১৮ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দ। খুব হাড় কাপানো কনকনে বাতাস। এরই মধ্যে ছোট একটি শিশু তার বাবার হাত ধরে এগিয়ে চলছে। তাঁকে দেখে প্রশ্ন করলাম; কোন স্কুলে যাচ্ছ মামণি? মিষ্টি হেসে আধো গলায় বলল; হলিক্রস স্কুলে। আপনিও চলেন, আপনিও আসেন আমাদের নতুন স্কুলে। আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো হবে এবং বরণ করেও নেওয়া হবে। শুনেছি আজই হলিক্রস স্কুল তার আত্মপ্রকাশ করবে। আমি বললাম; হ্যাঁ, চলো যাই। যদিও স্কুলের কাজ এখনো শেষ হয়নি; তবুও স্কুল শুরু করার যে প্রস্তুতি তা কোন অংশে কম নয়। স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকসহ আগমন যেন স্কুলকে নতুন করে প্রাণশক্তি দান করছে। এরমধ্যেই দেখতে পেলাম মঞ্চ সাজানো এবং ব্যানারে লেখা রয়েছে “হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজ”-এর আত্মপ্রকাশ। এই মহতি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব জয়া মারীয়া পেরেরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটিসি), রাজশাহী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও, এসটিডি, ডিডি, বিশপ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ ও মি: সুক্লেশ জর্জ কস্তা, আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ, রাজশাহী অঞ্চল। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ব্রাদার সুবল লরেন্স রোজারিও, সিএসসি, প্রভিন্সিয়াল, হলিক্রস ব্রাদার, বাংলাদেশ। ব্রাদার প্লাসিড রিবেরু, সিএসসি, অধ্যক্ষ, হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফা: ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও, ফাদারগণ, হলিক্রস ব্রাদারগণ এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণসহ নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। প্রথমেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলি এবং প্রধান অতিথি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরে সকলের উদ্দেশ্যে উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশন করেন অত্র স্কুলের ছাত্রীদ্বয় এবং নার্সারী থেকে শুরু করে প্রতিটি শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ব্রাদার প্লাসিড রিবেরু।
হলিক্রস স্কুলের আত্মপ্রকাশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার প্লাসিড রিবেরু তাঁর স্বাগত বক্তব্যের মধ্যে বলেন- হলিক্রসের ছাত্র-ছাত্রীদের হতে হবে স্মার্ট। স্মার্টনেছের প্রকাশ হবে ভদ্রতা এবং আজকের এই দিনের জন্য সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নীরবতা। আজ এই হলিক্রস স্কুল উদ্বোধন রাজশাহীর বুকে একটি নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এই ইতিহাস রচনায় যারা বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন তাদের সকলের প্রতি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। প্রার্থনা, আশির্বাদ ও দোয়া করবেন যেন হলিক্রস স্কুল শুরু থেকে সুন্দরভাবে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে যেতে পারে।
হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের আত্মপ্রকাশের শুভ দিনে সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক মি: সুক্লেশ জর্জ কস্তা বলেন- এ বিদ্যালয় নতুন, শিক্ষার্থীরা নতুন, শিক্ষকগণও নতুন, যারা স্কুল পরিচালনা ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আছেন তারাও নতুন আর নতুনকে নিয়েই যাত্রা শুরু। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে হলে ৪টি পিলারের দরকার। ৪টি পিলারের মধ্যে প্রথমটি হলো শিক্ষার্থী, দ্বিতীয়টি অভিভাবক, তৃতীয়টি শিক্ষকগণ এবং চতুর্থটি হলো স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ ৪টি পিলারের যেকোন একটিতে টান পড়লে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি সাধিত হয়। আজ আমরা ৪ শ্রেণীর লোকেরাই এখানে উপস্থিত আছি। তাই এ ৪ শ্রেণীর লোকের সহযোগিতার মাধ্যমেই হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজকে সুন্দরভাবে সামনে এগিয়ে যেতে সকলের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।
হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শুভ যাত্রার প্রথমদিনে সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও বলেন- আজ আমি এতটাই আনন্দিত যে, আমার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, আমি নিজের চোখে আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত হতে দেখছি। তাই বলতে চাই, রাজশাহীর বুকে শুধু হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজ নয়; বরং একদিন যেন বিশ্ব বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই স্বপ্নও আমি দেখতে শুরু করেছি। আজকের এই অনুষ্ঠানের উপস্থিত ব্রাদারদের প্রভিন্সিয়াল ব্রাদার সুবল এল.রোজারিওসহ সকল ব্রাদারদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে তাদেরকে উৎসাহিত করি, যেন তারা এই শিক্ষা নগরীতে একটি সুযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমন্বিত মানুষ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। এই শুভ কাজকে আরো ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়িত করতে ঈশ্বর আমাদেরকে আশির্বাদ দান করুন।
হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর একজন ছাত্রী স্কুলের আত্মপ্রকাশের দিনে তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন- আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। অত্র বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সুভাগ্যবতী বলে মনে করছি। আজ আমি ধন্যবাদ জানাই পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তাকে এবং সেই সাথে যারা অত্র এলাকায় এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে আমাদেরকে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন তাদেরকে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন অত্র প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।
হলিক্রস ব্রাদার বিনয় হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের আত্মপ্রকাশের মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরে বলেন- আমাদের হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের লক্ষ্য হলো হৃদয়বৃত্তি ও মনোবৃত্তির চর্চা। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা ফাদার আন্তনী মরো বলেন- হৃদয়বৃত্তিসমূহ ক্ষতি করে কখনো মনোবৃত্তির উৎকর্ষ সাধন করা যায় না এবং সেই নীতি নিয়েই আমরা হলিক্রস ব্রাদার, সিস্টার এবং ফাদারগণ সারাবিশ্বে এবং বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। হলিক্রস ব্রাদার, সিস্টার এবং ফাদারদের পেশা এবং নেশা হলো শিক্ষাদান। আজকের এই দিনে আমাদের অভিভাবকদেরকে আমি বলতে চাই, অভিভাবক হিসেবে তাদের সন্তানদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে যথেষ্ঠ ভূমিকা আছে। তাই, পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের স্কুলের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হবে।
“হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজ”-এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জনাব জয়া মারীয়া পেরেরা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটিসি), রাজশাহী বলেন- হলিক্রস শব্দটা আমার মনে প্রাণে আছে। কেননা আমি নিজেই একজন হলিক্রসের ছাত্রী ছিলাম। হলিক্রস স্কুলে শুধু লেখাপড়াই শিখানো হবেনা বরং নিয়ম-কানুন বা নিয়মানুবর্তিতা এবং একজন আদর্শ মানুষ হবার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই শিক্ষা দেওয়া হবে। স্কুলের শিক্ষার পাশাপাশি অভিভাবকদেরকে সচেতন হবার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, তারা নিজেরাও যেন তাদের নিজ নিজ সন্তানদেরকে পরিবারে যত্ন নেন। অর্থাৎ স্কুল থেকে যে ডাইরী লিখে দেওয়া হয় অভিভাবকগণ আপনারা তা যত্ন সহকারে দেখবেন এবং সন্তানদেরকে ক্লাস ফলো করতে সাহায্য করবেন।
“হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজ”-এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি শ্রদ্ধেয় ব্রাদার সুবল এল.রোজারিও বলেন- আমাদের হলিক্রস পরিবারে আপনাদের স্বাগতম জানাই। আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যে, আপনারা আমাদেরকে বিশ্বাস করেছেন। আর বিশ্বাস করে আপনাদের সন্তানদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আপনারা যে আমাকে বিশ্বাস করেছেন এখন আমি তার মর্যাদা দিব। আপনাদের ছেলে-মেয়েদেরকে আমরা সুশিক্ষিত করব। সুশিক্ষিত হবে একজন ভাল মানুষ হয়ে, একজন ভাল নাগরিক হয়ে। আমাদের কাছে আপনাদের চাওয়া হল এই যে, আপনাদের ছেলে-মেয়েরা যেন মানুষ হয়, সে যেন সৎ থাকে, ন্যায়বান হয়, সে যেন পরিশ্রমী হয়, সে যেন নিজের মঙ্গল করে, দেশের মঙ্গল করে, অন্যের মঙ্গল করে এবং সে যেন অন্যদেরকে সেবা করে। একটি শিশুকে শিক্ষিত করতে হলে পুরো একটা গ্রাম লাগে। দয়া করে আপনারা আমাদেরকে এই কাজে সহায়তা করবেন। আমাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সিলেবাসের পড়াই শুধু পড়বে না বরং তাদেরকে পুরো বই পড়তে হবে এবং প্রতি সপ্তাহে কুইজ পরীক্ষা দিতে হবে। আপনাদের সন্তানদের সাথে আপনাদেরকেও পড়তে হবে, আপনারা এই কথা বলতে পারবেন না যে, তুমি পড় আমি টিভি দেখি। আপনার সন্তানদেরকে যত্ন নিতে হবে, সময় দিতে হবে এবং স্কুলে কি করছে না করছে তার খোঁজ খবর নিতে হবে। আপনাদের ছেলে-মেয়েদেরকে যদি সকাল ৮:০০ টায় উঠতে বলেন তাহলে আপনাকেও সকাল ৮:০০ উঠতে হবে অর্থাৎ কথার সাথে আপনার কাজের মিল রাখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা আমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং আমরা সবাই মিলে আমাদের সন্তানদেরকে মানুষ করে তুলব। আবারও সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি।
অত:পর অধ্যক্ষসহ সকল সম্মানিত অতিথিবৃন্দ শ্রেণীকক্ষ পরিদর্শন করার মধ্যদিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের এবং হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের ইতি টানেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার