বিশপীয় সিনোড- ২০২৩ (১ম পর্ব)

ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক, রাজশাহী সিটি।

ভূমিকা : সিনোড (বিশপগণের ধর্মসভা) হলো পোপের অধীনে ক্যাথলিক বিশপদের একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। পোপ ৬ষ্ঠ পল, দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভায় যোগদানকারি বিশপদের ভবিষ্যত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী এবং মহাসভার তাৎপর্য থেকে অনুপ্রাণীত হয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিনড বা বিশপীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। The word “synod”, derived from two Greek words syn meaning “together” and hodos meaning “road” or “way”, means a “coming together. যা বাংলায় বিভিন্নভাবে বলা যায়, একসঙ্গে চলা বা একসঙ্গে পথচলা বা একসঙ্গে যাত্রা। মণ্ডলির প্রচলিত ধারণায় সিনড অর্থ হলো, প্রেরিতদূতদের উত্তরাধিকারী মণ্ডলির বিশপগণ- জনগণের সঙ্গে, পরস্পরের সঙ্গে এবং মণ্ডলির প্রধান পোপের সঙ্গে একসঙ্গে পথ চলবেন। তাই বলা যায়, সিনড হলো ক্যাথলিক চার্চের একটি ধর্মীয় সভা, যে সভায় গোটা বিশ্ব থেকে প্রতিনিধি বিশপগণ পোপের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরস্পরের মধ্যে পালকীয় সেবা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, নানা তথ্য এবং চার্চের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এভাবেও বলা যায়, “সিনড হলো, বিশ্ব ক্যাথলিক বিশপ প্রতিনিধিদের একটি ধর্মীয় সভা, যারা সর্বজনীন মণ্ডলির জন্য তাদের পরামর্শ দিয়ে পোপকে সহায়তা প্রদান করেন।”

বিশপীয় সিনডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা থেকে বিশপীয় সিনড সভার ধারণা পাকাপোক্ত হলেও এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাবনা আরোও আগেই উত্থাপন করা হয়েছিলো- যার উদ্দেশ্য ছিলো সর্বজনীন মণ্ডলিকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে পোপকে সহায়তা-পরামর্শ দেওয়া। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর, যুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের (মিসর) ভাটিকান প্রতিনিধি কার্ডিনাল সিলভিও অড্ডি এক প্রস্তাবে মণ্ডলিতে একটি কেন্দ্রিয় “পরামর্শদাতা সভা” গঠনের আহ্বান জানান। কার্ডিনাল অড্ডি তাঁর প্রস্তাবে বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযোগ আসছে যে, মণ্ডলিতে কেনো একটি পরামর্শদাতা সভা নেই।” তিনি বলেন, “এমন একটি প্রতিকৃতি পরিষদ গঠন করতে হবে যেখানে বিশ্ব মণ্ডলির প্রতিনিধিগণ মাঝেমধ্যে বা বছরে একবার মিলিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাব্য নতুন পথের সন্ধান দিবেন।” এরপরেও ক্যাথলিক চার্চে বিশপদের একটি বিশ্ব পরিষদ গঠনের ধারণা থেমে না থেকে বরং আরো পরিপক্ক হতে থাকে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর বর্তমান নেদারল্যান্ডস দেশের আট্রিস্ট প্রদেশের কার্ডিনাল আলফ্রিংক লিখেছিলেন যে, সর্বজনীন মণ্ডলি তার অধিকারবশতঃই বিশপগণ দ্বারা পরিচালিত এবং যার প্রধান হলেন পোপ। সে হিসেবে বিশ্ব মণ্ডলির প্রত্যেক বিশপের উপর এককভাবে মণ্ডলি পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায়। তিনি বলেন, তবে এই কাজটি করা যেতে পারে একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান গঠন করে। কার্ডিনাল আলফ্রিংক এই প্রসঙ্গে তাঁর পরামর্শ প্রস্তাবে আরো বলেন, বিশ্ব মণ্ডলি থেকে বিশেষজ্ঞ বিশপদের নিয়ে এবং তাঁদের আইনানুসারে প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে পোপের অধীনে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে। পরে, পোপ ৬ষ্ঠ পল, একটি স্থায়ী বিশপীয় সভা গঠনের প্রস্তাব আরো বেগবান করেন- যখন তিনি ইটালির মিলান নগরের আর্চবিশপ ছিলেন। তিনি পোপ ত্রয়োবিংশ জনের মৃত্যু বার্ষিকী অনুষ্ঠানে এক আলোচনায় বলেন, “যদিও বিশপগণের এমন চলমান সম্পৃক্ততা এখনো কার্যকর নয় এবং যা এখনো ব্যক্তিগত ও একক অবস্থায় রয়েছে, তা সর্বজনীন মণ্ডলির জন্য প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।” পোপ ৬ষ্ঠ পল নির্বাচিত হওয়ার পরে সাধু পিতরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ২১ সেপ্টেম্বর পোপীয় সংস্থা এবং ২৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার উদ্বোধনীর অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় আসরে এবং ৪ ডিসেম্বর উদ্বোধনী আসরের সমাপনী অনুষ্ঠানের “বিশ্ব বিশপীয় সভার” গুরুত্ব তুলে ধরেন। সবশেষে, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাটিকান মহাসভার সমাপনী অধিবেশনের শুরুতে বিশপীয় সিনড গঠনের বিষয়টি তিনি জন সম্মুখে তুলে ধরেন। পোপ প্রতিনিধিদের বলেন, “একটি অগ্রিম তথ্য হিসেবে আমরা আনন্দের সঙ্গে আপনাদের অবহিত করে ঘোষণা করতে চাই যে, আমরা আপনাদের একটি প্রতিষ্ঠান দিতে যাচ্ছি, আর এই মহাসভা অনুসারে তার নাম হবে ‘বিশপগণের ধর্মসভা (Synod of Bishops)।’ পোপ বলেন, “সিনড একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন কিন্তু অনুপ্রেরণা প্রাচীন।” সিনড সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিশপগণের এই প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে বিভিন্ন দেশের ক্যাথলিক বিশপ সম্মেলনীর মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে। পোপের আহ্বান বিশপগণ সর্বজনীন চার্চের মঙ্গলার্থে পোপের পরামর্শদাতা ও সহযোগীরূপে কাজ করবেন।” এই প্রসঙ্গে পোপ তাঁর ঘোষণার উপসংহারে বলেন, “আমরা এই চমৎকার ও প্রতিশ্রুতিময় নবধারার প্রতিষ্ঠানটি “ঈশ্বর মাতা” মা মারীয়ার সুরক্ষা তত্ত্বাবধানে উৎসর্গ করছি।”

