ফাদার দিলীপ এস.কস্তা

০১. কৃতজ্ঞতার পথ ধরে মানবিক জীবন গড়ি

জীবন ঈশ্বরের দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার বা দান যা মানুষ তার মানবিক গুণাবলী অনুশীলনের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করে। ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন আপন বুদ্ধি ও মানবিক গুণাবলী ব্যবহার করার মাধ্যমে। ঈশ্বর নিজেই মানুষকে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা দান করেছেন (দ্র:আদি ১-৩ অধ্যায়, সৃষ্টির বিবরণ)। মানুষ আর প্রাণীকুলের প্রধান পার্থক্য হলো ‘বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা’। মানুষ তার সহজাত বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা বিশ্লেষণ করে ভাল-মন্দ যাচাই-বাছাই করতে পারে। সেই জন্য মানুষকে ‘বুদ্ধিবৃত্তি সম্পূর্ণ প্রাণী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জীব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। মানুষ তার আপন বিচার-বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করে ‘মানুষ’ ও মানবিক চেতনায় বেড়ে উঠতে আহুত। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো ‘মানবিক’ চেতনায় বেড়ে উঠা ও সৎ বিশ্বস্ত হওয়া এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হলো ‘দয়া-অনুগ্রহ-কৃপার’ কথা স্বীকার, স্মরণ করা, প্রশংসা করা, স্তুতি নৈবেদ্য উপহার দেয়া। সামসঙ্গীতে বলা হয়েছে “সকল জাতির মানুষ, ভগবানের স্তুতিগান গাও, সকল দেশের মানুষ, গাও তার গৌরব গাঁথা! আহা, আমাদের প্রতি তাঁর ভালবাসা কতই না গভীর; তার বিশ্বস্ততা, সে তো চিরন্তন” (সাম ১১৭:১-২)। স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ হিসেবে আমরা স্রষ্টার প্রশংসা করতে ও কৃতজ্ঞ থাকতে আমার আহুত। সাধু পল খ্রিস্টীয় জীবনের বিষয়ে শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, “তোমরা পরমেশ্বরের প্রতি সর্বদাই কৃতজ্ঞ হয়ে থাক” (কলসীয় ৩:১৫)। বিশ্ব প্রকৃতি আপন-আপন বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করে। মানুষের জন্ম মৃত্যু ঈশ্বরের হাতে তবে মানুষ স্বত:স্ফূত ইচ্ছা স্বাধীনতা ব্যবহার করে বিশ্ব সংসারের আপন মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রেখে যায়।

০২. স্বত:স্ফূত মনোভাব নিয়ে কাজে অংশগ্রহণ করা

স্বত:স্ফূতভাবে কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রায় সব স্থানেই থাকে। মানুষ সামাজিক জীব আর সামাজিক জীবনে নিয়ম-নীতি পালন করা এবং কাজে অংশগ্রহণের মনোভাব থাকা খ্রিস্টীয় মনোভাবেরই প্রকাশ। পবিত্র বাইবেল এবং মাণ্ডলিক শিক্ষায় খ্রিস্টভক্তদের কাজে অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখার বিষয়ে অনুপ্রাণিত ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। মণ্ডলিতে আপন-আপন মেধা-মনন, সামর্থ্য ও দক্ষতার অনুযায়ী ভক্ত সাধারণগণ মণ্ডলিতে অবদান রাখতে পারে। এই মণ্ডলিতে আমরা বিভিন্ন ভাবে দায়িত্ব পালক করে থাকি আমাদের কর্মদক্ষতা ও কর্মদক্ষতা অনুসারে। সাধু পল  ১ করিন্থীয়দের কাছে তার লেখা পত্রে  বলেন যে, “ঐশ আত্মাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেককে দেওয়া হয় সকলেরই মঙ্গলের জন্য। একজনকে পবিত্র আত্মা-দান করে প্রজ্ঞার ভাষা, আর একজনকে সেই পবিত্র আত্মাই দান করে ধর্মজ্ঞানের ভাষা। অন্য একজনকে সেই আত্মাই আবার দান করেন পরম বিশ্বাস। কাউকে আবার সেই একই আত্মা দান করেন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা আত্মিক শক্তির স্বরূপ বিচার করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে অজ্ঞত ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা, অন্য কাউকে আবার সেই সব ভাষা বুঝিয়ে দেবার ক্ষমতা” (১ করি ১২:৯-১০)। তাই, কাজে অংশগ্রহণের মনোভাব নিয়ে জীবন-পরিচালনা করতে আমরা আহুত। বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে আলো-বাতাসসহ অসংখ্যক দান পেয়ে থাকি যার জন্য কোন মূল্য দিতে হয় না। তাই বেঁচে থাকার যাত্রা হলো: দেওয়া-নেওয়ার, সহযোগিতা-সহভাগিতা করার। বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে একাকী কেহই বেঁচে থাকতে পারে না। একজন আরেকজনের উপর নির্ভর করে, সেবা দান করেই বেঁচে থাকে। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বিশ্বসৃষ্টি, সমাজ-মণ্ডলিতে আমরা স্বত:স্ফূতভাবে দায়িত্ব পালন করে অন্যের মঙ্গল সাধন করবো।

৩. ‘কৃতজ্ঞতা’ পথ ধরে এগিয়ে যাই খ্রিস্টীয় জীবন

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা খ্রিস্টীয় ও মানবিক গুণ। বিশেষভাবে ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে ‘ধন্যবাদ’ বলে ‘কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ খুবই সাধারণ ব্যবহার এবং ভদ্রতাসূচক অভিব্যক্তির প্রকাশ। ‘কৃতজ্ঞা’ প্রকাশ হলো: উপকারের স্বীকৃতি প্রকাশ করা, স্বীকার করা, বাধ্য থাকা, প্রতি উত্তর দেয়া ইত্যাদি। মানুষ মাত্রই উপকারের প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে আহুত। প্রাণীকুলের মধ্যেও প্রভুভক্ত প্রাণী পাওয়া যায়; যারা প্রভুভক্ত এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে এমন কি প্রয়োজনে  জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। মানুষ প্রাণীকুলের চাইতে বহু ঊর্ধ্বে। বহু প্রচলিত কথা ‘দেবার মধ্যে আনন্দ’ প্রকৃত পক্ষে দেয়া-নেয়ার বা বিনিময়ের মধ্যে জীবনের পূর্ণতা।

‘মানুষ’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের গুণের মাধ্যমে মানবিক হয় এবং অপরকে সহযোগিতা ও সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হলো প্রতি উত্তর দেওয়া অর্থাৎ সম্পর্ক বজায় রাখা। বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমরা স্রষ্টার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও অনুগত্য প্রকাশ করি।

দৈনন্দিন জীবনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কয়েকটি দিক হলো-

-জীবন স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ও অনুগত্য স্বীকার।
-আমাদের পূর্ব পুরুষ, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের উপকারের প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
-নিজ মাতৃ-ভূমি তথা দেশ মাতৃকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা । দেশ-মাতৃকার সকল সহায়তা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার জনিত কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানবিক এবং নাগরিক দায়িত্বও বটে।
– সামাজিক জীব বা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার কারণেও সমাজ-কাঠামো, ঐতিহ্য, কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞ হওয়া।
– ধর্মীয় ও খ্রিস্টীয় জীবনে বেড়ে  উঠার নেপথ্যে মাতা-মণ্ডলি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সহায়তা দিয়ে থাকে মাতা মণ্ডলির প্রতি একান্ত কৃতজ্ঞ থাকা-কতই না মধুর ও মনোহর।
– পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশীর মধ্যেই আমরা সুস্থ মনোরমে বেঁচে থাকি তারই প্রতিদানে কৃতজ্ঞ থাকা।
– সর্বোপরি বিশ্ব-প্রকৃতির, আলো-বাতাসের মধ্যে বেঁচে থাকার কারণে কৃতজ্ঞ হওয়া মানবিক বৈশিষ্টের প্রকাশ।

স্রষ্টার সৃষ্টি বিশ্বচরাচরে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কতই না মধুর ও আনন্দের। তাই বেঁচে থাকা মানেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং সকল মহৎ ও মঙ্গলময় কর্মের জন্য ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা ভরা অন্তরে সততই আমরা বলি ‘তার স্তব কর তোমরা সবাই ,পৃথিবীর যত রাজা, যত জাতি, পৃথিবীর যত নৃপতি, যত শাসক-মানুষ, শিশু-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী, সকলেই তাঁর স্তব কর” (সাম ১৪৮-১১-১২)। সকল দয়া-অনুগ্রহ, কৃপা-আশিষের প্রতি উত্তরে কৃতজ্ঞতা ভরা অন্তরে উচ্চারণ করি “তাঁর দয়া, সে তো চিরকালেরই দয়া”

 

Please follow and like us: