গত ২১ জুন ২০২২ খ্রিস্টাব্দ বিকাল ৪:০০ ঘটিকায় ভাটিকান ও বাংলাদেশ থেকে একযোগে ঘোষণা করা হয় যে, পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় ভিকার জেনারেল ফাদার ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও’কে বরিশাল ধর্মপ্রদেশের বিশপ রূপে মনোনীত করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত ও পোপ মহোদয়ের প্রতিনিধি আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী’র অসুস্থ্যতার কারণে উপস্থিত থাকতে না পারায় বরিশাল ধর্মপ্রদেশের এপোস্টলিক প্রশাসক আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি, পূণ্যপিতা পোপ মহোদয়ের এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
একই সময়ে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লী থেকে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও শ্রদ্ধেয় ভিকার জেনারেল ফাদার ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও’র বরিশাল ধর্মপ্রদেশের বিশপ পদে মনোনীত হওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর বিশপ জের্ভাস রোজারিও বরিশাল ধর্মপ্রদেশের নবনিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও’র বিশপ নির্বাচিত হওয়ার চিহ্নস্বরূপ মাথায় টুপি এবং গলায় মালা পড়িয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। অতঃপর বিভিন্ন ধর্মপল্লীর ফাদার-সিস্টারগণ, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ নবনিযুক্ত বিশপকে ফুলের মালা ও তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। নবনিযুক্ত বিশপ যেন বরিশাল ধর্মপ্রদেশের পালকীয় দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে সুন্দরভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন এবং তার জীবনের জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এবং তার মঙ্গল কামনা করে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা কবলিত দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের সার্বিক মঙ্গল কামনা করে এক প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জন্মস্থান
নব নিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফৈলজানা ধর্মপল্লীর ডিওরপাড়া গ্রামে ০৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত মি: আন্তনী রোজারিও, মাতা মৃত মিসেস এলিজাবেথ রোজারিও। তারা পরিবারে ৬ ভাই ২ বোন। তাদের মধ্যে বিশপ ইম্মানুয়েল হলেন পঞ্চম।
শিক্ষা জীবন
তিনি কেজি থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ফৈলজানা সেন্ট জেভিয়ার স্কুলে পড়াশুনা করেছেন (১৯৭০-১৯৭৮) পর্যন্ত। ৮ম শ্রেণীতে পড়েছেন বোর্ণী ধর্মপল্লীর সেন্ট লুইস উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে (১৯৭৯)। ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেছেন দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস্ হাই স্কুল থেকে (১৯৮০-১৯৮২)। এইচএসসি ও বিএ পড়াশুনা করেন নটরডেম কলেজ থেকে (১৯৮২-১৯৮৬) পর্যন্ত। বাইবেলীয় ঐশতত্ত্ব নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন পন্টিফিক্যাল ইউনিভার্সিটি রোম থেকে (১৯৯৭-২০০১) পর্যন্ত।
যাজকীয় জীবনে গঠন লাভ
নবনিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও ১৯৮০-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাজক হবার উদ্দেশ্যে দিনাজপুর সেন্ট যোসেফস্ মাইনর সেমিনারীতে গঠন লাভ করেন। ১৯৮২-১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাজকীয় জীবনের জন্য গঠন লাভ করেন সেন্ট যোসেফ ইন্টারমিডিয়েট সেমিনারী, রমনা, ঢাকা। দর্শন ও ঐশতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনা ও গঠন লাভ করেন ১৯৮৬-১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী বনানী থেকে।
পরিসেবক ও যাজকীয় অভিষেক লাভ
নবনিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে রমনা ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে ডিকন পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২৮ ডিসেম্বর ফৈলজানা ধর্মপল্লীতে তৎকালীন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের প্রথম বিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি (বর্তমান কার্ডিনাল) কর্তৃক যাজক পদে অভিষিক্ত হন। মনোনীত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও ফৈলজানা ধর্মপল্লীর দ্বিতীয় পুরোহিত, যাকে বিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বিশপ হিসেবে দ্বিতীয় পুরোহিত হিসেবে অভিষিক্ত করেন।
পালকীয় কাজ
নবনিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উদ্যমী, বুদ্ধিদীপ্ত, তুখোর ও মেধাবী। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি একজন বাইবেল ঐশতত্ত্ববিদ, শিক্ষক এবং লেখক। পালকীয় কাজেও তিনি দক্ষতার সাথে তার পালকীয় ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি জনগণের ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য তিনি সর্বদা সত্যের স্বপক্ষে কাজ করেছেন। পালকীয় কাজে তিনি একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ পালক হিসেবে সুনিপুণভাবে তার সকল কর্মক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তার গভীর প্রার্থনাময় জীবন ও আধ্যাত্মিক সাধনা মানুষের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। তিনি সমাজ ও মণ্ডলি সম্পর্কে সচেতন একজন ব্যক্তি, যিনি সর্বদা মণ্ডলি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষভাবে কারিতাস বাংলাদেশের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থেকে মাণ্ডলিক, সামাজিক কার্যক্রমগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য তাঁর উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
যাজকীয় গঠন, উৎসর্গকৃত জীবন ও খ্রিস্টভক্তদের গঠনদানের জন্য তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচুর এবং সেক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীতে পরিচালক হিসেবে ৬ বছর সেবাদায়িত্ব পালনসহ মোট ১১ বছর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ও বিদেশে গঠন ও পরিচালনা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তিনি ফেডারেশন অফ এশিয়ান বিশপ কনফারেন্সে ঐশতত্ত্ব বিষয়ক দপ্তরের সদস্য এবং খ্রিস্টভক্ত ও পরিবার বিষয়ক দপ্তরে নির্বাহী সচিব হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯২-১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বনপাড়া লূর্দের রাণী মারীয়া ধর্মপল্লীতে ডিকন হিসেবে তাঁর সেবা দায়িত্ব পালন করেন। একই ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৪-১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এরই মাঝে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ মাস দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশে বুলাকীপুর সেমিনারীতে যাজকীয় জীবনের আধ্যাত্মিক গঠন দানের জন্য সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে ফাদার আঞ্জেলো কান্তনের অনুপস্থিতিতে ৩ মাস পালকীয় সেবাদান করেন। অতঃপর ১৯৯৭-২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য রোম নগরীতে পন্টিফিক্যাল ইউনিভার্সিটি উর্বানিয়ানা থেকে বাইবেলীয় ঐশতত্ত্ব এর উপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। পড়াশুনা শেষে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে ফিরে এসে ২০০২-২০০৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত বোর্ণী মারীয়াবাদ ধর্মপল্লীতে পাল-পুরোহিত হিসেবে সেবা দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীতে ডিন অফ স্টাডিজ এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীতে শিক্ষকতা এবং সহকারি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস থেকে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী বনানীতে শিক্ষকতা এবং পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় উন্নয়ন ও প্রশাসনিক দপ্তরে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত পবিত্র পরিবার ধর্মপল্লী কলিম নগরের প্রথম পাল-পুরোহিত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত এবং রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের মধ্যেই তার সেবা দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি আন্তর্জাতিক ভাবেও তার সেবা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন অদ্যবধি। বর্তমানে তিনি ফেডারেশন অফ এশিয়ান বিশপ কনফারেন্সে ঐশতত্ত্ব বিষয়ক দপ্তরের সদস্য এবং খ্রিস্টভক্ত ও পরিবার বিষয়ক দপ্তরে নির্বাহী সচিব হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
লেখক হিসেবে তার অবদান
মনোনীত বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও বাংলায় এবং ইংরেজীতে অনেক আর্টিকেল লিখেছেন যা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে, সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রদীপণে বিভিন্ন সময়ে তার লেখনীর মধ্যদিয়ে মানুষকে আলোকিত করেছেন। জাতীয় ট্রেনিং সেন্টার যশোর থেকে যে মঙ্গলবার্তা প্রকাশিত হয় তাতেও তার লেখা আর্টিকেল ছাপানো হয়েছে। সর্বোপরি ২০১০ খ্রিস্টাব্দে স্বর্গ জয়ের অধম্য পালক সাধু জন মেরী ভিয়েন্নী নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন প্রতিবেশী প্রকাশনী থেকে। এভাবে তিনি তার জ্ঞানের আলো অন্যদের মাঝে সর্বদায় দান করতে চেষ্টা করেছেন বা করে যাচ্ছেন।
নবনিযুক্ত বিশপ ইম্মানুয়েলের অতীত জীবনের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি, তিনি অত্যন্ত মেধাবী, চিন্তাশীল, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং মানুষের প্রতি উদার হৃদয়ের ভালোবাসা নিয়ে সর্বদা ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একজন জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তাঁর নম্রতা, প্রার্থনাময় জীবন ও অধ্যাত্ম সাধনা এবং কষ্ট সহিষ্ণুতা আমাদের সকলের কাছে অনুকরণীয়। কেননা, এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই তিনি অদ্যবধি পর্যন্ত খ্রিস্ট সৈনিক হিসেবে এগিয়ে চলেছেন ঈশ্বরের ভালোবাসাময় রাজ্য স্থাপনে। তাঁর এই আন্তরিক, উদার ও খ্রিস্টনির্ভর জীবন বিশ্বাসী এক সেবকের পরিচয় বহন করে। ঈশ্বর তাঁর এই মনোনীত ভক্ত সেবককে মাণ্ডলিক সেবা দায়িত্ব পালনের যে সুযোগ দান করেছেন সেটা আমাদের মাণ্ডলিক জীবনের একটি বিশেষ উপহার। আমরা তাঁর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি যেন তিনি তাঁর বিশপীয় অভিষেকের মধ্যদিয়ে অপরখ্রিস্ট হয়ে বরিশাল ধর্মপ্রদেশের সকল ভক্তের কল্যাণে ও মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে পারেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু সি.কোড়াইয়া