার মনোভাব হারিয়ে ফেলেছি” (তোমার প্রশংসা হোক)। আমরা সৃষ্টির প্রতি এই অবাক হওয়ার ও প্রশংসা করার মনোভাব ফিরিয়ে আনতে পারি যদি আমরা চিন্তা করে দেখি এই সৃষ্টির অর্থ কি আর কার কাছ থেকে তা এসেছে। এইভাবে আমরা ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি। ‘সৃষ্টির সৌন্দর্য্য’ ঈশ্বরের এমনই এক উপহার যা অব্যাহতভাবে দিতেই থাকে। তাই সেইভাবেই এর যত্ন করা আবশ্যক।
৫। ঈশ্বরের দেওয়া উপহারকে সম্মান করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করি
আমরা যদি অন্যদের দেওয়া উপহারকে সম্মান করতে না পারি, তাহলে আমরা তাদের যে ভালবাসি সে কথা বলতে পারব না। তাদের দেওয়া জিনিষকে অবহেলা ও অসম্মান করে আমরা তাদেরকেই অবহেলা ও অসম্মান করি। ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন তাঁর সৃষ্টি আর তা তিনি উত্তম আখ্যা দিয়েছেন (আদি ১ অধ্যায়)। ঈশ্বরের জন্য যদি কোন জিনিষ ভাল হয়, তা আমাদের জন্যও ভাল হবে। পবিত্র শাস্ত্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টির সকল দানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক মাত্র, মালিক অথবা দখলদার নই যে এই দানকে যাচ্ছে-তাইভাবে ব্যবহার করব বা নষ্ট করব (মথি ১০:৬; ১ তিমথী ৬:১৭-২১)। বরং আমরা সৃষ্টিকাজে ঈশ্বরের সহকর্মী বা সহযোগী। সৃষ্টির যত্নেও আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে অংশগ্রহণ করি। খ্রিষ্টীয় জীবন যাপন করতে চাইলে আমরা এই দায়িত্ব পালন না করেই পারি না।

খ্রিস্টভক্ত হিসাবে আমরা কি করতে পারি
১। প্রথমত: আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টির যত্ন করব, তা অপচয় বা নষ্ট করব না। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত বনাঞ্চল ও গাছপালা, জলাশয় ও নদ-নদী, বন্যপ্রাণী ও জলজ প্রাণী, ইত্যাদি সংরক্ষণ ও যত্ন করব। বায়ু মন্ডলে কার্বন আধিক্য কমাতে বেশী করে গাছ লাগাব এবং পরিবেশকে পচ্ছিন্ন ও সবুজ রাখব।
২। যখন আমরা ঘরের বাইরে যাই, তখন আমাদের ঘরের লাইট, ফেন, কম্পিউটার, ইলেট্রনিক্স যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি বন্ধ করব। যখন কিছু সময় থেমে কারো সাথে আলাপ করি, তখন আমরা আমাদের গাড়ী বা মটর সাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ রাখি। এইভাবে আমরা শক্তি (Energy) সংরক্ষণ করতে পারি আর দূষণ (Pollution) কমাতে পারি।
৩। আমরা স্থানীয় শিল্পী-কুশলীদের তৈরী জিনিষপত্র ব্যবহার করব। আমাদের কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের দ্বারা উৎপাদিত ফসল ও দ্রব্যাদি ব্যবহার করব। এইভাবে আমরা ন্যায্যতা স্থাপনে অবদান রাখতে পারি ও স্থানীয় জনগণের আয় উপার্জনকে সমর্থন করতে পারি।
৪। আমরা খাদ্য দ্রব্যগুলি (সব্জি, ফল, ইত্যাদি) নবায়নযোগ্য পাত্রে রাখব। প্লাষ্টিকের পাত্র ও ফয়েল ব্যবহার এড়িয়ে চলব। এইভাবে আমরা বাড়ীর আবর্জনার পরিমান কমাতে পারি।
৫। বাড়ীতে বা ধর্মপল্লীতে ফোমের জিনিষপত্র (Styrofoam) ব্যবহার করব না (কারণ এই ফোম মাটিতে পঁচতে ৫০০ বছর লাগে)। আসল থালা বাটি ব্যবহার করতে না পারলে, আমরা পুনরায় তৈরী করা যায় (Recyclable), এমন থালা বাটি ব্যবহার করব।
৬। পানি বা জল অপচয় রোধ করব। স্নানের সময় প্রয়োজনের বেশী সাওয়ার ছেড়ে রাখব না। দাঁত ঘষা, দাড়ি কাটা, কাপড় ধোয়া, ইত্যাদির সময় পানির কল বন্ধ রাখব। বাগানে জল দিবার সময় আমরা অযথা বাগানের বাইরে জল ছিটাব না।
৭। পুনরায় তৈরী করা যায়, এমন সব বোতল, ক্যান, প্লাষ্টিক কাগজ, পুরাতন ইলেট্রনিক্স, ইত্যাদি ব্যবহার করব এবং অন্যদের তা করতে উৎসাহিত করব। নবায়নযোগ্য শক্তি (Renewable energy) ব্যবহার করব (সৌর বিদ্যুত, উইন্ড মিল, ইত্যাদি)।
৮। বাগান করব যেন টাট্কা ও স্বাস্থ্যকর শাক সব্জি খেতে পারি এবং অন্যদের, বিশেষভাবে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদেরও, দিতে পারি।
৯। ধর্মপল্লী ও পরিবারে পরিবেশ সচেতনতা দিবস পালন করব। পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বানে প্রতি বছর ১লা সেপ্টেম্বর ‘প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য বিশ্ব প্রার্থনা দিবস’ (World Day of Prayers for Environment) উদযাপন করব।
১০। পরিবেশবান্ধব ও পরিবেশ সংরক্ষণের আইন তৈরীর জন্য আইন প্রণেতাদের কাছে এডভোকেসী (Advocacy) করব যেন কার্বন দূষণ কমিয়ে পরিবেশকে আরও পরিচ্ছন্ন ও সবুজ করা যায়।

+ বিশপ জের্ভাস রোজারিও

 

Please follow and like us: