ফাদার সাগর কোড়াইয়া
এই লেখাটির নামকরণ একটু ভিন্ন! অর্থ একেকজন একেকভাবে চিন্তা করতে পারে। তবে সত্যটা হচ্ছে নিজের ভাষাকে হালকাভাবে নেবার কোন সুযোগ নেই। নিজ ভাষাকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে সঠিক, সুন্দর এবং শুদ্ধ চর্চা করাটাই শ্রেয়। বিশ্বের প্রতিটি ভাষার আলাদা সৌন্দর্য আছে। আর সে সৌন্দর্য প্রকাশ করে সে দেশের সামগ্রীক প্রাচুর্য। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েও বুঝি কোন কাজ হয়নি। বাংলা ভাষার সৌন্দর্যময়তা আমাদের দোষ ও অবহেলার জন্য আজ মুখ লুকাতে ব্যস্ত। এটি শুধুমাত্র কতিপয় ঘটনার জন্য স্পষ্টতর নয়; বরং ঘটনার ঘনঘটা প্রতিনিয়ত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের সর্বস্থানেই লক্ষ্যণীয়। বাংলা ভাষা যদিওবা এপার-ওপার উভয় বাংলায়ই প্রচলিত তবুও বাংলা ভাষা কেন যেন অবহেলিত। বাংলা ভাষাকে তুচ্ছ করার চিত্র সর্বত্র। আজ বাংলা ভাষা কোন পথে! বাংলা ভাষার ভবিষ্যত কি! ভাষা নদীর ¯স্রোতের মতো পরিবর্তনশীল সত্যি কিন্তু জোর করে পরিবর্তন আনয়ন বাংলা ভাষামৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে কি! এ প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে ঠিকই কিন্তু এদেশের জনগণ নিজ ভাষাকে নিয়ে কতটুকু ভাবে- সে বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার একটি ভাষা আন্তর্জাতিকমহলে কতটুকু স্থান দখল করে নিতে পারলো তা প্রকাশ পায় সে ভাষায় সৃষ্টিশীলতা দেখে। বাংলা ভাষার বুদ্ধিজীবিমহলই এক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারবেন। পৃথিবীতে অনেক ভাষা রয়েছে যে ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা সীমিত। কিন্তু সে ভাষার প্রাচুর্য অত্যাধিক। বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বাংলা ভাষার প্রাচুর্যও অধিক। শব্দ সংখ্যা অন্যান্য ভাষার চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসা পরিসংখ্যানে সীমিত এবং এই ভাষায় সৃষ্টিশীল কাজ কমই বলতে হয়।
ফেব্রুয়ারি হচ্ছে ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি এলেই কেমন যেন ভাষার প্রতি ভালবাসা উত্লে উঠে। সারাটি বছর ভাষার প্রতি ভালবাসা পালিয়ে থাকে। অনেকেই হয়ে উঠি ভাষা বিদ্রোহী আর ফেব্রুয়ারি প্রথম দিন থেকে ভাষাবোদ্ধা হয়ে উঠার চিত্র লক্ষণীয়। এটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে কতিপয় পিতামাতার মধ্যে নিজ সন্তানকে বাংলা ভাষার বদলে বিদেশী ভাষা শিখানোর লম্ফঝম্ফ দেখলে। বিদেশী ভাষাপ্রীতি কখনোই মন্দ কিছু নয়। নতুন একটি ভাষার প্রতি দক্ষতা অর্জন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বিদেশী ভাষাপ্রীতি নিজ মাতৃভাষাকে অবহেলা করে দেখাতে হবে তা অগ্রহণীয়। নিজ মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা আর বিদেশী ভাষাপ্রীতি যেন নিজের সাথে নিজেরই প্রতারণা। তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দৌরাত্ম দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। পিতামাতা-অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সন্তান ও শিক্ষার্থীদের মাথার মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব যেভাবে প্রবেশ করাতে পেরেছে সেভাবে কিন্তু বাংলা ভাষাপ্রীতি প্রবেশ করাতে ব্যর্থ। দোষ কাকে দেবো! বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থা এমন পর্যায়ে অবস্থান করছে যে, ইংরেজি শিক্ষা ব্যতিত ভালো এবং উচ্চমানসম্মত বেতনযুক্ত চাকুরী অসম্ভব।
ঢাকা শহরের একটি বাসায় দুইজন ছাত্র-ছাত্রীকে ছয়মাস পড়ানোর সুযোগ হয়েছিলো। দু’জনই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করে। সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে পেরে পিতামাতাদের মধ্যে অত্যাধিক তৃপ্তি। নিজেদের সন্মান যেন বৃদ্ধি পেয়েছে এ রকম অবস্থা! অস্বীকার করার উপায় নেই- ছাত্র-ছাত্রী দু’জনই ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। একদিন কৌতুহলবশত দু’জনকে বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। অবাক হলাম- দু’জনই বাংলা ঠিকমত পড়তে পারে না। অত্যাধিক কৌতুহলবশত রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে জানালো- রবীন্দ্রনাথের নাম তারা এই প্রথম শুনেছে। সন্তানদের দোষ দেবার কিছুই নেই। পিতামাতাগণ নিজ সন্তানদের মাতৃভাষার আসল স্বাদ আহরণে বঞ্চিত করেছে সন্দেহাতীত। বাংলা ভাষার আরেকটি সৌন্দর্য রয়েছে- জেলাভেদে বাংলা ভাষার আঞ্চলিকতা। জানি অনেক দেশের ভাষায় এলাকাভেদে ভাষার আঞ্চলিকতা রয়েছে তবে বাংলা ভাষার মতো প্রতিটি জেলায় আছে কিনা জানা নেই। বাংলা ভাষার এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় অন্তর থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয়- অনেক পিতামাতা নিজস্ব অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিকতা সন্তানদের শিখতে দিতে চান না। সন্তানদের সামনে কেউ আঞ্চলিকতায় কথা বললে অনেক পিতামাতাই রাগ করেন। তাদের ধারণা- গ্রামের আঞ্চলিকতা অশিক্ষিত-মূর্খদের জন্য। আঞ্চলিকতা শিখলে সন্তান গেয়ো হয়ে উঠবে। সন্তানদের শহুরে করে তোলার ক্ষেত্রে পিতামাতাদের প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। কিন্তু হাসি পায় যখন দেখি সন্তানরা না শিখলো তথাকথিত শুদ্ধ আবার না জানে আঞ্চলিকতা। তখন দুটো মিলে এমন একটি খিঁচুরী জাতীয় কিছু হয়ে উঠে যা সত্যিই পিতামাতার জন্য লজ্জাজনক! এ যেন হয়ে উঠে নিজের মাতৃভাষাটাকে ভাসা ভাসা জানা। আঞ্চলিকতা জানা কোন খারাপ কিছু নয় বরং নিজ ভাষার প্রতি ভালবাসাই প্রকাশ পায়।
ইদানিং বিবাহ বা কোন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র ইংরেজীতে লেখার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। আমন্ত্রণপত্রে বাংলা শব্দের কোন টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে আবার আত্মশ্লাঘায় ভুগে ভাবে, ইংরেজীতে নিমন্ত্রণপত্র লিখলে নাকি উচ্চমার্গীয় বলে মনে হয়। কিন্তু এটা যে মা, মাটি, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে প্রতারণা বৈ আর কিছুই নয় সেটা বুঝতে পারে না। উচ্চমার্গীয় হবে কি; নিম্নমার্গীয় পর্যায়ে পড়ে কিনা সন্দেহ! যদি কেউ বাংলা ভাষা না জানে ও বুঝে তাদের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু যেখানে শতভাগ নিমন্ত্রিত অতিথীই থাকে বাঙ্গালী সেখানে ইংরেজীতে লেখার কোন যুক্তি নেই। এ ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যায়- তাদের জন্য হয়তো মাতৃভাষা ভাসা ভাসা বলেই মনে হয়। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও আমরা বাঙ্গালীরা এখনো অন্য ভাষার গোলামী করে যাচ্ছি। যেখানে আইন করেও অন্য ভাষায় প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনা বন্ধ করা যায় না সেখানে ভাষাপ্রীতি জাগ্রত হবে না তা নিশ্চিত। দেশের সর্বত্র দোকানপাট, মার্কেট, রেস্টুরেন্টগুলোর নামকরণে ইংরেজী শব্দের অযাচিত ব্যবহার। এখানেও সেই ইংরেজি শব্দ প্রেজটিজের বিষয়! প্রেজটিজের দোলাচালে পড়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছিলেন। মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা হবে না মনে করে বিদেশী ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম! বিদেশীরা মাইকেল মধুসূদনের সৃষ্টিকে গ্রহণ করলো না। অবশেষে বোধদয় হয়; ফিরে আসেন মাতৃক্রোড়ে; শুরু করেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা। যে ভাষাকে ভাসা ভাসা ভেবেছিলেন সে ভাষায় সনেট ও মহাকাব্য রচনা করে হয়ে উঠেন মহাকবি।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়- ভাষার মৃত্যু আছে। প্রতিনিয়ত ভাষার মৃত্যু হচ্ছে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টাই এর জীবন্ত উদাহরণ। যদি সেই সময় পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হতো তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষার মৃত্যু হতো। সরকারি পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত উর্দূ নামক বিদঘুটে একটি ভাষায় কথা বলতো বাংলা ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে। প্রকৃতিগতভাবে ভাষার মৃত্যু হয়। কিন্তু জোর করে ভাষাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেই সম্ভব হয়েছিলো। বাংলা ভাষার মৃত্যুর সাথে সাথে বাঙ্গালীর হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মৃত্যু ঘটতো। বাঙ্গালী সব সময় ভাষাকে ভালবেসেছে; আর তাই ভাষার জন্য প্রাণ দেবার নজির এদেশেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দুঃখ হয় তখন যখন বাঙ্গালী হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষায় কথা বলায় অনেকে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। অবশ্যই একাধিক ভাষা জানা ভালো তবে নিজের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে তা কখনো হতে পারেনা। নিজের ভাষা যদি ভাসা ভাসা জানি তাহলে ভাষার গৌরব একটুও কমবে না বরং নিজের সন্মানহানি হবে এতে নিশ্চয়তা রয়েছে। তবে সত্য কথা- ইদানিং ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা ভাষার পাঁচ-মিশালীতে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য হারিয়ে যাবার পথে। বাংলা ভাষার মধ্যে যে প্রাচুর্য ও মাধুর্য আছে তা অবলোকন করতে পারলেই বাংলা ভাষা আর নিজের কাছে ভাসা ভাসা মনে হবে না। বরং অন্য ভাষার গোলামী ত্যাগ নিজের মাতৃভাষার গোলামী করে আত্মতৃপ্তি লাভ সম্ভব হবে।