বিশপীয় সিনডের লক্ষ্য : সিনডের মূল বৈশিষ্ট হলো বিশ্বের বিশপ প্রতিনিধিগণ পোপের সঙ্গে যুক্ত থেকে মিলন-অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে পালকীয় কাজ করা। বিশপগণের সিনড, রোমান কোরিয়া ও পোপীয় সংস্থাগুলোর মতো সীমিত ও নির্ধারিত কাজের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান নয়- কিন্তু পোপ কর্তৃক নির্ধারিত যে কোনো বিষয়ের উপর তাঁদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত। অন্যদিকে সিনডের রয়েছে “সাধারণ সচিবালয়” যা রোমান কোরিয়ার অংশ নয় এবং ঐ গুলোর উপর নির্ভরশীলও নয়। সিনড প্রকৃতপক্ষেই পোপের অধীনে এবং সর্বজনীন চার্চের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তবে, যদিও সিনড প্রতিষ্ঠানের রয়েছে স্থায়ী কাঠামো- কিন্তু এই কাঠামো নিজে নিজে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। অন্য কথায়, বিশপগণের সিনড সভা তখনই অনুষ্ঠিত হয় যখন পোপ মনে করেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর মতামত জানার প্রয়োজন রয়েছে। নির্ধারিত বিষয় নিয়ে সিনড সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে পোপ তাঁর সাধারণ সচিবালয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্ব সিনড প্রতিনিধিদের অবহিত করেন, যেন তারা স্থানীয় মণ্ডলির মধ্যে আলোচনা করে মতামত সংগ্রহ করতে পারেন। এই পদ্ধতি অবলম্বর করেই আসন্ন ২৬তম সিনড সভার মূল বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে- “মিলন- অংশগ্রহণ- প্রেরণ দায়িত্ব।”

Please follow and like us: