দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের আহবানঃ “কৃতজ্ঞ হও” এ মূলসুরকে কেন্দ্র করে গত ১২-১৩ সেপ্টেম্বর, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো পালকীয় কর্মশালা ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। উক্ত কর্মশালায় ফাদার সিস্টার ও খ্রিস্টভক্তসহ ১৩৮ জন উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন ধর্মপ্রদেশেদের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও এবং সঞ্চালনা করেন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য-সদস্যাগণ।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় সেবাদলের আহবায়ক ফাদার বাবলু সি. কোড়াইয়া উপস্থিত সকলকে তার স্বাগত বক্তব্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আজ  আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ৩১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বা  জন্মদিন। এ দিনে আমরা ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। কেননা তিনি আমাদের ধর্মপ্রদেশের  শৈশব ও কৈশরকাল পার করে ভরা যৌবনে উর্ত্তীণ করেছেন । তাই তো, এবারও আমরা, আমাদের ধর্মপ্রদেশের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এ ধর্মপ্রদেশের বার্ষিক এ কর্মশালা পালন করছি । আমরা যেন “কৃতজ্ঞ হই”- বিশপ মহোদয়ের এমন উদাত্ত আহবান,  এ বছরের পালকীয় কর্মশালার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যা আমরা বাস্তবায়ন করছি। কর্মশালার মূলভাব নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে ধ্যান শুরু করেছি। এ কর্মশালায় শুধু আলোচনা নয়, আমরা যেন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্মপল্লীতে ফিরে গিয়ে সঠিক কাজটি করতে পারি।

বিশপ জের্ভাস রোজারিও তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, এ বছর পালকীয় কর্মশালার মূলভাব “দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের আহ্বান: ‘কৃতজ্ঞ হও’। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “সৃষ্টির সকল কিছুই উপভোগ করার এবং ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির যত্ন করা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও আমরা পেয়েছি। এ সকল দায়িত্ব পালন করতে আমরা অনেক বার ব্যর্থ হয়েছি। কারণ ঈশ্বরের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ নই। আমরা কৃতজ্ঞ হলে ঈশ্বরের উপহারের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতাম। তাঁর সকল সৃষ্টিকে সম্মান, যত্ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতাম।” আমাদের পিতামাতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ। কারণ আমাদের পিতা মাতা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, ভালবাসা ও যত্ন সহকারে আমাদের মানুষ করেছেন। কিন্তু, বর্তমানে কত বৃদ্ধ মা-বাবা ও পরিবারের প্রবীণ আত্মীয়-স্বজন অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে কষ্ট পাচ্ছে।

আমরা খ্রিস্টান হিসেবে, মণ্ডলির কাছ থেকে অনেক সহায়তা পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, স্বাস্থ্য ও গড়ে ওঠার ব্যাপারে স্থানীয় মণ্ডলির অনেক অবদান রয়েছে। মণ্ডলি আমাদের নতুন জীবন দিয়েছে আর সে আমাদের মায়ের মতই ভালবেসে যত্ন করে তার মূল্যবোধ নৈতিকতা দিয়ে গঠন দিতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হলো কৃতজ্ঞ হওয়া। আমাদের সন্তানদের মঙ্গলসমাচারের উপযুক্ত শিক্ষা ও নৈতিক গঠন দিয়ে কৃতজ্ঞ হওয়ার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে যেন তারা ঈশ্বর ও মণ্ডলির প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখে। তাই , আসুন, আমরা আমাদের সমাজে ও স্থানীয় মণ্ডলিতে কৃতজ্ঞ হওয়ার” সংস্কৃতি গড়ে তুলি

অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মিসেস সুলেখা গমেজ তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, কর্মশালায় অংশগ্রহণ ভাল ছিল, ধর্মপল্লীভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়গুলি ভাল ছিল। ভবিষ্যতে বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলে আরও ভাল হবে। মি: আলেক্স মার্ডী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মশালায় সকলে অংশগ্রহণ করেছেন যা আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। মার্টিন মার্ডী বলেন, কর্মশালার নির্ধারিত বিষয় ও উপস্থাপনা ভাল ছিল।

কর্মশালা শেষ করার আগে সকলে নিকট  প্রেরণ বিবৃতি উপস্থাপন করে পালকীয় সেবাদলের আহ্বায়ক বলেন, বিগত বছরের পালকীয় কর্মশালার মূলসুরের ধারাবাহিকতায় ও গৃহিত অগ্রাধিকারসমূহের আলোকে এই বছরের পালকীয় কর্মশালার মূলসুর নেওয়া হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের আহ্বান: ‘কৃতজ্ঞ হও’।  এই কর্মশালার মধ্য দিয়ে আমরা পবিত্র বাইবেল ও কাথলিক মণ্ডলি ধর্ম শিক্ষার আলোকে এবং নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলিতে কৃতজ্ঞ হওয়ার সংস্কৃতি চর্চার বিষয়ে অবগত হয়েছি। কর্মশালায় বিশপ মহোদয়ের পালকীয় পত্রের অনুধ্যান, ভিকারিয়া পর্যায়ে অনুষ্ঠিত তিনটি কর্মশালার সারসংক্ষেপ প্রতিবেদন এবং ধর্মপ্রদেশ পর্যায়ে কর্মশালার দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন উপস্থাপনার ভিত্তিতে আমাদের দর্শন, প্রেরণ  এবং অগ্রাধিকারসমূহ নিম্নরূপ-

দর্শন (Vision): কৃতজ্ঞ অন্তরে সক্রিয় ও অংশগ্রহণকারী ভক্তজনগণ এবং স্বাবলম্বী স্থানীয় মণ্ডলি।
প্রেরণ (Mission): ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলিপর্যায়ে প্রার্থনা, দান ও স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সমাজ ও মণ্ডলিতে সমন্বিত ও সম্মিলিত অংশগ্রহণ।
অগ্রাধিকারসমূহ (Priorities)
১. অংশগ্রহণ :
পরিবারের সবাই মিলে খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ, খ্রিস্টযাগের উদ্দেশ্য প্রদান, নিজ পরিবার ও প্রতিবেশীর বাড়িতে প্রার্থনায়, বাণী প্রচারে অংশগ্রহণ, সেবাকাজে (মণ্ডলি, সমাজের) অংশগ্রহণ।
২. দান প্রদান :
মণ্ডলির সেবাকাজে ও অভাবী ভাইবোনদের সাহাযার্থে শস্য, ফল-মূল, ফুল, খাদ্য, অর্থ, প্রতিভা, সময়, শিক্ষা, চিকিৎসা, বস্ত্র, গৃহ খাতে পরিকল্পিত ও নিয়মিত অনুদান প্রদান।
৩. স্বেচ্ছাশ্রম :
কায়িক শ্রম, মণ্ডলি ও সমাজে সেবাকাজ, শিক্ষা বিস্তার, বাণী প্রচার, ধর্মশিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্র্ত স্বেচ্ছাশ্রম প্রদান।
৪. নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতার অনুশীলন :
নিজস্ব কৃষ্টি চর্চা এবং খ্রিস্টিয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলিতে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদের অনুশীলন এবং ভালবাসা, ক্ষমা, প্রশংসা, দয়া ও দান প্রদানের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতার সংস্কৃতি চর্চা।
৫. মানুষ, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সৃষ্টির যত্ন :
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অনুশীলন, বৃক্ষরোপন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থায়িত্বশীল কৃষির চর্চা, স্থানীয় ও এলাকার জলবায়ু ও পরিবেশ উপযোগী ফসল, বৃক্ষ, মৎস্য, গবাদিপশু প্রতিপালন এবং মিতব্যয়িতা ও সম্প্রসারণে সঠিক পদক্ষেপ–।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় পালকীয় ১৯তম কর্মশালার দায়িত্বশীল সেবক হিসেবে অন্তর-আত্মায় কৃতজ্ঞ হতে আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। কর্মশালায় গৃহিত অগ্রাধিকারসমূহ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ক্ষুদ্র খ্রিস্টিয় মণ্ডলি ধর্মপল্লী ও ধর্মপ্রদেশ পর্যায়ে ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়ন করতে আমরা সবাই সমন্বিত ও সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করব। এই কাজে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমাদের অনুগ্রহ ও আশির্বাদ দান করুন।

সবশেষে বিশপ মহোদয়ের সমাপনী বক্তব্য এবং পালকীয় কর্মপ্রশালায় ও এ বছরের জন্য প্রস্তুতকৃত  প্রার্থনা কার্ড থেকে সমবেতভাবে প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে কর্মশালার সমাপ্তি ঘটে।

 

Please follow and like us: